ভিন্ন ভাবনায় মুগ্ধতার ছবি ‘কমলা রকেট’
ঈদ উপলক্ষে মুক্তি পেয়েছে পাঁচ টি ছবি যার মধ্যে তিনটি ছবিরেই নায়ক শাকিব খান। ঈদে শাকিব অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে আছে 'সুপার হিরো', 'চিটাগাইংয়া পোয়া নোয়াখাইল্যা মাইয়া' ও 'পাংকু জামাই'। অপরদিকে রয়েছে সিয়ামের 'পোড়ামন ২' এবং তৌকির আহমেদ ও মোশাররফ করিমের 'কমলা রকেট' ছবি দুইটি। দেখা যাচ্ছে পোড়ামন ২’ কিংবা ‘সুপার হিরো’ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় দর্শকের যেমন উন্মাদনা চলছে ‘কমলা রকেট’ নিয়ে তেমনটি নেই।
এমনটা হওয়ার কারণ কী ? সহজ একটা উত্তর হতে পারে সচরাচর যেমন ভাবনা নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয় তার চেয়ে ভিন্ন ভাবনার সিনেমা ‘কমলা রকেট’। রাজধানীর যমুনা ব্লকবাস্টার ও বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে চলছে ঈদের ছবি ‘কমলা রকেট’। এছাড়াও রাজধানীর কাকরাইলের রাজিয়া সিনেমা হলেও চলছে ছবিটি। তবে এই সিনেমা হলের পরিবেশ ভালো না হওয়ায় ঈদের দিন থেকেই বেশির ভাগ দর্শক যাচ্ছেন যমুনা ব্লকবাস্টার ও বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঈদের দিন সকালে যমুনা কিংবা স্টার সিনেপ্লেক্সে ‘কমলা রকেট’ দেখতে আসা দর্শকের সংখ্যা বেশ সন্তুষজনক ছিলো। তবে ‘কমলা রকেট’ নিয়ে বেশকিছু দর্শককের রিভিউ ছিলো চোখে পড়ার মতো। যারা ‘কমলা রকেট’ ছবিটি হলে গিয়ে দেখেছেন, তাদের বেশিরভাগই ছবিটি নিয়ে তৃপ্ত।
হাসান নামের একজন ছবিটি দেখার পর ফেসবুকে নিজের মতামত জানিয়ে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ছবিটির অনেক বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে এখানে। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো তার ‘কমলা রকেট’ বিষয়ক লেখাটি। হাসান লিখেছেন, ‘ঈদের দ্বিতীয় দিন দেখেছি ‘কমলা রকেট’। সিনেমাটির পরিচালক নূর ইমরান মিঠু। তিনি সরোয়ার ফারুকীর আরেকজন শাগরেদ এবং ভাই বেরাদার গ্ৰুপ এর পুরাতন সদস্য। এর আগে তাকে আমরা অভিনেতা হিসেবে ফারুকীরই ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে দেখেছি। তবে পরিচালক হিসেবে এটাই তার অভিষেক।
সিনেমার কাহিনী শুরু ঢাকা থেকে খুলনাগামী একটা রকেটে। রকেট হলো ব্রিটিশ আমলের স্টীমার, যা কিনা এখনো বুড়ীগঙ্গার বুক চিড়ে চলাচল করছে শত বছরের ঐতিহ্য অটুট রেখে। সেই স্টীমার এ ওঠে নানা পেশার মানুষ। রকেট চলতে থাকে গন্তব্যের দিকে আর সিনেমার কাহিনীও এগিয়ে যায় একই তালে।
শুরুটা কিছুটা ধীরগতির মনে হতে পারে। তার কারণ পরিচালকের পরিচালনায় পরিমিতিবোধ ছিল স্পষ্ট। পরিচালক কিছুই স্পুন ফিড করেননি। পরিচালক তার দর্শককে সম্মান দেখিয়েছেন, ধরে নিয়েছেন তার দর্শকরা বোকা না। সিনেমায় অসংখ্য যাত্রীর গল্প দেখানো হয়েছে। তবে মূল ফোকাস ছিল তৌকির আহমেদের চরিত্রের ওপর।
তৌকির আহমেদ একজন বড় গার্মেন্টস ব্যাবসায়ী। তিনি ওঠেন দোতলায় ফার্স্ট ক্লাস কেবিনে। তার ফ্যাক্টরীতে আগুন লেগেছিল, তার একদিন আগেই, সেটা নিয়ে পুলিশি ঝামেলা এড়ানোই তার এই সফরের মূল উদ্দেশ্য। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে তিনি নাকি ইচ্ছে করেই ইন্সুরেন্স এর টাকার জন্য অগ্নিকান্ড ঘটিয়েছেন।
