অনেক বেকার নায়কও এখন ভিলেন : শিমুল খান
গল্প-কবিতা লেখায় ব্যস্ত তরুণ হঠাৎ করেই হয়ে গেলেন চলচ্চিত্রের মানুষ। শাহবাগ চত্বর, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, টিএসসি মাতানো তরুণ বনে গেলেন এফডিসির পরিচিত মুখ। তিনি নতুন প্রজন্মের অভিনেতা শিমুল খান। চলচ্চিত্রে ভিলেন হিসেবেই পরিচিত।
তবে নিজেকে একজন বহুমুখী চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তিনি। ৫ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কাজ করেছেন বেশ কিছু ব্যবসাসফল ও প্রশংসিত চলচ্চিত্রে। বর্তমানে হাতে আছে আরও কিছু চলচ্চিত্রের কাজ। সর্বশেষ মুক্তি পেয়েছে তার ‘জান্নাত’ ছবিটি। নিজের চলচ্চিত্র, সাম্প্রতিক ব্যস্ততা ও চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি শিমুল খান............
জাগো নিউজ : আপনার অভিনয়ে আসার শুরুটা কীভাবে?
শিমুল : শিল্প সাহিত্য চর্চা ছোটবেলা থেকেই আমার রক্তে মিশে আছে। দাদা ছিলেন ফরিদপুর জেলার অন্যতম প্রধান কবি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান। শৈশবে তিনি তার পাশে আমাদেরকে বসিয়ে তার রচিত নতুন নতুন কবিতা শোনাতেন। সেখান থেকেই মূলত শিল্প সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ তৈরি হয়। আর ক্লাস ওয়ান কিংবা টুতে পড়ার সময় থেকেই নিজেও কবিতা লিখতে শুরু করি। হাইস্কুলে উঠে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে কবিতার সংগঠন চালাতাম, লিটল ম্যাগ বের করতাম।
অভিনয়ের শুরুটা এলাকাতেই, থিয়েটারে। আমি এবং আমার ছোটবেলার বন্ধু বর্তমান চলচ্চিত্র পরিচালক বন্ধন বিশ্বাস মিলে থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে নিয়মিত নাটক প্রযোজনা করতাম। ঢাকায় স্থায়ী হবার পর এলাকায় আমাদের তৈরি করা সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডগুলো পুরোটাই বন্ধ হয়ে যায়। তখন মনযোগ ছিলো অভিনয় নিয়েই। এমনি করেই চলচ্চিত্রে ডাক আসে। নিয়মিত কাজ করছি।
একটা সময় মনে হয়েছিলো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়েছি জীবনের তাগিদে। কিন্তু এখন এবং বাকিজীবন এটাই আমার শেষ ভালবাসা। যদিও আমি পড়াশোনা করেছি ফ্যাশন ডিজাইনে এবং বেশ কিছুদিন ডিজাইনার হিসেবে ঢাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্ম করেছি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করাটাই জীবনের ব্রত আমার।
জাগো নিউজ : সবাই তো নায়ক হতে চায় আজকাল। আপনি নিজেকে একজন ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভিলেন চরিত্রের প্রতি কোনো বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে কী?
শিমুল : ভিলেন হিসেবে প্রথম সুযোগ পেয়েছি তাই ভিলেন হিসেবেই বেশি কাজ করে চলেছি। আমারও মনে হয়েছে দর্শক আমাকে ভিলেন চরিত্রে গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর বাইরেও আমি অন্যরকম চরিত্রগুলো করছি। যদিও আমার প্রধান লক্ষ্য একজন সব্যসাচী অভিনেতা হওয়া যে কিনা চোখের পলকে একের পর এক নেগেটিভ-পজিটিভ যে কোন চরিত্রে অভিনয় করে হাজার বছর মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে। আমিও সেই জায়গায় পৌঁছাতে চাই যেখানে আছে সম্মান ও গর্ব।
জাগো নিউজ : অভিযোগ আছে বর্তমানের চলচ্চিত্রগুলোতে খুব একটা গুরুত্ব পায় না ভিলেন চরিত্রগুলো। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে ভিলেন হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা কতদূর বলে মনে করেন?
শিমুল : এটা একটি সমস্যা। চলচ্চিত্র অনেক বড় ক্যানভাস। সেখানে প্রতিটি চরিত্রের জন্য আলাদা গুরুত্ব রাখতে হয়। তবে আমার মনে হয় বর্তমানের সমস্যা কেটে যাবে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমায় আগামী ৫ বছরের মধ্যেই নায়কের থেকেও বেশি মূল্যবান হবেন ভিলেনরা। সেই পথ তৈরিতে আমি ভূমিকা রাখতে চাই।
জাগো নিউজ : আপনাকে ভিলেন হিসেবে অনুপ্রাণিত করে যারা?
