রানী সরকার : বেদনাময় এক ভালোবাসার নাম
আজ বলা যতোটা সহজ হচ্ছে, রানী সরকারের শুরুটা অতো সহজ ছিল না। ষাট দশকের বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারের একজন মেয়ে হয়ে সিনেমায় আসাটা রীতিমতো আকাশ কুসুম কল্পনার ব্যাপার। সেই অসাধ্যও সাধন করেছিলেন রানী সরকার।
নিজের অভিনয়ের ইচ্ছেটাকে তিনি ঘুড়ি বানিয়ে উড়িয়েছিলেন স্বপ্ন জয়ের আসমানে। পেরিয়ে গিয়েছিলেন সমাজ, প্রতিকূল পরিবেশ। ত্যাগ করেছিলেন অনেক অনেক। তৈরি করে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে নারীর জয়গানের আলোকিত এক পথ। সেই ত্যাগ আর আলোকিত পথ ধরেই এসেছিলেন কবরী, শাবানা, ববিতা, শাবনূর, মৌসুমীরা।
চলচ্চিত্রে নারীর জাগরণে রানী সরকার ও তার মতো অভিনেত্রীদের গুরুত্ব তাই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অপরিসীম। কোনোদিন সেই গুরুত্বে মরিচা ধরবে না, ধরতে পারবেও না।
এভাবেই শিল্পীরা শিল্পের জন্য পুরো একটা জীবন বিলিয়ে দেন। বিনিময়ে মেলে নাম-ডাক, যশ-খ্যাতি। সবার ভাগ্যে খ্যাতি মেলেও না। সেদিক থেকে ভাবলে রানী সরকার শুধুমাত্রই এক ভালোবাসার নাম। অভিনয় জীবনে একটা যুগের সিনেমাপ্রেমীদের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। আর কিছুই নয়।
প্রায় শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাই ছিল আলোচিত। তবে কষ্টের ব্যাপার হলো সরল রেখা হয়ে কাটেনি তার জীবনটা। শেষ জীবনে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে।
অথচ অভিনয়ের জন্য পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার পরিবার বলতে ছিল এই চলচ্চিত্র। বিয়েও করেননি এই অভিনেত্রী। কিংবদন্তিতুল্য অভিনেত্রী রানী সরকার অসুস্থ হয়ে ছিলেন অনেক দিন। শেষ জীবনে বার্ধক্যের কারণে নুয়ে পড়েছিলেন। অভাব অনটনের দিনগুলোতে ডাক পেতেন না অভিনয়ের জন্যও।
তবে সরকারের সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। তার সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অসুস্থ অভিনেত্রী রানী সরকারকে ২০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে শিল্পী বান্ধব এই সরকার। এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে আবার সরকারি তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকার চেক দেন প্রধানমন্ত্রী। তার অসুস্থতা ও দুর্ভোগের কথা শুনে তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে নগদ ৫০ হাজার টাকা দেন। এ ছাড়া তার বাসার জন্য গণভবন থেকে দুই বস্তা চাল, কিছু মাছ ও শাক-সবজি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোবাসার কথা বলেছেন ভেজা নয়নে, সাংবাদিক-পরিচিতদের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকেই জীবনের খানিকটা পরিবর্তন দেখেছিলেন রানী সরকার। কিছু কাজও করেছিলেন নাটকে।
রানী ছিলেন ষাট ও সত্তর দশকের খল-অভিনেত্রী। নেতিবাচক চরিত্রে তার উপস্থিতি দর্শকদের আনন্দ দিয়েছে। রানী সরকারের জন্ম সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ থানার সোনাতলা গ্রামে। তার আসল নাম মোসাম্মৎ আমিরুন নেসা খানম। তার বাবার নাম সোলেমান মোল্লা এবং মায়ের নাম আছিয়া খাতুন।
১৯৫৮ সালে রানী সরকারের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এ জে কারদার পরিচালিত 'দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার এহতেশামুর রহমান পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র 'চান্দা'তে অভিনয় করেন। ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।
৮৬ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী বার্ধক্য ছাড়াও পিত্তথলির পাথর, বাতজ্বর, জটিল কোলেলিথিয়েসিস রোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। শনিবার (৭ জুলাই) ভোর ৪টার দিকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রানী।
শনিবার দুপুরে এফডিসিতে শেষ বিদায় জানাবেন প্রিয় সহর্মীরা। এফডিসিতে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর এখানেই রাখা হবে তার শিল্পীপরিবারের প্রিয় মানুষেরা শ্রদ্ধা নিবেন করবেন শেষবারের মতো। বিকেলে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন সম্পন্ন হবে।
দিন ফুরায়। ফুরায় বেদনারও ক্ষণ। সবকিছুর বাইরে এখন তিনি। প্রয়োজন পড়বে না কারো ভালোবাসা, যত্নআত্তি, দেখাশোনার। তিনি এখন অন্য ভুবনের বাসিন্দা। চোখের অদেখায় ভালো থাকুন রানী সরকার। আপনার কথা আমরা মনে রাখবো।
এমএবি/এলএ/আরআইপি