সুরের বাগানে এত প্রেম!
আড়বাঁশির ছিদ্র যেন ফেটে যাচ্ছে ফুৎকারে ফুৎকারে। হৃদপিণ্ড থেকে শিরা-উপশিরায় রক্ত প্রবাহিত হয় যেভাবে, ও বাঁশির রাগ সেভাবেই প্রবাহিত হচ্ছে সুর মননের শিরায় শিরায়। বাঁশির রাগে যেন চমকে উঠছে রাগিনী। বাঁশির সুরে যেন থমকে যাচ্ছে রজনী।
নিশি পোহায় পোহায় ভাব তখন। সুপ্রিয়া দাসের ভূবন মাতানো খেয়ালে সবাই বেখেয়ালি প্রায়। খেয়ালের টানে সবাই জগৎভোলা এবেলায়।
পৌষের রাত। কুয়াশা নেই, অথচ মধ্য রাতের পর থেকেই ঝিরি ঝিরি বাতাসে দারুণ ঠাণ্ডা রাজধানীর আবাহনী মাঠজুড়ে। মাঠের বাইরে শীতে প্রায় জবুথবু সঙ্গীতপ্রেমীরা। অথচ মাঠে গিয়েই সুর উত্তাপে শীত তাড়িয়ে/উবে দিচ্ছেন তারা।
রাগের যে উত্তাপ রজনীর প্রথম প্রহরে ছড়ালো, তা ভোরে এসে আরও তীব্র হলো। সুপ্রিয়া দাস চলে যেতেই বাঁশের বাঁশি হাতে মঞ্চের আলোতে রূপ ফেললেন ভারতের প্রখ্যাত বংশীবাদক রাকেশ চৌরাসিয়া। বংশীবাদক পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার ভাগ্নে ও ছাত্র রাকেশের বাঁশিতে মিতালি করতে সঙ্গ দিতে বসলেন পূর্বায়ন চ্যাটার্জি। বাঁশি-সেতারের যখন প্রেম হচ্ছে, তখন মধ্য বেলায় তবলায় ঝড় তুললেন পণ্ডিত অভিজিৎ চ্যাটার্জি।
মনে হচ্ছিল, রাকেশের বাঁশিতে কৃষ্ণের প্রেমোচ্ছাস আর পূর্বায়নের সেতারে রাধার প্রেম বিলাস মিলছে। তাতে তবলা সঙ্গ দিয়ে গোপীদের খুনসুটিতে প্রেম উতরে উঠেছে যেন। আর দু’পাশে দুই তানপুরা বৃন্দাবনের আবহ-ই তৈরি করছিল শুরু থেকে।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭ প্রথম রাতের প্রথম প্রহরেই মাত করেন কাজাখস্তানের অর্কেস্ট্রা। ড. এল সুব্রামানিয়াম আর আসতানা সিম্ফনি ফিলহারমোনিকের অনবদ্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উৎসবের পর্দা ওঠে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। প্রায় অর্ধশত শিল্পীর মনকাড়া এ পরিবেশনা উৎসবের প্রাণ মেলে ধরে। ভায়োলিন হাতে নারী যন্ত্রীরা ক্লাসিক্যাল ঢংয়ে আসর জমিয়ে তোলেন শুরুতেই।
এরপর সরোদ হাতে মঞ্চে আসেন রাজরূপা চৌধুরী। মেরুন রংয়ের শাড়িতে খাঁটি বাঙ্গালিয়ানার রূপ মেলে ধরেন মঞ্চে। সে রূপের ঝলক পড়লো সরোদের ছয়টি তারেও। রাগ ‘অনিল মধ্যম’ দিয়ে ভারতীয় বাঙালি এ রাগশিল্পীর দু’হাতের দশটি আঙ্গুল-ই যেন সুরের বন্দনায় সঞ্চারিত হলো সরোদের তারে তারে। আর তাতে তবলা বাদক পণ্ডিত অভিজিৎও খেললেন অসীম প্রেম নিয়ে। সরোদ আর তবলার মন মাতানো পরিবেশনায় ততক্ষণে শ্রোতারা অন্য ভূবনে।
সরোদ-তবলার মোহ কাটতে না কাটতেই খেয়ালে প্রাণ খুলে দেন ভারতীয় রাগশিল্পী বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকর। তবলা, তানপুরায় প্রেম নিয়ে খেয়ালে খেয়ালে নিজের অসীম প্রতিভা তুলে ধরেন প্রবীণ এ শিল্পী।
আর আসরের মধ্য বেলায় সেতার বাজিয়ে বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গশিল্পী ফিরোজ খান তো উৎসবের পূর্ণতা দিতে থাকলেন। বিভিন্ন রাগে ঘণ্টাব্যাপী সেতার বাজিয়ে অভিজ্ঞ এ শিল্পী সুরের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করছিলেন প্রতিক্ষণে। এরপর বাংলাদেশের আরেক গুণী শিল্পী সুপ্রিয়া দাসও খেয়ালে মঞ্চ মাতালেন।
আসরের নিশি শেষে বাঁশি বাজিয়ে মন হরণ করলো রাকেশ চৌরাসিয়া। নিশি ফুরালো, ভোরের আভাও ফুটলো। কিন্তু অন্তরের সুরালাপ যেন ফুরালো না।
এএসএস/এমআরএম/আরআইপি