সত্যিকারের এক নায়কের নাম অনন্ত জলিল
নায়ক তো দেশে দেশেই অনেক হয়। পর্দা কাঁপানো, ভুবন মাতানো সব নায়ক। কিন্তু সেইসব নায়কদের কজয়জনের ব্যক্তিজীবন অনুপ্রেরণার? উৎসাহ দেয় মানুষকে? সেই তালিকা করতে বসলে খুব বেশি কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং অনিয়ন্ত্রিণ জীবন যাপন, রুচিহীন জীবনবোধ, বেপরোয়া আচরণে বিদ্ধ নায়কের অনেক লম্বা তালিকা করা যাবে।
বিশেষ করে ঢালিউডের ষাট বছরের চলচ্চিত্র ইতিহাসে মন ও মানবিকতার গল্পে মুগ্ধ করার মতো নায়ক খুব কম। সেই তালিকায় শীর্ষ নাম হয়ে আছেন সুপারস্টার অনন্ত জলিল। কিন্তু খেয়ালী। নিজের যা ভালো লাগে তাই করেন। সেই ভালো লাগা চারদিকে কতোটা হাসির উদ্রেক করলো সে নিয়ে ভাবেন না। বিশাল তার ভাবনা। চিন্তা করেন অনেক উঁচুতে। নায়ক হিসেবে তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন টম ক্রুজকে, বোঝা যায় অনুসরণও করেন তাকে। নিজের মতো করে চলতে পছন্দ করেন তিনি এমন কথাই শোনা যায়া চলচ্চিত্র পাড়ায়।
আত্মশক্তিতে বলীয়ান বলেই দক্ষতা নিয়ে সামলাতে পারছেন ব্যবসায়ের বিশাল সাম্রাজ্য। যেখানে গার্মেন্টস সেইসঙ্গে মেইনটেইন করেন তারকাখ্যাতি। গেল বছর থেকে যোগ হয়েছে ধর্ম-কর্মের ব্যস্ততাও। স্রেফ মনের জোরেই সামলে নিতে পারেন তিনি।
২০১০ সালে অনেকটা ধুমকেতুর মতোই আবির্ভূত হয়েছিলেন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে। ‘খোঁজ দ্য সার্চ’ চলচ্চিত্র দিয়ে। এই সিনেমাটিই বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল সিনেমা। হলিউডি স্টাইলে অ্যাকশন, চমৎকার ভিডিওগ্রাফি, মনে দাগ কাটার মতো গান দিয়ে সেই ছবি বাজিমাত করে দিয়েছিলো।
আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন অনন্ত জলিল। দর্শক তাকে পর্দাতে দেখতেই আনন্দ পেতেন, বিনোদিত হতেন। সিনেমা দিয়ে দর্শক হলে টানা বা দর্শক বিনোদিত করার যে মূল ভাবনা সেখানে সফল অনন্ত জলিল। তিনি যেখানে যান সেখানেই মানুষের জট বাঁধে, যা বলেন তা নিয়েই আলোচনা হয়। রাতারাতি নামের পাশে যোগ হলো সুপারস্টার খ্যাতি।
অনন্ত মন্দার চলচ্চিত্রে আশার বৃষ্টি ঝড়িয়ে এলেন। সিনেমার বাজেট দিয়ে তিনি চমক দেখালেন। সংলাপে আনলেন হাস্যরস। একের পর এক হিট ছবি দিলেন। বেশ ক’জন সিনিয়র অভিনয়শিল্পীকেও তিনি ফিরিয়ে আনলেন ইন্ডাস্ট্রিতে স্বমহিমায়। দুই হাত উজার করে দিলেন চলচ্চিত্রের উন্নয়নে। এফডিসির মেকাপ রুমগুলোতে মোজাইক বসিয়েছেন, ভূমিকা রেখেছেন কাঠামোগত কিছু উন্নয়নে। চলচ্চিত্রের অসহায় মানুষদের সাহায্য করেছেন আড়ালে-নিরবে।
আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজ তিনি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভুল মানুষের সান্নিধ্য ও পরামর্শে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে যেন সরিয়ে নিলেন অনন্ত। তিন বছর পার হতে চললো তার নতুন কোনো ছবি নেই। একটি ছবির ঘোষণা দিয়েও সেটি আর শুরু করছেন না। এর কারণ হিসেবে অনেক কথাই শোনা যায়।