সেই একই রকেটের নিচতলায় উঠেছেন আরকেজন। যিনি পেশায় একজন অটোরিকশা চালক, চলতি ভাষায় সিএনজিওয়ালা। তার সাথে একটি কাঠের কফিন। কফিনের লাশটি তার স্ত্রীর, যিনি কিনা আগের দিনের ঘটে যাওয়া গার্মেন্টস অগ্নিকান্ডে দগ্ধ হয়েই মারা গেছেন।
রকেটের ওপর তলায় মালিকশ্রেণী, আর নিচতলায় শ্রমিক। দুজনের গন্তব্য একই, তবে তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা কতই না আলাদা। পরিচালক চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের সমাজের বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখিয়েছেন। কর্পোরেশন এর মুনাফার লোভের কাছে যে মানুষের জীবনও বিপন্ন তা বুঝিয়েছেন। একটি শট আছে সিনেমায় যেটা না বললেই নয়। সেখানে আমাদের পঁচে গলে যাওয়া সমাজ থেকে যে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে তা রূপক অর্থ দেখানো হয়েছে। সেই গন্ধ আমাদের উপর তলার মানুষদের নাকে সচরাচর পৌঁছায় না। তবে যখন পৌঁছায় এবং ধনীরা যখন তাদের নিজেদের কৃতকর্মের নোংরা গন্ধ পান তখন যে কি হয় সেটাই তৌকীর আহমেদ কোনো সংলাপ ছাড়া শুধুই অভিব্যাক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন।
মোশাররফ করিমও আছেন একটি মজার চরিত্রে। তবে তার চরিত্রের ব্যাপারে কিছু আগে ভাগে বলা ঠিক হবে না। এটা সারপ্রাইজ থাকুক। শুধু এটুকু বলবো যথারীতি তিনি কমিক রিলিফ ও ড্রামা দুটোই দিয়েছেন। পুরো সিনেমায় শুধু একটাই খারাপ জিনিস ছিল তা হলো আরেকটি পার্শ্ব কাহিনী অথবা সাইড স্টোরি। ওই কাহিনীটা কোথাও যাচ্ছিলো না এবং কেমন যেন আরোপিত মনে হচ্ছিল। অভিনেতারাও কিছু কিছু জায়গায় অতি অভিনয় করছিলেন, হয়তো এই অংশের কাহিনী ও চিত্রনাট্যের দুর্বলতাই অতি অভিনয়ের কারণ।
পরিশেষে এই বলবো সিনেমাটি যেকোনো চলচ্চিত্র প্রেমীরই ভালো লাগবে। এই চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য অসাধারন। ড্রোন এর কিছু এরিয়েল শট আসলেই মুগ্ধ করার মতো। অনেক স্বল্প বাজেটে নির্মিত হলেও মেকিং এ যত্নের ছাপ ছিল স্পষ্ট। ঢাকা থেকে খুলনা ৪ বার স্টিমারটি যাওয়া আশা করেছে পুরো দুই ঘন্টার চলচ্চিত্রটি চিত্রায়ন এর জন্যে। পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার, অভিনেতা সবাই তাদের সেরাটা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আর এই সিনেমার মাধ্যমে যে আমরা একজন সম্ভাবনাময়ী পরিচালক পেলাম তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ ও ‘সাইপ্রাস’ নামের দুটি গল্প অবলম্বনে ‘কমলা রকেট’-এর চিত্রনাট্য করেছেন শাহাদুজ্জামান ও নির্মাতা নূর ইমরান মিঠু। ছবির গল্পে ‘কমলা রকেট’ মূলত একটি স্টিমারের নাম। ছবিতে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, মোশাররফ করিম, জয়রাজ, সামিয়া সাঈদ, সেওতি, ডমিনিক গোমেজ, বাপ্পা শান্তনু, সুজাত শিমুল, শহীদুল্লাহ সবুজ,আবু রায়হান রাসেল।
আইএন/এমএবি/পিআর