শিমুল : কেউ অনুপ্রাণিত করে না। অনেকেই প্রিয় অভিনয়শিল্পী রয়েছেন। তবে আমি চাই না আমার ভেতরে দর্শক অন্যকোনো অভিনেতার ছায়া খুঁজে পাক।
জাগো নিউজ : চলচ্চিত্রে ভিলেনদের মধ্যে একটা বংশ পরম্পরা মেইনটেইন করার ব্যাপার ছিলো একসময়। যেমন রাজিব, মিজু আহমেদ, আহমেদ শরীফ, সাদেক বাচ্চুরা এটিএম শামসুজ্জামান বা তার সমসাময়িক ভিলেনদের ছেলে বা জুনিয়র হিসেবে হাজির হতেন। এরপর রাজিব-হুমায়ূন ফরীদিদের উত্তরসূরী হিসেবে এসেছেন ডিপজল, ইলিয়াস কোবরা, গাঙ্গুয়া, ডন, মিশা সওদাগর। আজকাল তেমনটি দেখা যায় না। পরিচালকদের অভিযোগ আছে- সবাই মূল ভিলেন হয়ে কাজ করতে চায়। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
শিমুল : এখন তো আসলে তেমন কিছুই লক্ষ করা যায় না। যার যেমন ইচ্ছে কাজ করছে। অভিনয় না জানারা ভিলেন হচ্ছে, প্রযোজক ভিলেন হচ্ছে, পরিচালকের প্রিয় কেউ ভিলেন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ক্যারিয়ারের ভাটায় অনেক বেকার নায়করাও এখন ভিলেন। ভিলেনদের বংশ পরম্পরার তালটা কেটে গেছে এভাবে। আগের ছবিগুলোর গল্পই ছিলো প্রধান ভিলেন ও একজন জুনিয়র ভিলেনকে নিয়ে। সেকেন্ড ভিলেন কখনো সিনিয়র ভিলেনের ছেলে, ভাতিজা, ভাগ্নে কিংবা ছোট ভাই হিসেবে পর্দায় হাজির হতো। কিন্তু এখন আসলে আমাদের বাণিজ্যিক সিনেমার প্লাটফর্মটাই বদলে গেছে। নায়ক-নায়িকাই সর্বস্ব। বাকিরা তার সাপোর্ট দিচ্ছে মাত্র। ভিলেন নিয়ে এতকিছু ভাবার সময় বা ইচ্ছে দেখাই যায় না। তবে এখন গল্প পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়ে গেছে। ভিলেন হোক আর যেই চরিত্রই হোক তুমুল অভিনয় না করতে পারলে কোনো লাভ হচ্ছে না। সেইজন্য আমি সবসময়ই গল্প ও চরিত্রের গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ করতে চাই। ইন্ডাস্ট্রিতে এখন অল্প শিক্ষিত ও শিল্প চর্চার সাথে দূরত্ব আছে এমন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাই বেশি। সবাই গ্ল্যামার আর খ্যাতিকে প্রাধান্য দেয়। তার ভিড়ে আমি নিজেকে একজন ভালো অভিনেতা হিসেবে তুলে ধরতে চাই। এখানে জুনিয়র ভিলেন বা সিনিয়র ভিলেন- এমন কোনো বিভেদ টানতে চাই না। যেহেতু নতুন যুগ শুরু হয়েছে, বংশ পরম্পরার ব্যাপারটি আর ভাবতে চাই না।
জাগো নিউজ : ভিলেন হিসেবে আপনি কী কাউকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন?
শিমুল : আমি আসলে ভাল সিনেমা চর্চা করে ভাল সিনেমা সঞ্চয়ে বিশ্বাসী। অর্থাৎ ভাল কিছুর চর্চা করতে চাই। আর ভাল কিছু করতে পারলে অবশ্যই মানুষ আমাকে মনে রাখবে। সেই সাথে কিন্তু আমার অবস্থানও ইন্ডাস্ট্রিতে অটোমেটিক শক্ত হবে। গৎবাঁধা প্রতিযোগিতায় নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাই না।
জাগো নিউজ : স্বপ্নের কোনো চরিত্র, যেটিতে অভিনয় করতে পারলে নিজেকে তৃপ্ত মনে করবেন?