কেউ কেউ বলে চলচ্চিত্রে নোংরা রাজনীতি দেখেই নিজেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন অনন্ত জলিল। কেউ কেউ দাবি করেন, হল দখলের যে বাজে সংস্কৃতি চলছে বর্তমানে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেন না বলেই আর সিনেমা করছেন না অনন্ত। তবে এই সুপারস্টারের ঘনিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এমন কিছুই নয়। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার চাপ বেড়েছে তার। স্ত্রী বর্ষা ও দুই পুত্রকেও সময় দিতে হয়। পাশাপাশি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর জন্যই চলচ্চিত্রে সময় দিতে পারছেন না অনন্ত জলিল। তবে অনন্ত জলিলকে চলচ্চিত্রের জন্য যথোপযুক্তভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা যে করেনি ইন্ডাস্ট্রি সেটাও বোঝা যায়। কেউ কেউ তো বলে থাকেন, অনন্ত’র চলচ্চিত্র থেকে দূরে যাওয়াটা ‘লক্ষী’ হারানোর মতোই ব্যাপার। সিনেমা হলে ডিজিটাল মেশিন নিয়ে আজ রোজ রোজ যে হাহাকারের কথা ভেসে বেড়ায়, অনন্ত জলিল চাইলেই সেটা মিটিয়ে দিতে পারতেন।
সে যাই হোক, সিনেমা না করেও আলোচনার শীর্ষে অনন্ত জলিল। কোনো হিট সিনেমা মুক্তি না দিয়েও আসল নায়ক তিনি। আর সেটি তিনি সম্ভব করেছেন তার বিশাল হৃদয়ের বদৌলতে। ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ কয়েকবার সিআইপি নির্বাচিত হওয়া অনন্ত জলিলের আরেকটি পরিচয় রয়েছে; তিনি দানবীর। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে কখনোই পিছপা হন না তিনি। নিজের একান্ত ইচ্ছায় আন্তরিকতা নিয়ে কারো শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, কারোর চাকরির ব্যবস্থা করেন, মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানায় অকাতরে দান করেন নগদ অর্থ। বন্যার সময়গুলোতে দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যখন আয়োজন করে ভাবতে ভাবতে দিন পার করে, তখন তাকে দেখা গেছে হেলিকপ্টার নিয়ে ছুটে গেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। খাবার আর পোশাক নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বানভাসী মানুষের পাশে।
মানবিকতার বিপর্যয়ের এই যুগে সমাজে উদারতার দৃশ্যগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমন সময়ে অনন্ত জলিল নিজেকে জিইয়ে রেখেছেন মানুষের বিপদে। সম্প্রতি তিনি আলোচনায় এসেছেন বাসের চাপায় হাত হারানোর পর অকাল প্রয়াত রাজীবের দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিয়ে। তিনি রাজীবের দুই ভাইয়ের শিক্ষা, চিকিৎসা ও ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার ঠিক একদিন পরই তিনি পাঁচ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের চাকরির ব্যবস্থা করবেন বলে ঘোষণা দেন।
বলা হয়ে থাকে সমাজ সেবা বা মানবসেবা মানুষকে দেখিয়ে করতে নেই। এজন্য কেউ কেউ অনন্ত জলিলের এইসব কার্যক্রমের সমালোচনাও করেন। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা মানসিকভাবে দুর্বল, নিচ; তারাই এমন কাজের সমালোচনায় লিপ্তে হতে পারে। ভালো কাজ সেটা সবসময়ই ভালো। আড়ালেও ভালো, প্রকাশ্যেও ভালো। ব্যক্তি মন্দের সমালোচনা হোক, কিন্তু তার ভালোটুকু সমাজের কাছে উৎসাহের হয়ে থাকুক। যারা এই সমাজ ও পাশে পড়ে থাকা না খাওয়া মানুষটার জন্য কিছুই করতে পারছি না তারা কোন মুখে তার সমালোচনা করবো যে সেই সমাজ ও মানুষটির মাথায় হাত রাখতে পারছে? তাই দেশজুড়ে অনন্ত জলিলের বন্দনা চলে। সবখানেই প্রশংসিত হন তিনি মানবসেবার জন্য।
চলচ্চিত্রে অনন্ত জলিল কতদিন বেঁচে থাকবেন সে নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু সুন্দর মন ও মানবিকতার একজন সত্যিকারের নায়ক হিসেবে অনন্ত জলিলের নাম থেকে যাবে। তার ও তার পরিবারের জন্য শুভকামনা।
এলএ/জেআইএম