হারিয়ে গেছে সিনেমার ক্যানভাসারদের ঐতিহ্য
টিনের ছাউনি দিয়ে দু’বছর চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পর ১৯৯০ সালে ‘চলন্তিকা’র মালিকরা ইটের তৈরি বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ করেন। প্রতিদিন চলতো চারটি শো, প্রায় হাউসফুল দর্শক থাকতো সবগুলোতেই। সর্বশেষ শো নয়টা থেকে ১২টায়ও নারী দর্শকের সংখ্যা ছিল বেশি।
শ্রীরামপুর গ্রামের রোজিনা বেগম ১৯৯০-৯১ সালে চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘হামি তকন লতুন বউ। আত্তির বেলা খাওয়া-দাওয়া শ্যাষে বাড়ির বেবাকে শুয়্যা পড়ে। আর হামরা (স্বামীসহ) বাড়িত থ্যাইক্যা বাইর হই। ১২ ডার শো ছাড়লে রাস্তাত সব সিনেমা দেকা মানুষ, মিয়্যারাই বেশি। ওই পাড়ার নাদিরা তো পত্যেক সপ্তায়েই যায়। হামরা যতোদিন সিনেমা দেকিচি ওর সাতে দেকা হোচে।’
সপ্তাহজুড়ে প্রদর্শনের পর শুক্রবারে আসতো নতুন চলচ্চিত্র। তবে কখনও কখনও একই চলচ্চিত্র চলতো দুই সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি, স্মৃতি হাতড়িয়ে কথাগুলো জানান ‘চলন্তিকা’র সেই সময়ের ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক।
প্রেক্ষাগৃহটির সামনের বিশাল জায়গা (বর্তমানে সেখানে অস্থায়ী চারটি ঘর নির্মাণ করা আছে) দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে এত্তগুলা জায়গা, সব ভরে যেত সাইকেলে। আর ওই পাশে তো হাটের চেয়েও বেশি সাইকেল থাকতো। খুবই ব্যস্ততার মধ্যে থাকতাম। লোকজন প্রচুর আসতো। ঈদের সময় তো জায়গা দেয়া মুশকিল ছিল। তখন বাড়তি চেয়ার ঢোকানো হতো।’
মালিকানার অংশীদারিত্ব নিয়ে কোন্দলে ১৯৯১ সালে প্রেক্ষাগৃহ থেকে অংশীদারিত্ব তুলে নেন আবুল কালাম ও প্রামাণিক। প্রেক্ষাগৃহের সম্পূর্ণ মালিকানা চলে যায় নুরুজ্জামান পিটারের হাতে।
‘চলন্তিকা’র সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেই আরেকটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের কথা ভাবেন কালাম। চলচ্চিত্র দেখা মানুষের ভিড় তাকে আকৃষ্ট করেছিল দেলুয়াবাড়ীতেই আরেকটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের প্রতি। দর্শকের চাহিদা দেখে ১৯৯২ সালে ‘চলন্তিকা’র একশো গজ দূরেই নির্মাণ হয় ‘ফাইভ স্টার’ প্রেক্ষাগৃহ।
কালাম বলেন, ‘পাশাপাশি দুটি প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও দর্শকের কোনো সঙ্কট ছিলো না সেসময়।’ সপ্তাহজুড়েই দর্শক আসতে থাকে সমান হারে; তবে শনি ও মঙ্গলবার প্রেক্ষাগৃহে ভিড় ছিল মূলত হাটে আসা মানুষজনদেরই। এছাড়া সুষ্ঠুভাবে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের পিছনে প্রশাসনের সহযোগিতার কথাও স্বীকার করেন তিনি। চলচ্চিত্রের প্রদর্শনে যাতে কোনো রকম বিঘ্ন না ঘটে সে ব্যাপারে তিনি প্রশাসনের সমর্থনের কথাও জানান।
‘ফাইভ ষ্টার’-এর উদ্বোধন হয়েছিল ‘শাসন’ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে; পরবর্তী সময়ে ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘বিয়ের ফুল’; আরও পরে এসে ‘নসিমন’, ‘মূসা ভাই’, ‘আসলাম ভাই’, ‘ধোকা’ ছাড়াও প্রদর্শন করা হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। প্রেক্ষাগৃহটি নির্মাণের সমসাময়িক মানে ৯০-এর দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে নকল প্রবণতা, দুর্বল কাহিনি আর অশ্লীলতার ছড়াছড়ি তো ছিলই। তার পরও কিন্তু দর্শক হলবিমুখ হয়নি। এক শো ছাড়ার পর পরই টিকিট কাউন্টারের সামনে দেখা যেতো লম্বা লাইন। আর পাশের সাইকেল গ্যারেজে শুরু হতো হৈ-হুল্লোড়; একদিকে চলচ্চিত্র দেখা দর্শকের বাড়ি ফিরার আগ্রহ, অন্যদিকে পরের শো ধরার ব্যাকুলতা।