শিমুল : না নেই। তবে পারটিকিউলারলি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ এবং সবচেয়ে ভাল মানুষ দুটি চরিত্রে অভিনয় করতে চাই। সেইসঙ্গে পৃথিবীতে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলা এবং অস্তিত্ববিলীন হওয়া সকল ভাল এবং মন্দ চরিত্রগুলোতে কাজ করতে চাই।
জাগো নিউজ : সাহিত্য চর্চার সঙ্গে কী যোগাযোগ আছে?
শিমুল : আসলে লেখালেখি এবং অভিনয় আমার রক্তে মিশে থাকা দুটো অবিচ্ছেদ্য অংশের নাম। সহিত্য, ক্রিকেট, ফ্যাশন ডিজাইনিংসহ নানাকিছুতেই আসক্তি ছিলো। তবে অভিনয়টাকেই বেছে নিতে হয়েছে চোখবুজে। সময়ের বিবর্তনে অন্য ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে কবিতা লেখাটা কখনোই বাদ দিতে পারিনি। কারণ জীবনে আমার প্রথম প্রকাশিত প্রতিভা বা যোগ্যতা কবিতা লেখাই ছিলো।
কবিতার পাশাপাশি সম্প্রতি গান, চিত্রনাট্য এবং সংলাপও লিখছি। একটি ছবি খুব শিঘ্রই মুক্তি পাবে। সেখানে আমার সৃষ্টিশীল কিছু কাজ দেখা যাবে।
জাগো নিউজ : প্রায় বিশটির মতো চলচ্চিত্রে আপনি কাজ করেছেন। এখন পর্যন্ত নিজের অভিনীত প্রিয় এবং সেরা চরিত্র কোনটি?
শিমুল : ৫ বছরের ক্যারিয়ারে আমার অভিনীত ২৪টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। সেগুলোর অনেক চরিত্রেই কাজ করে তৃপ্তি পেয়েছি। তবে সেই অর্থে সেরা বলার মতো কাজ এখনো আমি করিনি বলেই মনে করি। তবে চলতি বছর থেকেই প্রিয় চরিত্রগুলো বড় পর্দায় আসতে থাকবে। স্বপ্নবাড়ি ছবির রবার্ট ডি সুজা, ছিটমহল ছবির নড়েন বাড়ৈ কিংবা ৯৯ ম্যানসন সিনেমার একাধিক চরিত্র ছাড়াও আরো বেশ কিছু ছবিতেই আমার প্রিয় চরিত্র আসছে। আর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে দেহরক্ষী, বৈষম্য, মোস্ট ওয়েলকাম-২, দেশা-দ্যা লিডার, মুসাফির, হিরো ৪২০, কার্তুজ, কিছু আশা কিছু ভালবাসা, ওয়ানওয়ে, শেষ চুম্বন, তুখোড়, বিজলী এবং নুরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার ছবির চরিত্রগুলো ভালো লাগে।
জাগো নিউজ : আপনার অভিনীত সর্বশেষ ‘জান্নাত’ ছবিটি নিয়ে বলুন.....
শিমুল : একটি ভাল গল্পের ছবি। মোস্তাফিজুর রহমান মানিক ভাই একজন ভালো নির্মাতা। চমৎকার করে ছবিটি বানিয়েছেন। সাইমন-মাহি জুটি রয়েছে এই ছবিতে। এখানে কাজ করে ভালো লেগেছে। ঈদে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি।
জাগো নিউজ : আপনার পরিবার, জন্মস্থান, পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলুন......
শিমুল : আমার জন্ম রাজবাড়ীতে। পাংশা থানার পাংশা জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর কোয়ার্টারে জন্ম ও শৈশব কাটিয়েছি। বাবা মৃত আব্দুল আলীম খান জেলা পরিষদে কাজ করতেন। মা শিউলী খান পান্না। ৪ ভাই ৫ বোন আমরা। ছেলেবেলাতেই সেজো বোন লিপি আপাকে হারিয়েছি। বর্তমানে মা ও স্ত্রী শেখ সুস্মিতা খানকে নিয়েই আমার সুখের পৃথিবী।
জাগো নিউজ : সংগ্রাম আর লড়াইয়ের অভিনয় চর্চায় চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারে ভবিষ্যতে নিজেকে কোন জায়গাটিতে দেখতে চান?
শিমুল : আমি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হবার স্বপ্ন দেখি। আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে বিশ্ব চলচ্চিত্রে প্রতিনিধিত্ব করারও স্বপ্ন দেখি আমি।
এলএ/জেআইএম