অনুষ্ঠান প্রধান ছাড়াই চলছে টিভি চ্যানেল
বর্তমানে দেশে লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর মধ্যে বিনোদনমূলক চ্যানেল হিসেবে এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, এনটিভি, আরটিভি, বৈশাখী টিভি, বাংলাভিশন, একুশে টেলিভিশন, মাছরাঙা টেলিভিশন, দেশ টিভি, জিটিভি, চ্যানেল নাইন, এসএ টিভি, এশিয়ান টিভি, মাই টিভি, দুরন্ত টিভি, আরটিভি, বাংলাভিশন ইত্যাদি চ্যানেলগুলো বেশ জনপ্রিয়।
গেল কয়েক বছর ধরেই লক্ষ করা যাচ্ছে দর্শক হারিয়েছে চ্যানেলগুলো। একটা সময় চলচ্চিত্রের চেয়েও এগিয়ে ছিলো ছোট পর্দার মিডিয়া। কিন্তু হঠাৎ করেই টিভি মিডিয়া জনপ্রিয়তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। যদিও বা টেলিভিশনের কোন নাটক-অনুষ্ঠান আলোচনায় আসছে সেটি ইউটিউব বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে।
অভিযোগ রয়েছে অনুষ্ঠানের মানহীনতাই এর জন্য দায়ী। এই অনুষ্ঠানের সিংহভাগ দখল করে থাকে খণ্ড-ধারাবাহিক নাটক-টেলিছবি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো শতকরা পাঁচটি নাটক দর্শকদের মন জয় করে আলোচনায় এলেও বেশিরভাগ নাটকই মানহীনতার কাঠগড়ায়। তারকাপ্রীতি, বন্ধুপ্রীতি, দুর্নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাছাই করা হচ্ছে নাটক-টেলিছবি। ধ্রুপদী কাজগুলোকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে গ্ল্যামার আর ‘লোকে খায় না’ উক্তি দিয়ে।
এরপর উল্লেখ করা যায় নানা রকম টক শোয়ের কথা। এইসব টক শোগুলোতে গ্ল্যামারকে প্রাধান্য দেয়া হলেও আলোচনার বিষয় ও উপস্থাপনার ধরনে সেগুলোও দর্শক টানতে পারছে না। আছে আরও অনেক কারণ। তবে হঠাৎ করেই নজরে এলো টিভি মিডিয়ার দুর্বল একটি বিষয়। সেটি হলো অধিকাংশ চ্যানেলগুলোই চলছে অনুষ্ঠান প্রধানের দিক নির্দেশনা ছাড়াই।
অর্থাৎ. হেড অব প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠান প্রধান নামে একটি পদ টিভি চ্যানেলগুলোতে থাকলেও অনেকগুলো চ্যানেলেই এই পদ শূন্য। আর যে কয়টিতে আছেন সেগুলোরও বেশিরভাগে দেখা যায় স্বাধীনভাবে এই পদ সচল থাকতে পারছে না। চ্যানেলগুলোর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার শিকার হচ্ছেন। অনুষ্ঠান প্রধান আছেন নামে মাত্র। কিছু কিছু চ্যানেলে আবার অধীনস্থদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের দায়িত্বে ফাঁক তৈরি করছেন অনুষ্ঠান প্রধানেরা।
যার ফলে মিডিয়া কর্মীরা মনে করছেন, অনুষ্ঠান তৈরি ও বাছাইয়ে সঠিকভাবে মনোযোগী হতে পারছে না চ্যানেলগুলো। হচ্ছে না কোনো গবেষণাও। প্রাধান্য পাচ্ছে না মান, দর্শকের রুচি, বাজেট, প্রচারণা। নানা উপঢৌকন আর বাড়তি ব্যক্তিগত সুবিধার আড়ালে চলছে প্রিভিউ কমিটি। কেউ কেউ দাবি করেন, দুর্নীতিতে চাপ কমাতে চ্যানেলের আভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক বেশ কিছু পক্ষের নানা প্রভাবে কমেছে অনুষ্ঠান প্রধানের সংখ্যা, বেড়েছে