একাত্তর বছরে পা দিলেন আসাদুজ্জামান নূর
সময়ের বৈরিতা দেখেছেন, দিনযাপনের দৈনতা বোধ করেছেন, অনুভব করেছেন বিপ্লবে বিপ্লবে মানুষের অধিকার আদায়ের আর্তনাদ ও বীরত্ব। খেটেছেন জীবনের জন্য, ছুটেছেন জীবনের মূল্যবোধের পেছনে; পেয়েছেন আকাশ ছোঁয়া সাফল্য।
ছাত্র জীবনের বামপন্থি রাজনীতিক থেকে হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম একজন। সাধারণ এক থিয়েটারকর্মী থেকে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ এক অভিনেতা।
বলছি আসাদুজ্জামান নূরের কথা। যিনি কালজয়ী হয়ে আছেন ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে। আজ তার জন্মদিন। এ বছরে তিনি ৭১ বছর বয়সে পা রাখলেন। নন্দিত এই অভিনেতার এবারের জন্মদিন কাটবে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গেই ঘরোয়া আয়োজনে।
১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর নীলফামারী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আসাদুজ্জামান নূর। তার বাবার আবু নাজিম মো. আলী এবং মাতা আমীনা বেগম। নীলফামারী বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের ছোট্ট মফস্বল শহর। এই শহরেই শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্যের প্রথম ভাগ কেটেছে সরকারের বর্তমান সংস্কৃতিমন্ত্রী ও সময়ের চিরসবুজ অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের।
বাবা-মা ছিলেন দু’জনই স্কুলশিক্ষক। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূর সবার বড়। ১৯৮২ সালে ডাক্তার শাহীন আকতারকে বিয়ে করেন। এক ছেলে এক মেয়ে তার। ছেলে সুদীপ্ত লন্ডনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে দেশে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত। মেয়ে সুপ্রভার বিয়ে হয়েছে সম্প্রতি।
জীবনে প্রথম দিকে বাম রাজনীতিকে গায়ে মেখে দুর্বার যাত্রা শুরু করেন। শ্রেণি-সংগ্রাম, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তিনি লড়াই-সংগ্রাম করেছেন জীবনের অনেকটা সময়। বহমান স্রোতের আদর্শবান পুরুষ হিসেবে আসাদুজ্জামান নুর পেয়েছেন যশ, খ্যাতি, প্রশংসা, পুরস্কার এবং লক্ষ-কোটি দর্শকদের ভালোবাসা।
১৯৬২ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সকল আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন আসাদুজ্জামন নূর। পরবর্তীতে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আসাদুজ্জামান নূর মুক্তিযুদ্ধে ৬ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
জীবনের দ্বিতীয় ভাগে হয়ে ওঠেন অভিনয়ের যোদ্ধা। তিনি কখনও ‘এই সব দিনরাত্রি’র শফিক, কখনও ‘অয়োময়’র ছোট মীর্জা, কখনও বা ‘সবুজ ছায়ার’ ডাক্তার চরিত্রে অভিনয় করে লক্ষ লক্ষ দর্শক-শ্রোতার প্রশংসা ও ভালোবাসা পেয়েছেন। তবে কিংবদন্তি হয়ে আছেন ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাই চরিত্রে। অবশ্য ‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকে তার হাসান চরিত্রটিও একজন উঁচু পর্যায়ের দার্শনিকের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বলা বাহুল্য এসব নাটক ছিল প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের রচিত।
একই লেখকের রচনা ও পরিচালনায় ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্রে কাজ করেও নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। তারপর থেকে কেবল অভিনয়ের ভুবনে নিজেকে সমৃদ্ধ করেই চলেছেন। অভিনয় তার কতটা প্রিয় সেটি টের পাওয়া যায় যখন একজন মন্ত্রী হয়েও তাকে এখনো অভিনয় করতে দেখা যায়।
আসাদুজ্জামান নূর ২০০১, ২০০৮ এবং ২০১৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিলফামারী জেলা হতে সাংসদ নির্বাচিত হন।
আসাদুজ্জামান নূর থিয়েটারের লোক। মঞ্চ থেকেই তার মতো অভিনেতার উত্থান। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে তিনি বহুকাল ধরে কাজ করে আসছেন। এই দলের জন্য বিদেশি একটি নাটকের অনুবাদ করেছিলেন নূর। জনপ্রিয় সেই প্রযোজনাটির নাম ‘দেওয়ান গাজির কিসসা’। দীর্ঘ ১৭ বছর পর গেল বছর আবারও তারই নির্দেশনায় এর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে। এখনো হচ্ছে নিয়মিতই নানা উৎসব-আয়োজনে। এখানে অভিনয় করতে দেখা যায় নূরেরই বন্ধুবর আবুল হায়াত, আলী যাকের, সারা যাকেরসহ আরও অনেককে।
আসাদুজ্জামান নূর জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এশিয়াটিক সোসাইটি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নাগরিকসহ অনেক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
অভিনেতা, আবৃত্তিকার, বিজ্ঞাপন নির্মাতা, ব্যবসায়ী, সফল রাজনীতিবিদ এবং সর্বশেষ একজন আদর্শ পিতা ও একজন আদর্শ স্বামী তিনি। তবে আসাদুজ্জামান নূর নিজেকে একজন আত্মপ্রত্যয়ী মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।
নন্দিত এবং বরেণ্য এই মিডিয়া ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্মদিনে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তিনি আরও অনেক দিন বেঁচে থাকুন আমাদের মাঝে; সংস্কৃতির অভিভাবক হয়ে। এই দেশের মানুষ হৈ চৈ করে আসাদুজ্জামান নূরের শতবর্ষ জন্মোৎসব পালন করবে, সেই প্রত্যাশা আমাদের।
এলএ/বিএ