কেমন আছেন এটিএম শামসুজ্জামান?
এটিএম শামসুজ্জামান কেমন আছেন এখন? তিনি কি অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন? বার্ধক্য জনিত কারণে আর অভিনয় করা সম্ভব হচ্ছে না? এমন কিছু প্রশ্ন মিডিয়া পাড়ায় ভাসছিল কয়েক দিন থেকে। গত বছরের আগস্ট মাসে একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অভিনেতার একটি চোখের অস্ত্রোপচার হয়। তার পর খুব বেশি অভিনয়ে দেখা যায়নি তাকে। তাহলে কি অভিনয় ছেড়েই দিলেন বর্ষিয়াণ এ অভিনেতা।
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে জাগো নিউজ তার বর্তমান সময়ের খেরো খাতা তুলে আনার চেষ্টা করল। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল তার সবকটা ফোন নাম্বারও বন্ধ। পথ খোলা ছিল একটাই, তার বাড়ি যাওয়া। সোমবার দুপুরের আগে পুরান ঢাকার সুত্রাপুরে তার বাসায় হাজির হয়ে পাওয়া গেল তার ভালো থাকার খবর।
এর আগেই কথা হয় এটি এম গলির সামনে এক পানের দোকানদারের সঙ্গে। তার নাম মো. আলেক। কথা হয় তার সাথে। তার কাছে এটিএম শামসুজ্জামানের বাসা কোনদিকে জানতে চাইলে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন, ‘ওই যে কালো রঙের বিল্ডিংটা দেখছেন, তার পেছনের বাড়িটা।’ উনি কি এ রাস্তায় হাঁটা হাঁটি করেন? আলেকের জবাব, ‘হ্যাঁ’। তারপর বললেন, ‘তবে গেল কয়েকদিন ধরে থেকে তাকে দেখছি না।’
নন্দিত এ অভিনেতার বাড়ির কাছে গিয়েও মনে হলো, উনি বাড়িতে আছেন তো! ভালো আছেন তো! না আর দেরি নয় গলি ধরে হেঁটে গিয়ে সোজা দরজায় নক। ঠক ঠক ঠক। অনেকক্ষণ নক করার পরেও দরজা খোলার কোনো লক্ষণ না দেখে হতাশ হয়ে ফিরে আসার সময়েই বাড়ির ভেতর থেকে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। কেউ একজন হেঁটে আসছেন দরজার দিকেই।
দরজা খুলতে দেখা গেল যার খোঁজে গেল কয়েকদিনের খাটুনি সেই প্রিয়মুখ, শ্রদ্ধার মানুষ এটিএম শামসুজ্জামান নিজেই দাঁড়িয়ে আছেন। বাইরে আসতে গিয়েই দরজার সাথে মাথায় চোট পেলেন। কিছুটা লেগেছে। সামলে নিলেন নিজেকে।
কথা ছিল বাইরে বেরুবেন। তাই এসছিলেন, কারো দরজায় নক করা শুনে নয়। তার খোঁজেই কেউ এসেছে জেনে বাসার ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসলেন। আলাপে আলাপে মনে জমে থাকা কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। তবে সেরা খবরটি হলো, শারীরিক নানা প্রতবন্ধকতার পরও বেশ ভালো আছেন এটিএম শামসুজ্জামান।
হাসি মুখেই জানালেন তার বর্তমান সময়ের কথা। জনপ্রিয় এই অভিনেতা বললেন, ‘অভিনয় ছেড়ে দিয়েছি বিষয়টি তা নয়। কিন্তু কমিয়ে দিয়েছি। পছন্দ না হলে ফিরিয়ে দিচ্ছি নির্মাতাদের। সেইসব নাটক-সিনেমাতেই অভিনয় করবো যেগুলো নিজের কাছে ভালো লাগবে। নির্মাতা ভালো ও ভালো কমিটমেন্ট আছে।’
জানালেন বর্তমানে দুটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করছেন। একটি সাজ্জাদ সুমনের ‘ছলে বলে কৌশলে’ ও অন্যটি রুলিন রহমানের ‘ভালোবাসা কারে কয়’।
এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, ‘৫৪ বছর ধরে অভিনয় করছি। এখন যে নাটকগুলো করছি সেগুলো বেশির ভাগই নাটক নয়। তবে ভালো হচ্ছে না তাও নয়। যেগুলো মন্দের ভালো সেগুলোতে অভিনয় করছি। বর্তামানে যে দুটো নাটকে অভিনয় করছি দুটোর গল্পই ভালো, নির্মাতাও ভালো। ‘নোয়াশাল’ নামের একটি ধারাবাহিকে অভিনয় করছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি। ওইটার আর ধারাবাহিকতা নেই, গল্পেরও জোর বলে কিছু নেই। বিরক্তি লেগে গেল তাই ছেড়ে দিলাম।’