এজেন্সির প্রভাব। যার ফলে নষ্ট হচ্ছে স্বাধীন নির্মাণের চর্চা। বাধ্য হয়ে নির্মাতারা নামছেন কম বাজেটে নাটক নির্মাণের প্রতিযোগিতায়। স্বভাবতই বাজেটের অভাবে কমছে নাটক-টেলিছবি ও অনুষ্ঠানের মান, হারাচ্ছে দর্শক। অথচ এতবড় একটি পদ যে ফাঁকা রেখেই টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি পথ চলছে সেদিকে কারোর ভ্রুক্ষেপও নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল অনুষ্ঠান প্রধান নেই চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, মাছরাঙা, একুশে টিভি দীপ্ত টিভি, জিটিভির মতো জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোতে। অনুষ্ঠান প্রধান আছেন চ্যানেল নাইন, দুরন্ত টিভি, এশিয়ান টিভি, মাই টিভি, এনটিভি, বাংলাভিশন, দেশ টিভি, বৈশাখী টিভিতে। তার মধ্যে এনটিভি থেকে বলা হয়েছে অনুষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ। কিন্তু এই টিভি ব্যক্তিত্ব মূলত এনটিভির অনুষ্ঠান উপদেষ্টা হিসেবেই বেশি পরিচিত নির্মাতা মহলে। আর এটিএন বাংলা থেকে বলা হয়েছে তাদের চ্যানেলটিতে অনুষ্ঠান প্রধান পদটিই নেই। অনুষ্ঠান বিষয়ক সবকিছু দেখাশোনা করেন অনুষ্ঠান প্রদানের দায়িত্বে থাকা নওয়াজেশ আলী খান।
বাংলাভিশনের এই পদটিতে আছেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শামীম শাহেদ। দীর্ঘদিন ধরে এই চ্যানেলটির অনুষ্ঠান প্রধান হিসেবে সাফল্যের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। চ্যানেল নাইনে অনুষ্ঠান প্রধান হিসেবে আছেন তানভীর খান, দুরন্ত টিভিতে আছেন আলী হায়দার, আরিটিভিতে আছেন দেওয়ান শামসুর রাকিব, দেশ টিভিতে রবিউল করিম, মাই টিভিতে আছেন হেলাল আহমেদ, বৈশাখী টিভিতে আছেন আহসান কবীর, এশিয়ান টিভিতে গেল ২০ নভেম্বর যোগ দিয়েছেন ফজলুল হক আকাশ।
অন্যদিকে চ্যানেল আইতে অনুষ্ঠান দেখাশোনা করেন প্রোগ্রাম’র জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা আমীরুল ইসলাম। একুশে টিভিতে অনুষ্ঠান বিভাগের দেখাশোনা করছেন ইনচার্জ অব প্রোগ্রাম মোহসিনা রহমান। জিটিভিতে আদিত্য নজরুল অনুষ্ঠান বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবেই অনুষ্ঠান দেখাশোনা করে থাকেন। দীপ্ত টিভিতে প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) কাজী উরফি আহমেদই অনুষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। মাছরাঙায় অনুষ্ঠান দেখাশোনা করেন আরিফ রহমান। সবার কাছে তিনি চ্যানেলটির অনুষ্ঠান প্রধান হিসেবে পরিচিত হলেও অফিসিয়ালি তিনি সিনিয়র ম্যানেজার অব প্রোগ্রাম হিসেবে মাছরাঙায় দায়িত্ব পালন করছেন।
এস এ টিভিতে আছেন জিনাত জেরিন আলতাফ। আর পরীক্ষামূলক সম্প্রচারে থাকা নাগরিক টিভিতে অনুষ্ঠান প্রধানের দায়িত্বে আছেন কামরুজ্জামান বাবু।
