ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

ঈদের টেলিছবি : ভাঙনের গল্প মন ছুঁয়েছে

লিমন আহমেদ | প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

আধুনিকতা, নাগরিক সভ্যতার আভিজাত্য, ডিজিটাল দিনযাপন যতোই ঘিরে থাকুক চারপাশ; বাঙালির কাছে গ্রাম আর গ্রামীণ জীবনবোধ আজও নান্দনিক ভালো লাগার। গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন, গ্রামীণ প্রেম-হাসি-কান্নার গল্প খুব সহজেই ছুঁয়ে যায় মন ও মননকে। আর শিল্প সাহিত্যে বরাবরই গ্রামীণ সংস্কৃতি ও পটভূমি সাফল্য পেয়েছে। সে হোক গল্প-কবিতা, গানে কিংবা নাটক-সিনেমায়।

‘সুজন সখী’, ‘সারেং বউ’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ থেকে ‘মনপুরা’- সবখানেই গ্রামীণ গল্পের নির্মাণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, আর্থিক সন্তুষ্টি পেয়েছে। তেমনি করে অসংখ্য নাটক-টেলিছবিতেও গ্রামীণ পটভূমির জয়জয়কার দেখা গেছে। এইক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের নাম এগিয়ে রাখতে হয়। ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, ‘সবুজ ছায়া’র মতো নন্দিত ধারাবাহিকসহ বহু নাটকে তিনি গ্রামকে দেখিয়েছেন দারুণ উপস্থাপনায়। যা নাগরকি বাঙালির জীবনকে তার শেকড়ে নিয়ে গেছে ভাবনার স্রোতে, দিয়েছে হাহাকার ভরা ভালো লাগা।

সিনেমাতে এখন আর গ্রাম দেখাই যায় না বলা চলে। যদিও বা কেউ দেখাচ্ছেন তেমন করে মন ভরাতে পারছেন না। নির্দিষ্ট ধনী-গরীবের প্রেম, নায়ক-নায়িকার প্রেম নিয়ে সংঘাতে আটকে আছে সব। নাটকেও মাঝে বেশ অনেকটা সময় গৎবাঁধা গ্রামীণ গল্প-চরিত্রে বিরক্ত হয়েছে দর্শক। গ্রাম বলতে নানা আঞ্চলিক ভাষার দফা রফা করে নাট্যকার, পরিচালক আর অভিনয়শিল্পীদের জোর করে কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর দৃষ্টিকটু চেষ্টাই দেখা গেছে। গ্রামের মতো নাটক থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো শহুরে গল্পের চরিত্রের প্রাণও। এখানে ব্যতিক্রম বলতে ছিলো পুরান ঢাকায় গিয়ে ঢাকাইয়া ভাষার কমেডি।

তবে আশার কথা হলো গেল কোরবানি ঈদ ছোট পর্দার নির্মাণে বেশ কিছু ইতিবাচক সংযোজন নিয়ে এসেছে। এটি যেমন হয়েছে নাগরিক জীবনের গল্পে, তেমনি গ্রামীণ গল্পেও। চঞ্চল চৌধুরী, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, অপূর্বসহ বেশ ক’জন অভিনেতাই এবার গ্রামীণ গল্পের চমৎকার কিছু নাটক-টেলিছবিতে হাজির হয়ে দর্শকদের মন মাতানোর চেষ্টা করেছেন।

তবে এতোসব নির্মাণের মধ্যে আলোচনায় এসেছে আবু হায়াত মাহমুদের ‘ভাঙন’ নামের টেলিছবিটি। দাম্পত্য জীবনের দারুণ এক করুণ প্রকাশ এই টেলিছবিতে। যেখানে রহিম চরিত্রের চঞ্চল চৌধুরী বাবার আদেশে স্ত্রী কুলসুম চরিত্রের জাকিয়া বারী মমকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। কারণ, মম প্রায় সময়ই অসুকে ভুগেন। তারউপর তার বাবার কাছ থেকে পর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা চেয়ে পান না চঞ্চলের বাবা। দুই বেয়াইয়ের দ্বন্দ্ব মেটাতে গ্রাম্য সালিশে নির্ধারিত হয় কুলসুমকে তালাক দেবে রহিম। বাবার কথার অবাধ্য হতে পারে না রহিম। এখানে বীরোচিত নায়কের আবির্ভাব নেই। বরং পিতার আদেশ মেনে নেয়া দুর্বল চিত্তের এক যুবক জেলেকেই ফুটিয়ে তুলেছেন চঞ্চল।

