আহা চলচ্চিত্র, আহারে প্রতিশ্রুতি!
চলচ্চিত্র বলতে চলমান চিত্রকেই জানি, সময়ের কপালে চলমান ঘটনা-বিষয়ের দৃশ্যায়নকেই বুঝি। কখনো তা হতে পারে বাস্তবিক, কখনো অতিবাস্তবিক। এই চলমান চিত্রে বিনোদন-শিক্ষা-বার্তা পাশাপাশি থাকতেও পারে, না-ও পারে। প্রতিটি দৃশ্য-ফ্রেম হতেও পারে কবিতার দৃশ্যরূপ। সহস্র মাসুম স্বপ্নের বীজতলাও বলা যেতে পারে একেকটি চলচ্চিত্রকে। একটি উন্নত স্বাধীন চিন্তার চলচ্চিত্র বদলে দিতে পারে একটি রাষ্ট্রের আমূল কাঠামো।
মরচে পড়া একটি জাতিকে বদলে দিয়ে চকচকে করতে পারে একটি চলচ্চিত্র। কিন্তু হায়! আহা চলচ্চিত্র! আহারে চলচ্চিত্র! বাহারি প্রতিশ্রুতির জালে বন্দি। যেন বাবার চতুর্থ দজ্জাল বউয়ের কাছে প্রথম স্ত্রীর সন্তান বেড়ে উঠছে। অনাথ-এতিম অসহায় চলচ্চিত্র। কারওয়ান বাজারের পথশিশুর মতো বেঁচে আছে। হাজারো প্রতিশ্রুতি আর বাকোয়াজির মাঝে দমবন্ধ অবস্থায় বেঁচে আছে।
কেন এই পরিস্থিতি? কারণগুলো সবাই জানি। কিন্তু সমস্যার সমাধানে আমাদের প্রচুর অনীহা। তাদের কণ্ঠে কেবল কোমর না থাকা লোকটার মতো হুঙ্কার- ‘উঠলে কিন্তু বাঁচবে না।’
আসলে সে উঠতেই পারবে না কোনোদিন। কারণ সে তার মগজ-মেধা-আদর্শ বেচে দিয়ে বেঁচে আছে জড়পদার্থ হয়ে। কেবলই বিভাজন। পা চাটার অভ্যাস। পায়ে মাথা রেখে ‘ম্যাও ম্যাও’ করতে শিখে গেছে তারা। সবাই নিজ নিজ জায়গায় চলচ্চিত্রের ঈশ্বর। অজস্র চলচ্চিত্র জন্ম নিচ্ছে অন্যের আদলে। নিজস্ব ভাষা নেই। অন্যের সন্তানের বাবা হতেই সুখ খুঁজে পাচ্ছে কেউ কেউ। রাষ্ট্রের আঙুল কচি মুরগির লোভে পড়ে শাক দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে মাছ। গাছের গোড়া কেটে মাথায় ঢালছে পানি। চারদিকে কানাকানি, ফিসফাস, সাপের হিসহিস শব্দে স্তব্ধ চলচ্চিত্র যাত্রা।
অথচ মুক্তির উপায় আমরা সবাই জানি। সম্মিলিতভাবে মুক্তির মিছিল নেই। কারণ আমরা জেনে গেছি- পা চেটেই পাওয়া যায় বাঁচার রসদ। ভবিষ্যতের ভূগোলে গাঢ় অন্ধকার। জনাব, নিজের গর্তেই কিন্তু পড়েছিল শেয়াল।
বিগত দশ বছর ধরে কেবল শুনেই যাচ্ছি- সরকার সারাদেশে সিনেপ্লেক্স করে দেবে। কিন্তু দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না বা হচ্ছে না সেই প্রশ্ন কেউ করছে না। যারা চলচ্চিত্রের ঈশ্বর বলে দাঁড়িয়ে গেছেন; তারা চুপচাপ চেটে যাচ্ছেন পা আর পেটে ঘা নিয়ে মরে যাচ্ছে অজস্র সম্ভাবনা।
কেউ বলছেন, ভালো চলচ্চিত্রই নেই। সিনেপ্লেক্সে দিয়ে কী হবে? হবে। সিনেপ্লেক্স দিয়েই হবে। ভালো খাবার পরিবেশন করার জন্য ভালো জায়গা প্রয়োজন। আছে সেই জায়গা? নেই। সিনেমা দেখতে গেলে ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা হয়। পারবেন ভাগাড়ে বসে পোলাও খেতে? পারবেন না। অথচ গলার রগ ফুলিয়ে বলবেন, ভালো চলচ্চিত্রই নেই আবার জেলায় জেলায় সিনেপ্লেক্সের স্বপ্ন! ধ্যাৎ, কোত্থেকে যে আসে এসব!