এতগুলো চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রধান নেই শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সিনিয়র-জুনিয়র অনেক শিল্পী ও নির্মাতারা। তবে বিষয়টি নিয়ে তারা নাম প্রকাশে কথা বলতে চাননি। তবে তাদের সবারই প্রশ্ন, ‘অনুষ্ঠান প্রধান ছাড়া চ্যানেল কীভাবে চলে?’ অনেকে দাবি করেন, ‘বিশ্ব মিডিয়াতেই টেলিভিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে ভাবা হয় অনুষ্ঠান প্রধানকে। কারণ, তার হাত ধরেই একটি চ্যানেল বৈচিত্রময় অনুষ্ঠান দিয়ে দর্শক ধরে রাখার চেষ্টা করে। অথচ আমাদের দেশে এত বড় অনিয়ম করেই চলছে জনপ্রিয় সব চ্যানেলগুলো। এ কারণেই দায়বদ্ধতার অভাব দেখা যায় চ্যানেলগুলোতে। অনুষ্ঠানের মান উন্নয়ন নিয়েও তেমন কোনো মাথা ব্যাথা নেই। মানবসম্পদের এই ত্রুটি শিগগিরই চ্যানেলগুলোর শুধরে নেয়া উচিত।’
এই প্রসঙ্গে নাট্য নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টর গিল্ড’স এর সভাপতি গাজী রাকায়েত বলেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেলকে প্রফেশনাল করতে গেলে অনুষ্ঠান প্রধান খুবই প্রয়োজন। যে চ্যানেল তাদের অনুষ্ঠান বিক্রি করে সেই টাকাই চলে সেটাই প্রফেশনাল চ্যানেল। বাংলাদেশের প্রতিটি চ্যানেলে মালিকদের বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। চ্যানেলে প্রফেশনালিজম তৈরি হচ্ছে না। যার জন্য প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে না। অনুষ্ঠান প্রধানের উপর নির্ভর করে চ্যানেলের ভালোমন্দ অনুষ্ঠান। আমাদের দেশের সেসব চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রধান নেই, তাদের সচেতন হওয়া উচিত। দিনের পর দিন অনুষ্ঠান প্রধান না থাকায় এজেন্সির দৌরাত্ম বাড়ছে। এর জন্য চ্যানেলের ভবিষ্যৎ অনেক খারাপ। এককথায় বাংলাদেশের যেসব টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে অনুষ্ঠান প্রধানে নেই, সেখানে অতিসত্বর অনুষ্ঠান প্রধানের ব্যবস্থা করা উচিত। নির্দিষ্ট পদের মানুষ ছাড়া তার বিকল্প অন্য কেউ হতে পারে না।’
ছোটপর্দার অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারন সম্পাদক আহসান হাবীব নাসিম বলেন, ‘যেসব টিভিতে অনুষ্ঠান প্রধান নেই সেসব চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রধান নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। কারণ যারা মার্কেটিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে তারা তো শিল্পের মান বুঝবে না। তারা শুধু ব্যবসাটা বুঝবে। সাথে সাথে আমার মতামত, অনুষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে প্রিভিউ কমিটি দেয়া হোক। যারা নাটক প্রচারের আগে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলবে। যেমন এ, বি, সি ক্যাটাগরি।
একুশে টিভির শুরুর দিকে এই নিয়ম খুব কড়াভাবে চালু ছিল। টেলিভিশনের বাইরে থেকেও তারা নাটক বোদ্ধাদের নিয়ে অনুষ্ঠানর মান নির্ধারণ করতো। এই ক্যাটাগরির ভিত্তিতে নাটকের দাম নির্ধারণ করতো। তাই নাটকের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রভিভিউ কমিটি ও অনুষ্ঠান প্রধান দুটোই ভীষণ প্রয়োজন।’
এলএ