দর্শকের দুর্ভাগ্য দেশের নায়ককে আমদানি করে দেখতে হচ্ছে : শাকিব খান
নানা প্রতিকূলতায় ভুগছে ঢাকাই সিনেমা। কমছে সিনেমা, কমছে দর্শক, কমছে সিনেমা হল। বিপরীতে বাড়ছে চলচ্চিত্র শিল্পের বেকারত্ব। তবুও কিছু আশা জেগে রয়েছে কিছু মানুষ, কিছু প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। তাদের অন্যতম ঢালিউড কিং খ্যাত শাকিব খান। সিনেমার এই ক্রান্তি লগ্নেও হাল ধরে আছেন তিনি শক্ত হাতে। এখনো তাকে ঘিরে প্রযোজকরা টাকা লগ্নির সাহস করেন।
একদিকে যেমন দেশীয় প্রযোজনার ছবিতে কাজ করছেন শাকিব তেমনি কাজ করে যাচ্ছেন ওপার বাংলার চলচ্চিত্রেও। সম্প্রতি সাফটা চুক্তিতে ঢাকায় মুক্তি পেয়েছে ‘ভাইজান এলো রে’ ছবিটি। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে ‘নাকাব’ নামের আরও একটি ছবি। ছবিটি কোরবানি ঈদের পরই মুক্তি পাবে বলে শোনা যাচ্ছে।
এদিকে কোরবানি ঈদে মুক্তির লক্ষে শুটিং চলছে শাকিব খানের ‘ক্যাপ্টেন খান’ ছবিটির। গতকাল সোমবার (৩০ জুলাই) এফডিসির চার নম্বর শুটিং ফ্লোরে ছবির একটি আইটেম গানের শুটিংয়ে অংশ নেন শাকিব। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন অবসরে। আলোচনা করলেন চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক নানা বিষয়ে।
বললেন, দেশে একসময় প্রযোজকের অভাব ছিলো না। প্রতিযোগিতা করে সিনেমা নির্মাণ করতেন তারা। কিন্তু প্রযোজক যেন বিলুপ্ত প্রজাতি। বছরে বেশ কয়েকটি সুপারহিট হচ্ছে। তবুও প্রযোজক আসছে না সিনেমায়। আগে বড় প্রযোজকদের পাশাপাশি কম লগ্নির প্রযোজকও থাকতেন। অনেকে আসতেন যৌথভাবে। কিন্তু এখন তাও নেই। প্রযোজকরা হলেন সিনেমার প্রাণ। তাদের অভাব হলে ইন্ডাস্ট্রির তো খারাপ অবস্থা থাকবেই।
শাকিব বলেন, ‘দেশের সিনেমা দিন দিন শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকছে। কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। কতো সম্ভাবনায় নায়ক-নায়িকা আমাদের ছিলো। কিন্তু তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার মুখে। সিনেমাই হচ্ছে না। যেগুলোও বা হচ্ছে সেগুলো গুণে মানে দর্শককে তৃপ্ত করতে পারছে না। আমাদের এখানকার নির্মাণ বর্তমান যুগকে ধারণ করতে পারছে না। সেজন্য দর্শকও হলে আসছে না। আমিও সম্প্রতি কিছু ছবিতে কাজ করেছি যেগুলো তৃপ্তি দেয়নি আমাকে। যে যতো কিছুই বলুক, আমাদের সিনেমা নির্মাণে কারিগরি দিকের উন্নতি ছাড়া সিনেমার সুদিন কখনোই ফিরে সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজ যখন কলকাতা থেকে সাফটায় আমার ছবিগুলো আসছে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সিনেমা হলে। এই দর্শকই আবার আমি যখন দেশীয় কিছু নির্মাণের ছবি নিয়ে হাজির হই হলে আসছে না। কেন? সোজা পার্থক্যটি হলো নির্মাণের পরিচ্ছন্নতা, রঙিন ফ্রেম, বিনোদনে ভরপুর কোরিওগ্রাফি, গল্প ও চরিত্রে বর্তমান যুগকে ধারণ করতে পারছে কলকাতার ছবিগুলো। দেশের দর্শক ভালো সিনেমা দেখতে চায়। আমরা তাদের চাহিদা মেটাতে পারছি না। উল্টো বলছি দর্শক হলে আসে না। এদেশের দর্শকের দুর্ভাগ্য যে নিজের দেশের নায়ককে তাদের আমদানি করে দেখতে হচ্ছে। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। আমরা যদি এত বিভক্তিতে না গিয়ে নিজেদের কাজের মানটাকে বাড়িয়ে নিতে পারতাম তবে আজকের দিনটা দেখতে হতো না। এখনো সময় আছে, চলচ্চিত্র বাঁচাতে নিজেদের কারিগরি মানের উন্নয়নে মনযোগ দেয়ার। যেমনই হোক, জাজ মাল্টিমিডিয়া কিন্তু সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে উন্নত রুচির পরিচয় দিতে পারছে। তাদের গল্প বাছাইয়ে হয়তো ভুল হয়, শিল্পীদের কম্বিনেশনটাও খুব একটা ভালো বলা যাবে না। কিন্তু তারা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালো সিনেমা দিতে পারছে দর্শকদের।’