এভাবে বলবেন না, সারাদেশে অন্তত প্রতি জেলায় একটি করে সিনেপ্লেক্স করে দিয়েই দেখেন না, লগ্নিকৃত টাকা উঠে আসবে। ভালো জায়গায় ভালো খাবার খেতে সবাই যেতে চায়। প্রতিদিন না গেলেও বছরে একদিন তো যাবে! এভাবেই অভ্যাস হবে।
বিএফডিসি- বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের তীর্থক্ষেত্র। কিন্তু সময়ের চাহিদার কাছে জায়গাটা ব্যবহারের দিক থেকে বেশ ছোট হয়ে গেছে। নতুন জায়গা দরকার। পরিকল্পিত জায়গা দরকার, যেখানে নান্দনিকভাবে চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন করা যায়। এখানেও লুকিয়ে আছে ভানুমতীর খেল।
গাজীপুরের কবিরপুরে একটি ফিল্ম সিটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা নাম বদলের স্রোতেই সীমাবদ্ধ। সরেজমিনে গিয়ে দেখবেন, উল্লেখযোগ্য ক্ষ্যাত শ্রেণির কিছু হচ্ছে কচ্ছপ গতিতে। কেন এমন হবে? কেন একটি প্রয়োজনীয় প্রকল্প এভাবে বাস্তবায়িত হবে? কেন প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? প্রশ্নগুলো কেউ করছি না। কেন করছি না? চাকরি থাকবে না। আহা শিল্প! আহারে শিল্পী।
চলচ্চিত্রের বিপণন ব্যবস্থা এক অপার বিস্ময়ের নাম। একটা ফিল্মের (ভয়ংকর সুন্দর) বিপণনের দায়িত্বে ছিলাম। খুব কাছে থেকে দেখেছি এই অতিপ্রাকৃত বিপণন কলা। এখানে বহুস্তরীয় সিন্ডিকেটের পাশাপাশি রয়েছে দেশে বিদ্যমান অমায়িক নিরীহ রাজনীতির কোমল প্রভাব। প্রযোজক-পরিচালককে পথে বসানোর বীভৎস উপায় আছে এখানে। প্রতিনিধি সিন্ডিকেট, ব্যবস্থাপক সিন্ডিকেট, পরিবেশক সিন্ডিকেট, হল মালিক সিন্ডিকেট। বের হয়ে আসা ফরজ এই মারফতি বিপণন ব্যবস্থা থেকে।
অনেকে বলেছেনও এর আগে। কিন্তু কার্যকর করার ক্ষেত্রে সবাই নন্দলাল। চিৎকারের সময় ঠিকই গলা ফাটিয়ে বলবে হল মালিকরা টাকা দেয় না ঠিকঠাক। আরে এই বেঠিক কারবার তো বহু পুরনো। বদলে ফেলা যায় না এই নকশাটা? খুব যায়। কিন্তু, মালাই খাবো শুধু এই করে করে দুধ শুকিয়ে যাচ্ছে তপ্ত গ্রীষ্মে। মালাই জমছে না। মাঠে নামুন। নইলে আপনিও পথে নেমে যাবেন ভাঙা থালা হাতে- স্বার্থ ফুরালে কেউ কাছে রাখে না।
সেন্সরবোর্ড। মস্তবড় মস্তিষ্কসমূহের এক বিশাল আয়োজন। আমলা দিয়ে শিল্প সামলানোর চমৎকার কিছু একটা। কাটোছাটো ইচ্ছেমতো- এটাই তাদের কাজ। চলচ্চিত্রকে বনসাই করে রাখার এই আয়োজন কোনোভাবেই মেনে নেবার মতো নয়। আমার জানামতে, কোনো দেশেই চলচ্চিত্রের উপর এমন কাটাছেড়া, নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ব্যবস্থা নেই।
সেন্সরের নীতিমালাগুলোকে বদলে সেখানে সময়ের দাবিকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। চলচ্চিত্রের গল্পের বিষয়ে স্বাধীনতা দিতে হবে। ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষত নান্দনিক উপায়ে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বাধা-নিষেধ রাখাটা শিল্পের সাথে চরম হতাশার। দর্শক বিচার করুক, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। দর্শক বিচার করুক- সে পান্তা খাবে, না পোলাও খাবে। সেই স্বাধীনতা তাদের প্রাপ্য।
শিল্প-সংস্কৃতি যেখানে নপুংসক; সেখানে মৌলবাদের উত্থিত মস্তক খবরদারী করে। কেজি দরে তোষামোদের লেনদেন হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের ভেতর বাঁশনৃত্য করবে, ৫৭-৩২ ধারার মতো নানারকম অদ্ভুত আইন পাস হবে- এসবই স্বাভাবিক। সুতরাং আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
রাষ্ট্রে প্রচলিত রাজনৈতিক চরিত্র শিল্পকে গুটিয়ে রাখতে চাইবে- অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই রাষ্ট্র সাধারণ জনগণের। আর এই রাষ্ট্র যে সাধারণ জনগণের এটা বোঝানোর জন্য চলচ্চিত্রের স্বাধীনতা- উন্নতি বেশ জরুরি। চলচ্চিত্র নির্মাণ, বিপণন ও প্রদর্শনের জন্য যুগোপোযোগী অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি।
রাষ্ট্র চলচ্চিত্রের উন্নয়ন করতে যেন বাধ্য হয়, সেই ব্যবস্থা নেয়া এখনই উচিত। যারা চলচ্চিত্রকে পরিচালনা করছেন বিভাজনের দেয়াল মুছে ফেলুন আপনারা। আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য ঐক্যবদ্ধ লড়াই করুন। আসুন, অশিল্প ভুলে শিল্পের চাষাবাদ করি।
লেখক : শ্যামল শিশির
চলচ্চিত্র সহকারী পরিচালক।
এসইউ/এলএ/আরআইপি