সিনেমা হলে না গেলে ঈদ আনন্দ পূর্ণতা পেত না
‘রজনীগন্ধা’ ক্লাবের বাৎসরিক পিকনিকের আয়োজনে সদস্যরা ১৯৮২ সালের শেষ দিকে খুলনায় যান। সেখানেই কোনো একটি (‘জোনাকি’ সম্ভবত) প্রেক্ষাগৃহে তারা চলচ্চিত্র দেখেন এবং সদস্যদের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ জন্মে।
ততদিনে অবশ্য রাজশাহীর প্রেক্ষাগৃহেও নিয়মিত চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী চলছিল। ‘স্মৃতি সিনেমা’, ‘কল্পনা’, ‘বর্ণালী’ তখনকার বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ।
এসব প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকের আগ্রহ আগে থেকেই খেয়াল করেছিলেন ক্লাবের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন। তার সঙ্গে যোগ হয় খুলনায় চলচ্চিত্র দেখার সেই অভিজ্ঞতা।
এ নিয়ে তারা কথা বলেন খুলনার সেই প্রেক্ষাগৃহের মালিক ফকির আহমেদের সঙ্গে। পরে জাহাঙ্গীর আলম নামের আরেক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় ফকির আহমেদের মাধ্যমেই।
জাহাঙ্গীরের নিজের প্রেক্ষাগৃহ ছিল না; তিনি মূলত ১৬ মিলিমিটার প্রজেক্টর ও চলচ্চিত্রের রিল ভাড়ার ব্যবসা করতেন। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলে ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন ভাড়ায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী আয়োজনের।
এক্ষেত্রে বাড়তি কিছু সুবিধা আকৃষ্ট করেছিল ‘রজনীগন্ধা’ ক্লাবের সদস্যদের। যাত্রাগানের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো, চলচ্চিত্রের বেলায় সেসবের বালাই নেই। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপারটি হল চলচ্চিত্র দিনে একাধিকবার প্রদর্শন সম্ভব; অথচ যাত্রাগানের ক্ষেত্রে সেটি ছিল প্রায় অসম্ভব।
তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা দেখে আসা মানুষদের রুচি, ধারণা ও অভ্যাসেও কিছু পরিবর্তন এসেছিল। তাই তখন দরকার ছিল এক বড় ধরনের সৃষ্টিশীলতা, যা আমূল পাল্টে দিবে শিল্পকলার যাবতীয় শৈলী, যা প্রভাবিত করবে শৈল্পিক উদ্ভাবনাকে, আর সম্ভবত রোমাঞ্চকর পরিবর্তন আনবে শিল্পকলা সম্পর্কিত মানুষের বর্তমান ধারণায়।
এ রকম সব ভাবনা-চিন্তা থেকেই ভাড়ায় প্রজেক্টর নিয়ে আসেন রজনীগন্ধা ক্লাবের সদস্যরা। যাত্রা গানের স্থলে এবারে দেখানো হবে নবীনতম যান্ত্রিক শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্র।
প্রথম দিকে সপ্তাহব্যাপী চলতো এ প্রদর্শনী। রাস্তায় রাস্তায় প্রচারম্যান সুরেলা কণ্ঠে অনেকটা যাত্রার ঢঙেই বলতেন, ‘সুদূর খুলনা থেকে আগত, ১৬ মিলিমিটারে দেখানো হবে টুরিং (ভ্রাম্যমান) সিনেমা, দেলুয়াবাড়ি রজনীগন্ধা ক্লাবে এখন চলছে অমানুষ-অমানুষ-অমানুষ।’
এছাড়া হাড়িদের (নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়) কেউ একজন কোনো একটি বাজারের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢোলে বাড়ি দিয়ে বলতেন, ‘সুখবর, সুখবর, সুখবর; অতি আনন্দের খবর। দেলুয়াবাড়ী রজনীগন্ধা ক্লাবে বিশাল পর্দায় সিনেমা দেখানো হচ্ছে, আপনারা সবাই বউ, ছাওয়াল, শালা, শালি নিয়ে উপস্থিত হবেন। দেরি করলে ভুল করবেন ভাইয়েরা।’
