কে হবেন রাজিব-ডিপজল আর মিশাদের যোগ্য উত্তরসূরী?
চলচ্চিত্র জীবনের কথা বলে। মানুষের নিত্য দিনের বৈচিত্রময় ঘটনাগুলোই উঠে আসে চলচ্চিত্রের রঙিন ফ্রেমে। সেখানে যেমন দেখা যায় ভালো মানুষদের জয় জয়কার তেমনি মন্দ মানুষেরাও হাজির থাকেন গল্পকে সত্যিকার রুপ দান করতে। এইসব মন্দ চরিত্রে অভিনয় করা চরিত্ররা চলচ্চিত্রে ভিলেন বা খলনায়ক হিসেবে পরিচিত।
ষাট বছরের চলচ্চিত্র ইতিহাস ঘেঁটে একদিকে যেমন আনোয়ার হোসেন, শওকত জামিল, বুলবুল আহমেদ, রাজ্জাক, ফারুক, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল, রুবেল, সালমান শাহ, রিয়াজ, মান্না, শাকিবদের মতো নায়কদের সাফল্যের সুবাস পাওয়া যায় তেমনি গোলাম মোস্তফা, খলিল, এটিএম শামসুজ্জামান, রাজিব, হুমায়ূন ফরীদি, সাদেক বাচ্চু, অমল বোস, আহমেদ শরীফ, মিজু আহমেদ, জাম্বু, নাসির খান, কাবিলা, ইলিয়াস কোবরা, ডিপজল, ডন, মিশা সওদাগরের মতো ভিলেনদের দুর্দান্ত জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে।
কখনো কখনো নায়ক বা ভালো চরিত্রের অভিনেতারাও ভিলেন হয়ে হাজির হয়েছেন। উল্লেখ করা যায় অমিত হাসান, ওমর সানীর নাম। আবার ভিলেন থেকে নায়ক হয়েও জনপ্রিয়তা পাওয়া অভিনেতার নাম ডিপজল। চিত্রনায়ক জসীমও ভিলেন হয়েই অভিষিক্ত হয়েছিলেন চলচ্চিত্রে। আর পপগুরু আজম খানের নামও ভিলেন হিসেবে ঢাকাই ছবিতে যুক্ত হয়ে আছে ‘গডফাদার’ ছবিতে। শখের বশে ‘গুরুভাই’ নামের ছবিতে রহস্যময় একটি ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নন্দিত গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
শুধু পুরুষই নয়, নারী খল-অভিনেত্রী হিসেবে রওশন জামিল, রিনা খান ঢাকাই ছবিতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। আবার কখনো কখনো ভালো চরিত্রের অভিনেত্রীরাও হাজির হয়েছেন মন্দ চরিত্রে। আনোয়ারাকে দেখা গিয়েছিলো সালমান-মৌসুমীর ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমায় নেতিবাচক এক প্রভাবশালী নারী চরিত্রে। ফেরদৌসী মজুমদার শক্তিশালী অভিনয় করেছিলেন সালমান-শাবনাজের ‘মায়ের অধিকার’ সিনেমায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এইসব মন্দ চরিত্ররা সিনেমায় প্রাণ দিতেন। দর্শকের মনে প্রচন্ড ঘৃণা আর ক্ষোভ তৈরি করে হলে বসিয়ে রাখতেন শেষ পরিণতি দেখার জন্য। তবে আফসোসের বিষয় হলো দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাই চলচ্চিত্র সাফল্যের তাল হারিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে সিনেমার গল্প ও নির্মাণ। দীর্ঘদিন ইন্ডাস্ট্রি হেঁটেছে এক নায়ককে কেন্দ্র করে সিনেমা নির্মাণের অদ্ভূত চর্চায়। কেউ চেষ্টা করতেন না ভিন্ন কিছুর, বৈচিত্রময় কিছুর। স্বভাবতই উপেক্ষিত ছিলো নায়ক-নায়িকার বাইরে অন্য চরিত্ররা। উপেক্ষিত ছিলেন মেধাবীরা। ভিলেন হিসেবে প্রায় সব ছবিতেই একতরফাভাবে মিশা সওদাগরকে দেখা গেছে গৎবাঁধা সংলাপ আর চরিত্রে। সেই চর্চার খেসারত দিচ্ছে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি।
ডিজিটাল চলচ্চিত্রের রঙিন উপাধি মুকুটে নিয়ে তাল মেলাতে পারছে না বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে। মেধাবীদের নিরবতায় মরচে পড়েছে ভালো গল্প ও নির্মাণের মুন্সিয়ানায়। তবে দারুণ ক্ষতিটা হয়ে গেল ‘খলনায়ক’ জায়গাটিতে। রাজিব-ফরীদি-ডিপজলদের উত্তরসূরী হিসেবে মিশা সওদাগর সফল হলেও তার পরবর্তীতে উল্লেখ করার মতো কোনো নাম নেই।
