আইয়ুব বাচ্চুর শেষ গান
মৃত্যুর একদিন আগেও গান নিয়ে সরব ছিলেন যে মানুষটি তার মৌলিক শেষ গানটি প্রকাশ হয়েছিল দুই বছর আগে। নিয়মিতই টেলিভিশনের বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে হাজির হতেন আইয়ুব বাচ্চু। আর স্টেজ শোতে সরব ছিলেন সব সময়। দেশে বিদেশে যেখানেই গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেতেন সেখানেই ছুটে যেতেন গান গাইতে। নিজের অসুস্থ শরীর নিয়েই গান গেয়ে, গিটার বাজিয়ে হাজার হাজার মানুষের মন ভালো করে দিয়ে আসতেন ছয় তারের এই জাদুকর।
বাংলাসংগীতাঙ্গনে যেই কথা, সুর ও সংগীত দিয়ে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু সেটা ভাঙিয়েই অনেকে সাচ্ছন্দে জীবন পার করতে পারবেন। তার গান ছাড়া যে কোনো স্টেজ শোই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গিটার শিখতে গেলেও তার গান সহায়ক হয়। নতুন স্টেজ পারফর্ম করতে গেলেও তার গান গাইতে হয়। রক সংগীতে বাংলাদেশের মাটিতে যে স্বপ্নটা বুনে গিয়েছিলেন আজম খান, সেই স্বপ্নের পূর্ণ রূপ রেখা দিয়ে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু। গান নিয়ে আরও অনেক স্বপ্ন ছিল তার। নতুন প্রজন্মের জন্য আরও অনেক গান রেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি।
হয় তো শেষ দিনগুলোতে যেমন মূল্যায়ন পাওয়ার যোগ্য ছিলেন, সেই মূল্যায়ন পাননি তিনি। সেই কারণে নিয়মিত স্টেজ শো করলেও নতুন গান প্রকাশের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অভিমানি এই মানুষটি নতুন গান প্রকাশ করেননি অনেক দিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া সর্বশেষ গানটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘ছায়াশরীরী’ নামের একটি মিশ্র অ্যালবামে। প্রায় দুই বছর আগে ঈদুল ফিতরে এক্সক্লুসিভ হিসেবেই বাজারে এসেছিল অ্যালবামটি। আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া গানটির নাম অনুসারেই অ্যালবামটির নাম করণ করা হয়েছিল।
আলো আঁধারীরর ঘেরা টোপে ঢাকা, হিসেবের খাতাটা যদিওবা ফাঁকা, ভুলে গেছে একজন কেবা ছিল প্রিয়জন, বুকভরা কান্নাটা তবু পুষে রাখা, দুঃখ কষ্ট অনেক জ্বালা হারতে নয় আর রাজি, ছায়া শরীরী একটা মানুষ জীবন রাখে বাজি। এমনই কথার গানটি লিখেছিলেন এম এস রানা। গানটির সুরকার জিয়া খান আর গানটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন চিরকুট ব্যান্ডের পাভেল। পরে এই গানটির ভিডিও প্রকাশ করা হয়। ভিডিওটি নির্মাণ করেছেন মঞ্জু আহমেদ। ২০১৬ সালের ১২ নভেম্বর জিসিরিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয় গানটির ভিডিও।
২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরের বেশ আলোচিত ছিল অ্যালবামটি। অ্যালবামের অন্য গানগুলো ছিল— ‘হাঁটছি’, ‘ও মন তুই’, ‘একলা আকাশ’, ‘তুমি ফিরে এসো আবার’, ‘প্রেমের সংবিধান`, ‘কেউ কারো নয়’। কণ্ঠ দিয়েছেন তপু, বালাম, কোনাল, জিয়া খান, ভারতের রুপম ইসলাম ও রাঘব চ্যাটার্জি। এই গানটির দুই বছর আগে ২০১৪ সালে প্রকাশ হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর ‘জীবনের গল্প’ গানের ভিডিও।
জীবনের গল্প গানের পরে এই গানটিতে কণ্ঠ দেওয়ার পেছনেও কয়েকটি কারণ ছিল। গানটির সুরকারকে ভালোবেসেই এই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। বেশির ভাগ সময়ই নিজের সুর ও সংগীতে গান করতেন তিনি। এক সময় অন্যদের সুরেও কিছু গান গেয়েছেন। তবে দীর্ঘ ৯ বছর পর আবারও অন্যের সুর-সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এই গানে।
গানটি নিয়ে সেই সময় আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘গানটির কথা ও সুর আমার খুবই ভালো লেগেছে। অ্যালবামটির সুরকার ও সমন্বয়কারী জিয়া খানের অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল তার সুরে আমাকে দিয়ে একটি গান করাবেন। ব্যস্ততার কারণে আমি সময় বের করতে পারছিলাম না। অবশেষে জিয়ার ইচ্ছাশক্তি ও চমৎকার সুরের কারণে সময় বের করে গানটি গাওয়া।’
রোববার সন্ধ্যা এই গানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন সুরকার জিয়া খান। জিয়া খান জাগো নিউজকে বললেন,‘প্রিয় মানুষকে হারানোর কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা কখনই সম্ভব নয়। বাচ্চু ভাইয়ের অনেক বড় একটা গুনছিল উনি মানুষকে বুকে টেনে নিতে পারতেন খুব সহজেই। তার সঙ্গে যাদের মেশার সুযোগ হয়েছে তারা প্রত্যেকেই জানেন তার শিশুসুলভ ব্যবহারের কথা। অনেক কষ্ট হচ্ছে কারণ, বাচ্চু ভাইয়ের সর্ব শেষ স্টেজ শো তে আমিও উপস্থিত ছিলাম। রাতে গানের শো করে এসে, পরের দিন তার মৃত্যুর সংবাদ শুনতে হবে কখনোই কল্পনাও করিনি। তিনি এখন আমাদের থেকে অনেক দূরে। তার জন্য অনেক দোয়া করি। সারাদেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া পেয়েছেন তিনি। পরপারেও অনেক ভালো থাকুন বাচ্চু ভাই।’
তার জন্ম ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের এনায়েতবাজার এলাকায় জন্মগ্রহন করেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৯১ সালে জন্ম নেওয়া ‘এলআরবি’ ব্যান্ড দলের লিড গিটারিস্ট এবং ভোকাল ছিলেন। এর আগে তিনি প্রায় ১০ বছর সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সংগীত জগতে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে। অত্যন্ত গুণী এই শিল্পী তার শ্রোতা-ভক্তদের কাছে এবি নামেও পরিচিত। আইয়ুব বাচ্চু মূলত রক ঘরানার কণ্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, ক্লাসিক্যাল সংগীত এবং লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে (১৮ অক্টোবর ২০১৮) না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। শনিবার (২০ অক্টোবর ২০১৮) বিকেলে চট্টগ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে শেষ নিদ্রায় শায়িত হন তিনি।
এমএবি/এলএ/এমএস