ওদিকে বাঁশের চাটাই দিয়ে ঘিরে ক্লাবের পাশেই নির্মাণ করা হয় প্যান্ডেল। অতঃপর আসে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের দিন। টিকিট সংগ্রহ করা দর্শকরা প্রদর্শনী শুরুর অনেক আগেই ভিতরে প্রবেশ করার জন্য লম্বা সারিতে ভিড় করতে থাকে।
বিপুল সংখ্যক দর্শকের চলচ্চিত্রের প্রতি টান আর প্রদর্শন ব্যবসায় লাভ দেখে অনেকটা নিয়মিতভাবেই প্রদর্শনী চলতে থাকে ক্লাবের উদ্যোগে। ১৯৮৭ সালে এসে ক্লাবের সদস্য আবুল কালাম, নুরুজ্জামান পিটার, প্রামাণিক মিলে নিজেদের উদ্যোগে ব্যক্তি মালিকানায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের চিন্তা শুরু করেন।
তবে দেলুয়াবাড়ীর পরিবর্তে এবার মান্দা উপজেলা সদরে গিয়ে অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করে রজনীগন্ধা ক্লাব। ততদিনে অবশ্য ক্লাব কমিটি নিজেরাই প্রদর্শনের যন্ত্রপাতি কিনে ফেলেছে।
বিপুলসংখ্যক দর্শক নিয়ে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভালোই চলছিল প্রদর্শন ব্যবসা। মাস দুয়েক এভাবেই চলার পর বাধা আসে মান্দা উপজেলা পরিষদ মসজিদ কমিটি থেকে।
মসজিদ কমিটির চাপের মুখে বন্ধ করে দেয়া হয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। শুধু উপজেলা চত্বরে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি ‘ধর্মপ্রাণ’ মানুষগুলো। তারা সব জায়গায় প্রদর্শনী বন্ধে সব রকমের চেষ্টা করে গেছেন; দর্শকদের মধ্যে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছেন, এখনও সেই ধারা অল্পবিস্তার অব্যাহত আছে!
উৎসবগুলোতে এলাকার লোকজনের বিনোদনের অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। ঈদের দিন প্রেক্ষাগৃহে না গেলে দর্শকের আনন্দে পূর্ণতা আসত না অথচ ঈদগাহে নামাজের পর চলচ্চিত্র দেখার প্রতি এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ধর্মকে সরাসরি চলচ্চিত্রের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়। মুসল্লিদের উদ্দেশে বলা হয়, ‘কেয়ামতের দিন তিনটি স্থান ধ্বংস হবে না; মসজিদ, মন্দির আর সিনেমা হল। এই স্থানগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের জান্নাত কিংবা জাহান্নামে না পাঠানো পর্যন্ত ধ্বংস হবে না।’
এছাড়া সিনেমা হলে যেন বাড়ির ছেলে-মেয়েরা না যেতে পারে সেজন্যও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
শেষ পর্যন্ত উপজেলা চত্বরে আর চলচ্চিত্র দেখানো সম্ভব হয়নি। উপজেলা চত্বরে প্রদর্শনী চালাতে না পারলেও একেবারে বসে থাকেননি সংস্কৃতিমনা এ মানুষগুলো। আবার ফিরে এসেছেন নিজ এলাকায়; রজনীগন্ধা ক্লাবের পাশেই নিজেদের জায়গায় চাটাই দিয়ে ঘিরে কাপড়ের ছাউনির জায়গায়, টিনের ছাউনি দিয়ে স্থায়ীভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন ১৯৮৮ সালেই।
প্রামাণিক, আবুল কালাম ও নুরুজ্জামান পিটার মিলে এই প্রেক্ষাগৃহটির নাম দেন ‘চলন্তিকা’। ব্যবসায়িকভাবে প্রেক্ষাগৃহটির যাত্রা শুরু হয় ‘নিয়তির খেলা’ চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে।
বিপুলসংখ্যক দর্শকের কারণে প্রদর্শন ব্যবসা ভালোভাবে চলায় আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্টদের।
কেএ/এলএ/জেআইএম