খলনায়ক সংকটের বীজটা বপন হয় নায়ক মান্নার মৃত্যু ও রিয়াজ-ফেরদৌসের বাণিজ্যিক সিনেমা থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর থেকেই। একটা সময় ভিলেন চরিত্রে ডিপজল ছিলেন দুর্ধর্ষ। নায়ক মান্নার সঙ্গে তার জুটি ছিলো সুপারহিট। রিয়াজ-আমিন খানদের সঙ্গেও তিনি বেশ কিছু হিট ছবি উপহার দিয়েছেন। তবে মান্নার মৃত্যুর পর ডিপজল বদলে নেন নিজের ইমেজ। তিনি ‘চাচ্চু’, ‘দাদীমা’ ইত্যাদি ছবি দিয়ে নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। এরপর আর তাকে ভিলেন চরিত্রে দেখা যায়নি।
এরপরের সময়টা খলনায়ক হিসেবে মিশার উপর নির্ভর করেই প্রায় গত দশ বছর ধরে তৈরি হয়েছে সিনেমা। তার পরের কোনো উত্তরসূরী তৈরি হয়নি। কালেভদ্রে অমিত হাসান, ওমর সানীরা ভিলেন হয়ে কেবল সিনেমার তালিকাই লম্বা করেছেন। বলার মতো সাফল্য বা অভিনয় কোথাও মেলেনি। মন্দের ভালো হয়ে মিশা সওদাগরই ইন্ডাস্ট্রি কাঁধে বয়ে চললেন। ভিলেন হয়ে মিশা পর্দায় হাজির হচ্ছেন কখনো কালো চুলে, কখনো সাদা চুলে। গ্রামে, শহরে, নগরে, বন্দরে যেখানেই চলচ্চিত্রের মন্দ মানুষ প্রয়োজন সেখানেই দেখা মিলে প্রায় নয় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করা শক্তিমান এই অভিনেতার।
নায়ক শাকিব ও খলনায়ক মিশা জুটিতে ইন্ডাস্ট্রি গৎবাঁধা কিছু হিট ছবি পেয়েছে। এতে লাভ হয়েছে প্রযোজক ও শাকিব-মিশা জুটির। কিন্তু আড়ালে অবমূল্যায়িত হয়েছে মেধা ও যোগ্যতার বৈচিত্রতা। সংকুচিত হয়েছে নতুন নতুন নায়ক-ভিলেন তৈরির জায়গাটি। যে নির্মাতাদের বলা হয় তারকা নির্মাণের কারিগর তাদের বেশিরভাগ সফল নির্মাতাই নানা অভিমান-অভিযোগ মনে নিয়ে সরে গেলেন চলচ্চিত্র থেকে। যারা রইলেন তারা নিজেদের আবদ্ধ করে রাখলেন শাকিব-মিশা জুটিতেই। তাদের বেশিরভাগ ছবির নায়িকা হিসেবে রইলেন অপু বিশ্বাস।
আর আজকের এই অবস্থানে এসে দেখা যাচ্ছে নায়ক-নায়িকা সংকটের পাশাপাশি খলনায়কের সংকটও চলছে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে। এর কারণ চলচ্চিত্রের স্বর্ণালী যুগের পর্দা কাঁপানো খলনায়কদের অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন, আবারও কেউ চলচ্চিত্র থেকে দূরে রয়েছেন। আর নতুন যারা কাজ করছেন তারা অধিকাংশই জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন যোগ্য মূল্যায়ণে অভাবে, প্রাণহীন ও গুরুত্বহীন চরিত্রে অভিনয়ের কারণে। একটা সময় ভিলেনরা হয়ে উঠতেন ছবির মূখ্য চরিত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল সেটা সাপের পাঁচ পা দেখার মতোই একটি ব্যাপার। ফলে অবহেলিত থাকা খল চরিত্রে কোনো ভালো অভিনেতারা আগ্রহ দেখান না। নির্মাতারাও নতুনদের সুযোগ করে দেয়ার নাম করে যাকে তাকে সিনেমার অভিনেতা বানিয়ে দিচ্ছেন। তারা আসছেন কিন্তু ঠিকছেন না যোগ্যতা ও সঠিক পরিচর্যার অভাবে।
সর্বশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে তাসকিন রহমানের নাম। যিনি ভিলেন হিসেবে দারুণ একটা চমক দেখিয়েছেন ঢাকাই সিনেমায় ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবি দিয়ে। তবে তার ভবিষ্যত নিয়েও রয়েছে শংকা। প্রথম কারণ তার চেহারা। অনেকেই দাবি করছেন নির্দিষ্ট একটা ফরম্যাটে দুর্দান্ত খল অভিনেতা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী নীল চোখের যুবক তাসকিন। কিন্তু তাকে রাজিব-ফরীদি-মিশাদের মতো বৈচিত্রময় চরিত্রে ব্যবহার করাটা হবে কষ্টের। কারণ গ্রামের চরিত্রগুলোতে তাকে শহুরে চরিত্রগুলোর মতো মানানসই লাগবে না। তবে অনেকে আবার দাবি করছেন, নির্মাতাদের মুন্সিয়ানার ছোঁয়া পেলে ঠিকই নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন তাসকিন।