যার সংগ্রামটা শুরু হয় কোলের শিশু সুমিকে রেখে স্ত্রী কুলসুমের চলে যাওয়ার পর। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই বাবাকে হারিয়ে মেয়েকে নিয়ে একাকীত্বের জীবনে ঝাপ দেয় রহিম। তারপর থেকেই তার সঙ্গী মেয়ে সুমি। রহিম চর থেকে চরে মাছ ধরে বেড়ায়। আর পাড়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে মেয়েকে। শত অভাবের মাঝেও মেয়ের মায়ের অভাব পূরণে সর্বাত্মক চেষ্টা তার।

গল্প থেমে থাকে না। সুমি বড় হয়। রহিমদের চরে মাছের অভাব। জীবনের টানে সে দূরের এক চরে যায় মহাজনের আহ্বানে। সেখানে আজিজুর চরিত্রের আজাদ আবুল কালামের প্রতিবেশি হয় রহিম। জীবন হাজির হয় পরিহাসের করুণ সুর নিয়ে। রহিম আবিষ্কার করে বড় ভাইয়ের মতো যে আজিজুরকে সম্মান করে সে তারই স্ত্রী কুলসুম, যাকে সে কয়েক বছর আগে তালাক দিয়েছিলো।

নিজের স্ত্রী অন্যের সংসারে, কেমন লাগে তাকে দেখতে? সেই অভিজ্ঞতা চঞ্চলের বাস্তব জীবনে নেই। কিন্তু টেলিছবিটিতে দুর্দান্তভাবে তাই ফুটিয়ে তুলেছেন চঞ্চল। বিরহ, প্রেম, রোমান্টিসিজম- সবকিছু একসঙ্গে নিয়ে অসাধারণ সেই ‘এক্সপ্রেশন’। কম যান না মমও। প্রাক্তন স্বামীকে নিজের স্বামীর খাতিরের লোক হিসেবে দেখার দুর্ভাগ্যের যে বহিঃপ্রকাশ তিনি দেখিয়েছেন, তাতে বলাই যায় মম অনেক বড় মাপের অভিনেত্রী।

তবে মম’র চরিত্রের আকুলতা দর্শক হৃদয় ছুঁয়ে যায় যখন সে তারই গর্ভের মেয়েকে সবার সামনে নিজের মেয়ে বলে দাবি করতে পারে না। তাই সুমিকে যখন সবার আড়ালে পায় সে, সব বাঁধ ভেঙ্গে মাতৃত্বের হাহাকার নান্দনিক হয়ে আসে। মেয়ের হাত ছোঁয়া, গাল ছোঁয়ার দৃশ্যগুলো যেন মাতৃত্বের সবগুলো অনুভূতিকে সফল করে তোলার দারুণ এক অহংকারী চেষ্টা। মেয়েকে একান্ত কাছে পেয়ে তার মুখ থেকে মা ডাক শোনার ব্যাকুলতা চোখে জল নামায়। নমস্য মম! ধন্য দিতেই হয় এমন গল্প ও আর সংলাপের রচয়িতা সাজিন আহমেদ বাবুকে।

আধা পাগলা মধ্যবয়স্ক আজিজুরের চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন আজাদ আবুল কালামও। সব সয়, ক্ষুধার জ্বালা সয় না তার। তাইতো রান্না করতে দেরি হওয়ায় স্ত্রী কুলসুমকে পেটান তিনি। গ্রাম বাংলার এ এক করুণ চিত্র চিরদিনের। অকারণে অযথা বীরপুরুষ স্বভাবী স্বামীর হাতে মার খেয়ে গেছে কুলসুমরা সবসময়। তবে আজিজুর বদলে যান। সুমির প্রতি স্নেহ আর মায়ার বাঁধনে আটকা পড়ে তিনি শপথ করেন আর কখনো বউ পেটাবেন না। সুবোধ বালকের মতো দুই কান ধরে সুমির কাছে মাফ চাওয়ার দৃশ্যটি বেশ লাগে!

