ভালোবাসতেন আইয়ুব বাচ্চু, ভালোবাসাতেই বিদায়
শূন্য হাতে পা রেখেছিলেন ঢাকায়। দু'চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, একদিন গায়ক হবেন। সংগ্রামী এক জীবন, বেদনা-দুঃখের কতো গল্প পেরিয়ে তিনি ঠিকই দেখা পেয়েছিলেন গানের সেই রাজ্যের। গিটারের সুর আর গানের মূর্ছনা ছড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছেন জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ চূড়ায়। এদেশের ব্যান্ড সংগীত শাসন করেছেন প্রায় চার দশক।
কুমার বিশ্বজিৎ, এন্ড্রু কিশোরের মতো বন্ধুরা নানা স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চুর কষ্টে ভরা সেসব জীবনের গল্প। তারা বলেছেন, ‘বাচ্চু পরিশ্রমী, বাচ্চু আবেগী’। বলেছেন আইয়ুব বাচ্চু ভালোবাসার কাঙ্গাল ছিলেন। ভালোবাসার তীব্রতা যার হৃদয়ে থাকে, সেই অভিমানী হয়। আইয়ুব বাচ্চুর অভিমানী মনের খবর এই দেশের শোবিজে সবখানেই ছড়ানো। তার এই অভিমানকেও ভালোবাসতেন তার কাছের মানুষরা।
গান ভালোবাসতেন বলেই গায়ক হয়েছেন। গিটারের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসাই তাকে উপমহাদেশের সেরা গিটারিস্ট বানিয়েছে। নিজের স্বপ্নগুলোকে ভালোবাসতে বলেই তিনি শ্রোতাদের মন জয় করে নিতে পেরেছিলেন। হয়ে উঠতে পেরেছিলেন একজন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি তার ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন, বিনয়ী ছিলেন। এই ভালোবাসা তিনি অব্যাহত রেখেছেন আমৃত্যু।
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের তিনি ভালোবাসতেন। তার সেই ভালোবাসা তাদের উৎসাহিত করেছে। তিনি গুণীদের ভালোবাসতেন, গুণকে ভালোবাসতেন। প্রয়াত পপগুরু আজম খানের শেষ দিনগুলোতে তিনি তাকে সঙ্গ দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। বিনা বাক্য ব্যয়ে তাকে গুরু বলে ডেকেছেন। সহকর্মীদের ভালোবাসতেন, ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে পারতেন। তার মৃত্যুর পর দেশের আরেক লিজেন্ড জেমসের হাহাকার তৈরি করা কান্না সেই ভালোবাসা বহন করে চলেছে।
সাংবাদিকদের তিনি ভালোবাসতেন। তার কাছের সাংবাদিক মইনুল হক রোজের মৃত বাবার খাটিয়া নিজের কাঁধে তুলে নিতে পেরেছিলেন দেশসেরা এই রকস্টার। এই গল্প ইন্ডাস্ট্রিতে সাংবাদিক-তারকাদের সম্পর্কের অনন্য এক গল্প।
সংসারকেও ভালোবাসতেন। হতে পেরেছেন দুই সন্তানের সফল একজন পিতা। নিজেও ছিলেন একজন মা পাগল সন্তান। মাকে নিয়ে তার গানটি নিজের জীবনের ব্যক্তিগত আবেগেই গেয়েছিলেন। রাগ করে বারবার তার গিটার ভেঙেছেন বাবা, তবুও বাবাকে ভালোবেসেছেন যোগ্য সন্তানের মতোই।
ছিলেন দানবীর। মানুষকে সহায়তা করতেন দুই হাত খুলে। তিনি মানুষ ভালোবাসতেন। দেশকেও ভালোবাসতেন। দেশের জন্য নেতিবাচক কোনো কাজেই কোনোদিন তাকে পাওয়া যায়নি। এক বিদেশি গিটার বিক্রেতা বাংলাদেশের শিল্পীদের হেয় করেছিলেন বলে খুবই দামি একটি গিটার অর্ধেক দামে পেয়েও সেটি নেননি। দেশ ভালোবাসতেন তিনি।
ভালোবাসার সেই মানুষটি সব ভালোবাসার প্রতিদানই যেন পেলেন মৃত্যুর পর। শ্রোতা-ভক্তরা আইয়ুব বাচ্চুর জন্য কাঁদছেন দু'দিন ধরে। আসাদুজ্জামান নূর, তপন চৌধুরী, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মতো সিনিয়ররা তার জন্য কাঁদেন, কুমার বিশ্বজিৎ, এন্ড্রু কিশোরদের মতো বন্ধুরা তার জন্য কাঁদেন, পার্থ বড়ুয়া, শুভ্রদেব, নায়ক ফেরদৌসের মতো জুনিয়রেরা তার জন্য কাঁদেন। তার মৃত্যু তারকাদের এক কাতারে নামিয়ে এনেছে।
ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরেও তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, জানাজায় অংশ নিতে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। চট্টগ্রামে নামে মানুষের সমুদ্র। বয়স, শ্রেণি, পেশা, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে গেছেন আইয়ুব বাচ্চুর শোকে। কেন? সে তো ভালোবাসার জন্যই!
কতোটা ভালোবাসা ধারণ করতে পারলে, ছড়িয়ে যেতে পারলে এমন আশ্চর্যজনক ভালোবাসা ভাগ্যে মেলে সেটার গাণিতিক ব্যাখ্যা হয়তো আধুনিক বিজ্ঞানেও মিলবে না, মেলাতেও চাই না। উপলব্ধি করেছি, তারকা খ্যাতির অহঙ্কার ভুলে ভালোবাসতে জানলেই একজন আইয়ুব বাচ্চু হওয়া যায়।
আমরা শুধু আইয়ুব বাচ্চুকে ভালোবেসে যেতে চাই। ভালোবাসা নিতে থাকুন হে কিংবদন্তি।
এলএ/এসএইচএস/আরআইপি