এর পরে তরুণ প্রজন্মের খলঅভিনেতাদের মধ্যে কেউ কেউ দুই-একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হলেও শক্ত করে নিজের আসনটি ধরে রাখতে পারছেন না তারা। এ তালিকায় আছেন শিবা শানু, শিমুল খান, ডিজে সোহেল, টাইগার রবি, জিয়া ভিমরুল। পুরনো ডন অনেকটা সময় নিরবে থেকে ফিরে এলেও সালমান-ডনের মতো সুপারহিট জুটিও গড়তে পারেননি, তেমন উল্লেখ করা ছবিও দিতে পারেননি।
কেন নতুন করে কেউ জ্বলে উঠতে পারছেন না? জবাবে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, অভিনয়ের প্রয়োজনে ভিলেনদের চলচ্চিত্রের পর্দায় বিচিত্র রূপ ধারণের পাশাপাশি কঠিন কঠিন কাজ করতে হয়। তাই খলচরিত্রে অভিনয় করতে হলে দক্ষ অভিনয়শিল্পী হওয়া আবশ্যক। কেননা, এককালে যারা খল চরিত্রের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তারা প্রত্যেকেই ছিলেন দুর্দান্ত অভিনেতা। গোলাম মুস্তাফা, রাজীব, খলিল, আহমেদ শরীফ, এটিএম শামসুজ্জামান, সাদেক বাচ্চুরা এই দেশের চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র। অভিনয় দিয়ে তারা সমৃদ্ধ করে গেছেন অভিনয়ের আঙিনাকে। সেই মাপের অভিনেতা এখন কই? আর তেমন অভিনেতা তৈরির প্রচেষ্টাও নেই। একটু ভালো অভিনয় করলেই তাকে ভাবা হয় নায়ক বা নায়কের ভাই-শালা চরিত্রে। ভিলেন চরিত্রগুলো বরাদ্দ রাখা হচ্ছে তুলনামূলক একটু দুর্বল অভিনেতাদের জন্য। আর শিমুল খান, শিবা শানুর মতো দক্ষ অভিনেতারা শক্তিশালী ভিলেন হওয়াটাকে ক্যারিয়ারের লক্ষ করে নিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নতুনদের আগ্রহ থাকে নায়ক হওয়ার দিকেই। তাই এই জায়গাটিতে দিনে দিনে শূন্যতা বাড়ছেই। আর নারী ভিলেন তো আজকাল দেখাই যাচ্ছে না।
ভিলেন সংকটের বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বলিউল আলম খোকন বলেন, ‘সবাই চলচ্চিত্রে এসে নায়ক-নায়িকা হতে চায়। কেউ খলনায়ক বা খলনায়িকা হতে চান না। কিন্তু তারা যদি এ চরিত্রে এসে ভালো অভিনয় করেন, তাহলে দর্শক তাদেরও চিনবে। তাদের নামের ওপর ভিত্তি করে দর্শকরা হলে গিয়ে ছবি দেখবে। নতুন যারা আসবে, তারা তো একদিনে এসে এ জায়গা দখল করতে পারবে না। সময় নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। তাহলেই কেবল তারা নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আর দক্ষ শিল্পীদেরও ভিলেন চরিত্রগুলোর প্রতি সম্মান রাখা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকদিন বিরতির পর আবারও এফডিসি নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রমটি চালু করতে যাচ্ছে। আশা করছি ভিলেন সংকটে এই কার্যক্রম সহায়ক হবে।’
এদিকে চলচ্চিত্র খল নায়ক সংকট নিয়ে চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে খল-অভিনেতার যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা দূর করতে তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে। অভিনয়টাকে মূখ্য করেই তাদের খল-অভিনেতা হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, একটি চলচ্চিত্রে খল-অভিনেতার গুরুত্ব নায়ক-নায়িকার মতোই সমানে সমান। কারণ, তাদের ছাড়া চলচ্চিত্র প্রাণ পায় না।
এলএ/পিআর