মেয়েকে মায়ের কাছে আনন্দে থাকতে দেখে ভীত হয় রহিম। পাশাপাশি প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের যে আড়ষ্টতা দিনে দিনে সেটাও কেটে যাচ্ছে উপলব্দি করে শংকিত হয় সে। তাই হুট করে সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েকে নিয়ে নিজের এলাকায় ফিরে যাবার। এই রহিম প্রতিবাদী হতে পারে না। নিজের মনের ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে বলিষ্ট হতে পারে না। তাই কুলসুমের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চায়। মেয়েকে হারানোর ভয়ে মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে নিয়ে সরে যেতে চায়।

দেখতে দেখতে মনে হয় নির্মাতা হয়তো তার ক্ষমতার জাদুর কাঠিতে মিলিয়ে দেবে রহিম আর কুলসুমকে। ফিরিয়ে দেবে রহিমের ভালোবাসার সংসার। যেখানে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ‍সুখের সুর তুলবে সে। কোনো না কোনোভাবে সরে যাবে আজিজুর নামের দেয়াল।

কিন্তু নির্মাতা আবু হায়াত মাহমুদ এই আবেগের ধারেও গেলেন না। তিনি হাঁটলেন বিচ্ছেদের পথেই। যে বিচ্ছেদ মন ছুঁয়ে গেছে। যে বিচ্ছেদ ‘ভাঙন’ টেলিছবিটিতে দিয়েছে ভালো লাগার অনন্য মাত্রা। আদর্শ ছোট গল্পের মতোই এই বিচ্ছেদ ‘ভাঙন’কে করেছে স্বার্থক। কানে থেকে গেছে মায়ের কাছে ফেরার আকুলতায় কিশোরী সুমির ‘মা মা’ আর্তনাদ ও মেয়েকে হারানোর বেদনায় শোকাতুর ভাগ্য বিড়ম্বিত কুলসুমের গগন বিদারী চিৎকার।

টেলিছবিটির গল্প ও চরিত্রের নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কিছুেই বলা যাবে। এটাই এই নির্মাণের সেরা সাফল্য। তবে চমৎকার ছিলো এই টেলিছবিতে ব্যবহার হওয়া কিছু গানও। বিশেষ করে বাউলের মুখে নানা বোধের গানগুলো মন ভরায়। পাশাপাশি দৃশ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাছাইটাও হয়েছে দারুণ। আর বিশেষভাবে বলতে হয় এই নির্মাণের চিত্রগ্রহণের কথা। চিত্রগ্রাহক মেহেদী রনি ও মোস্তাক মোর্শেদ সফল মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন চিত্রগ্রহণে।

একজন দর্শক হিসেবে রঙ মাখানো কিংবা নির্দিষ্ট কোনো সেন্টিমেন্ট বিবর্জিত এই টেলিছবিটি আমাকে আশাবাদী করে গল্পপ্রধান নির্মাণে আবারও ফিরে আসবে বাংলা নাটক-টেলিছবির সোনালী দিন। আবারও ছোটপর্দাকে উপভোগ করবেন দর্শক।

নির্মাতা তার নির্মাণের জন্য কল্পনার কোনো কিছু নয়, গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তর থেকেই খুঁজে নিয়েছেন তার গল্প ও চরিত্রদের। এই রহিম, কুলসুম আর আজিজুররা আছেন সবখানেই। আছেন রহিমের বাবার মতো নিষ্ঠুর স্বার্থবাদী পিতারাও। যারা সুমির মতো শিশুদের করেছেন বঞ্চিত কালে কালে, নিজের জেদ আর ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। তবুও বেঁচে থাকে প্রেম অদেখায়। বিরহে চাদরে ঢেকেও রহিমের মনে চিরদিন থেকে যায় কুলসুমেরা।

ধন্যবাদ নতুন প্রজন্মের নির্মাতা আবু হায়াত মাহমুদকে। অভিনন্দন চঞ্চল চৌধুরী, জাকিয়া বারী মম, আজাদ আবুল কালাম ও সুমি চরিত্রের শিশুশিল্পী আরুবা আফসান জারাকে।

ইউটিউবে দেখুন টেলিছবিটি :

এলএ

আরও পড়ুন