বয়সের কারণে কি কমিয়ে দিয়েছেন অভিনয়? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, অভিনয় বয়সের ধার ধারে না। আসলে, আমার শরীরের চেয়েও বেশি খারাপ এখনকার নাটক-সিনেমার গল্প। তাই অভিনয়ে অনিয়মিত। শরীর খারাপ বলে কাজ করছি না ব্যাপারটি তা নয়। আমার সঙ্গে যায় এমন চরিত্র পেলেই অভিনয় করছি। আমি কাজ করে আনন্দ পাই। এ মাসে সাইদ তারেকের একটি ধারাবাহিকে কাজ করার কথা চলছে। নাম ‘লাইফ পার্টনার ডটকম’। স্ক্রিপ্ট পড়ছি। ভালো লাগলে অভিনয় করবো। কিন্তু ভালো না লাগলে কারো মন রক্ষার্থে আর করবো না।’
এটিএম শামসুজ্জামান। একটি নামই শুধু নয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একটি দুর্দান্ত ইতিহাস। মঞ্চে কাজ করতেন অভিনেতা হিসেবেই। প্রথম দিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন তিনি। এরপর আসেন খল অভিনয়ে। অসংখ্য চলচ্চিত্রে এটিএম শামসুজ্জামানের খল চরিত্রগুলো আজও জীবন্ত।
হাসির ছলে কূটচালে মানুষের ক্ষতি করতে সিনেমার পর্দায় এটিএমের জুড়ি মেলা ভার। তার চরিত্রগুলো চিত্রনাট্যে সেভাবেই লেখা হতো। দীর্ঘ একটা সময় তিনি খল চরিত্রে সিনেমার নির্মাতাদের কাছে সেরা ভরসা হিসেবে ছিলেন।
এরপর তিনি ঝুঁকে পড়েন কৌতুক প্রধান চরিত্রের অভিনয়ে। বেশরিভাগ সময়ই তাকে দেখা যেতে লাগলো হাস্যরসের সংলাপে। ধীরে ধীরে তিনি কমেডি চরিত্রে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গেলেন। সিনেমার পাশাপাশি টিভি নাটক ও টেলিফিল্মেও এটিএম শামসুজ্জামান নতুন করে সারা দেশের মানুষকে বিনোদিত করতে শুরু করেন। চলচ্চিত্র ‘টক জাল মিষ্টি’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘জামাই শ্বশুর’, ‘মোল্লাবাড়ির বউ’, নাটক ‘পত্র মিতালী’সহ অনেক কাজ তার উদাহরণ হয়ে আছে।
এটিএম শামসুজ্জামান ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার ভোলাকোটের বড় বাড়ি আর ঢাকায় থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে। পগোজ স্কুলে তার বন্ধু ছিল আরেক অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে। তারপর জগন্নাথ কলেজ ভর্তি হন। তার পিতা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। মাতা নুরুন্নেসা বেগম। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।
১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর বিষকন্যা চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। প্রথম কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য। ছবির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা, এ ছবির মাধ্যমেই অভিনেতা ফারুকের চলচ্চিত্রে অভিষেক। এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনী লিখেছেন।
অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র পর্দায় আগমন ১৯৬৫ সালের দিকে। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনা আসেন তিনি। ১৯৮৭ সালে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দায়ী কে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তিনি রেদওয়ান রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’তে অভিনয় করেন ও শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধূরির ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এরপর খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তদের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে ২০০৯ সালে প্রথম পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটিকে নিয়ে ‘এবাদত’ নামের একটি ছবি।
অভিনয়-নির্মাতার পাশাপাশি একজন লেখক হিসেবেও এটিএম শামসুজ্জামানও নন্দিত। কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান গল্প, কবিতা লেখারও চর্চা করেছেন নিভৃতে।
এমএবি/এলএ/আইআই