প্রেক্ষাগৃহটির চলচ্চিত্রের পোস্টার শোভা পেতো রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এর বাইরে ভ্যানের উপর দোচালা ঘরের মতো করে পোস্টার টাঙিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াতো ক্যানভাসাররা। চলতি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় কোনো গানের ফাঁকে ক্যানভাসারের কণ্ঠে ভেসে আসতো, ‘শুভেচ্ছা, অভিনন্দন... বর্তমানের হিট নায়িকা, যার কথা শুনলেই বুকের ভিতর, হ্যাঁ আপনার বুকের ভিতর ধুকপুক-ধুকপুক করে, সেই নায়িকা পপির কথাই বলছি; বর্তমানের পর্দা কাঁপানো নায়ক, অ্যাকশন হিরো, প্রেমিক পুরুষ মান্না, মমতাময়ী মা ডলি জহুর, নায়ক রাজ রাজ্জাক, দানব ভিলেন মিশা সওদাগর, গাঙ্গুয়া, কাবিলাসহ মারমার কাটকাট সম্পূর্ণ অ্যাকশন সিনেমা...। একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প, ভিলেনের প্রতারণা আর শত বাধা উপেক্ষা; হ্যাঁ বন্ধুরা, আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, দেলুয়াবাড়ী চলন্তিকা/ফাইভ ষ্টার সিনেমাহলে; সম্পূর্ণ রঙিন রুপালি পর্দায়, এখন চলছে...।’
চলচ্চিত্রের পোস্টার দেখে আর প্রচারম্যানের কথাগুলো শুনতে শুনতে চলচ্চিত্র দেখার আগ্রহ জন্মাতো অনেকের। সদ্য স্নাতকোত্তর একজন সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘ক্যানভাসারদের কথা আর পোস্টারে নায়ক-নায়িকার ছবি দেখে আকৃষ্ট হয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে ‘চলন্তিকা’য় গিয়েছিলাম। ২০০৫ সালের ঘটনা, তখন বয়স ১৩ কি ১৪ হবে। বিলাসের (দোতলার) টিকিট নিয়ে ভিতরে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছি, বারান্দায় তখন প্রচুর দর্শকের ভিড়। ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। দর্শকের ঠেলাঠেলিতে দোতলার একেবারে শেষপ্রান্তে এসে ঠেকেছি। আশঙ্কা হচ্ছিল, এই বোধ হয় নিচে পড়ে যাবো; ভয়ে আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম।’
২০০৮ সালের পর থেকে ‘চলন্তিকা’ ও ‘ফাইভ স্টার’-এ দর্শকের সেই উপস্থিতি আর চোখে পড়েনি। শূন্য দশকের শুরু থেকেই এ অঞ্চলে স্যাটেলাইট চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়, সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রে দুর্বল কাহিনি, প্রেক্ষাগৃহের বেহাল দশা ও পর্নোগ্রাফি-নির্ভর চলচ্চিত্রের কারণে মানুষজন প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
একসময়ের নিয়মিত দর্শক প্রেক্ষাগৃহের সামনের দোকানের কাঠমিস্ত্রি রাজ্জাক বলেন, ‘গরমের সময় দোজখরে ভাই। কে থাকে ওর মধ্যে? কী দরকার আমার? তারচেয়ে টিভি-ই ভাল। বাড়িতে ২১ ইঞ্চি কালার টিভি আছে। পাড়ার সবাই তো ওটাতেই দেখে।’
ইচ্ছে থাকলেও এখন অনেকেই প্রেক্ষাগৃহে যেতে পারছে না, অন্যভাবে বললে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। কম্পিউটার ছাড়াও কমদামি মাল্টিমিডিয়া মুঠোফোনেও দেখা যাচ্ছে চলচ্চিত্র। আর স্মার্টফোনে তো চলচ্চিত্র দেখা ডালভাতের মতো। সেই সঙ্গে পাড়ার মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠা ‘মিনি প্রেক্ষাগৃহ’ মানে টি স্টলে তো চলচ্চিত্র দেখানো রুটিনে পরিণত হয়েছে।
প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে তো বটেই পাশাপাশি চলচ্চিত্র নিয়ে, চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের নিয়েও অভিযোগ কম নেই। বাংলা চলচ্চিত্রে একনায়কত্বের যে ব্যাপার, সেটি তো বহু পুরনো কথা; অভিযোগ আছে অভিনয় নিয়েও। প্রেক্ষাগৃহের সামনের দোকানি ফারুকের অভিযোগ, ‘এখন যারা অভিনয় করে, তাদের এগুলো হয় না। সাকিবের (ক্রিকেটার) জন্য মাঠে যাই, হলে তো কেউ টানে না। কোনো অভিনেতা তো এখন আমাকে হলে নিয়ে যেতেই পারে না। তেমন কেউ হলে অবশ্যই হলে যাবো।’
কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে দর্শক না আসার একেবারেই ভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন কালাম। তিনি জানান, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে পার্শ্ববর্তী চৌবাড়িয়া হাটে মান্দা থানার ছয়জন পুলিশের সদস্যকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এর কয়েকদিন পর ‘চলন্তিকা’ ও ‘ফাইভ ষ্টার’-এ ৯-১২টার শো দেখতে আসা প্রত্যেক দর্শককে হল থেকে বের করে বেধড়ক মারধর করে র্যাব। ঘটনাটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে প্রেক্ষাগৃহে আসা নিয়ে ভীতি তৈরি হয়। এরপর আস্তে আস্তে দর্শক শূন্য হয়ে পড়ে প্রেক্ষাগৃহ।’
দর্শককে না টানতে পেরে ‘চলন্তিকা’ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ২০১২ সালে। প্রেক্ষাগৃহের প্রতি অন্যরকম ভালোবাসা থেকেই ‘ফাইভ ষ্টার’ চালু রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন আবুল কালাম। ২০০৯ সালের পর থেকে দুটো প্রেক্ষাগৃহেই ‘এক টিকিটে দুই ছবি’ দেখানো হতো। মানে একটি ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র দেখানোর পাশাপাশি বিরতির পর পর্নোগ্রাফি দেখানো হতো। কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হলো না। সোহরাব নামের একজন ‘ফাইভ ষ্টার’-এ এক টিকিটে দুই ছবি দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘সিনেমা শেষে আমি মুখ ঢেকে বের হয়েছি। কী যে লজ্জা লাগছিল! কেউ যদি দেখে ফেলে তাহলে ভাববে, আমি এক্স (পর্নো) দেখে বের হচ্ছি।’
চরম সঙ্কটের এই মুহূর্তে বাধ্য হয়েই প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রের বদলে এখন আয়োজন করা হয় আবার সেই যাত্রা ও ভ্যারাইটি শো। দিনের বেলা চলে ভ্যারাইটি শো এবং রাতে থাকে যাত্রার আয়োজন। এসব আয়োজনে আকর্ষণ হিসেবে নিয়ে আসা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের।
এ ব্যাপারে ‘ফাইভ ষ্টার’-এর মালিকের বক্তব্য, ‘কুলাবার না পেরে মাঝে মধ্যে শিল্পী নিয়ে এসে শো চালাইছি। উপায় না থাকলে কী করবো? দেখি কী হয়?’ চলচ্চিত্র দেখতে না আসলেও যাত্রাগান কিংবা এসব ভ্যারাইটি শো’র দর্শক হয় প্রচুর। সপ্তাহখানেক এসব অনুষ্ঠান চলার পর আবার বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রেক্ষাগৃহ। তবে বন্ধের মধ্যেও মাঝে মাঝে নিয়ে আসা হয় ব্যবসাসফল দু-একটি চলচ্চিত্র। বর্তমানে কেবল ঈদ উপলক্ষেই প্রেক্ষাগৃহটি চালু করতে দেখা যায়।
২০১৬ সালের কোরবানির ঈদে পরিবেশকের মাধ্যমে ঢাকা থেকে ডিজিটাল প্রজেক্টর ভাড়ায় এনে দেখানো হয়েছে বসগিরি; চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের পর থেকেই প্রেক্ষাগৃহটি বন্ধ ছিল। ২০১৭ সালের রোজার ঈদে শাকিবের সিনোমা চালিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি।
আর গত কুরবানির ঈদে চলেছে ‘রাজনীতি’। কালাম বলেন, ‘বর্তমানে ডিজিটাল সিনেমার ফলে পজিটিভ অনেক কিছু দেখছি। ঈদে সিনেমা দেখতে অনেক লোক হয়। মেশিন ভাড়া নিয়ে চালায়। প্রচুর খরচ, ওভাবে চালানো যাবে না। আমি ডিজিটাল একটা মেশিন কিনার টার্গেটে আছি, কিন্তু কুলাবার পারছি না। এখন হল সাময়িক বন্ধ আছে, তবে চালু করবো। আমার অবশ্য ইচ্ছে আছে হলটা অডিটোরিয়াম বানাবো।’
কেএ/এলএ