তিনি আরও বললেন, ‘আবার যারা টেলিভিশন নির্মাণ থেকে চলচ্চিত্রে আসছেন তারাও কিন্তু সফল হচ্ছেন। কারণ তারা টেকনোলজির সঙ্গে যুগের মেলবন্ধন ঘটাতে পারছেন। ‘আয়নাবাজি’ সুপারহিট, ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সুপারহিট হয়েছে সেগুলোর নির্মাণ মান আন্তর্জাতিক লেভেলের ছিলো বলেই। অনেকেই বলেন যে দিনদিন টিভি মিডিয়ার প্রাধান্য বাড়ছে চলচ্চিত্রে। সামনে ওদের হাতেই ইন্ডাস্ট্রির নেতৃত্ব চলে যাবে। হতে পারে। কারণ দিনশেষে দর্শক ভালো ছবি চায়। যারা সেটা নিশ্চিত করতে পারবেন তারাই টিকে থাকবেন, সামনে থাকবেন। তৌকীর ভাই, ফারুকী ভাইয়েরা ভালো ছবি বানান। একটা শ্রেণিকে তারা হলে টানেন। রুচির পরিবর্তন হচ্ছে এখন সবখানে। দিনে দিনে ভিন্ন ভাবনার সিনেমারও দর্শক বাড়ছে।’
মৌলিক গল্পের অভাবে ভুগছে ইন্ডাস্ট্রি, এই দাবিতে শাকিব খান বলেন, ‘অনেকেই ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে সমালোচনা করেন নতুন শাকিবও আগের মতো নকল ছবি করে। প্রথমত, ওগুলো নকল নয়। রিমেক। রিমেক আগেও হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ঢাকাতেও হতো, কলকাতাতেও হতো। একটা সময় রিমেক ছবি করাতে সেরা ছিলাম আমরা। বলিউডের মূল ছবির থেকেও বেশি ভালো ছিলো আমাদের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিগুলো। কিন্তু এখন আর পারছি না। কেন সেই কারণটা কেউ কী ভাবি? আজকাল কলকাতায় বাণিজ্যিক যেসব ছবি হচ্ছে সেগুলোর প্রায় সবই কোনো না কোনো ছবির রিমেক। আমার ছবিগুলোও তাই। ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে মুক্তি অপেক্ষায় থাকা ‘নেকাব’ ছবিটিও রিমেক। ছবিটি কিন্তু দারুণ বানিয়েছেন পরিচালক। অনেকে তো বলছেন যে এই ছবিটি মূল ছবির চেয়েও ভালো হয়েছে। কলকাতায় বর্তমানে ভেঙ্কটেশ বিশাল ও জনপ্রিয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। তারাও রিমেকে যাচ্ছে। কারণ মৌলিক গল্পের অভাব। আমাদের দেশেও মৌলিক গল্প নেই। ভালো গল্পকার নেই।’
এই অভিনেতা বলেন, ‘একসময় সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, আমজাদ হোসেন, আহমদ জামান চৌধুরীদের মতো মেধাবী ও গুণী মানুষেরা সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। কিন্তু তাদের কেউ কেউ আজ নেই আমাদের মাঝে, কারো আবার বয়স হয়ে গেছে। চাইলেও লিখতে পারেন না। ছটকু আহমেদ, জাকির হোসেন রাজু ভাইও দারুণ চিত্রনাট্য করেন। কিন্তু তারাও আর আগের মতো করে সময় দিতে পারছেন না। বাধ্য হয়েই রিমেক ছবি করতে হয়। আমাদের ভালো গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার প্রয়োজন। হয়তো অনেকে আছেন, ভালো সম্মান ও সম্মানির অভাবে নিজেদের এই লাইনে আনতে চান না। তাদের উৎসাহিত করতে হবে। সিনেমায় মেধার অনেক অবমূল্যায়ণ হয়, এটা মিথ্যে নয়। কিন্তু আমাদের খুব দ্রুত উপলব্দি করতে হবে যে সৃষ্টিশীলতার জায়গাটি মজবুত হলে ভালো চলচ্চিত্র বানানো সহজ হয়ে যায়।’
‘নাকাব’ ছবিটি ঈদে মুক্তির সম্ভাবনা আছে কী না এই প্রশ্নের জবাবে শাকিব খান বলেন, ‘কলকাতায় ছবিটি ঈদেই মুক্তি পাবে। তবে বাংলাদেশে পাবে কী না আমি নিশ্চিত নই। যারা এটা আমদানি করতে যাচ্ছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। সবাই জানেন, আদালতের একটি রুল জারি হয়েছে ঈদ উৎসবে বিদেশি ছবি মুক্তি পাবে না। সুতারাং এখানে কিছু আইনি জটিলতা আছে। আমদানিকারকেরা যদি সেই জটিলতা কাটাতে পারেন তবে বাংলাদেশেও ঈদে মুক্তি পেতে পারে ছবিটি।’
ক্যাপ্টেন খান নিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোদমে কাজ চলছে। ভালো একটি গল্প আছে এখানে। নির্মাণটাও ভালো হচ্ছে। আশা করছি ছবিটি ঈদে খুব ভালো ব্যবসা করবে।’
নতুন ছবির কাজের ব্যাপারে শাকিব খান জানান, অমিতাভ রেজার ‘রিক্সা গার্ল’ ছবিতে কাজ করবেন। শাহীন সুমনের ছবিটির শুটিংয়েরও প্রস্তুতি চলছে। কলকাতার কিছু ছবি নিয়েও চলছে আলোচনা। তবে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ নিয়ে জাজ মাল্টিমিডিয়ার ছবিগুলোতে শাকিব খানকে দেখা যাবার আলোচনাটি স্রেফ গুঞ্জন বলেই দাবি করলেন শাকিব।
এলএ/পিআর