দেশীয় চলচ্চিত্রে হতাশার নাম সাফটা চুক্তি!
কত প্রতীক্ষার পর মুক্তি পাচ্ছে স্বপন আহমেদের পরিচালনায় ‘পরবাসিনী’ ছবিটি। দেশে প্রথমবারের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ভিত্তিক ছবি, হলিউডধর্মী একটি ছবি। এলিয়েনদের গল্প, মহাশূণ্যে আধিপত্য বিস্তারের গল্প। যেখানে চিত্রনায়ক ইমন হাজির হবেন একজন বিজ্ঞানী হিসেবে।
বিগ বাজেটে নির্মিত এই ছবিটিতে প্রায় ৪৮ মিনিট ভিএফএক্স’র কাজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক। আজকাল দর্শকরা সব খবরই রাখেন। তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন ৪৮ মিনিট ভিএফএক্স’র খরচটা কত। স্বাভাবিকভাবেই এত বাজেট নিয়ে মন্দার চলচ্চিত্র বাজারে কেউ ছবি করতে চান না। ‘পরবাসিনী’ ছবির প্রযোজক সেই ঝুঁকি নিয়েছেন, দেশের ছবিকে বিশ্ব বাজারে পৌঁছে দেবেন বলে। দেশের আভ্যন্তরীন সিনেমা মার্কেটে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন বলে।
সেই আশা প্রত্যাশা যখন ডানা মেলছিলো তখনই এল আঘাত। বলা চলে কঠিন এবং নির্মম আঘাত। সেই আঘাতে প্রকাশ্যেই কেঁদেছেন ‘পরবাসিনী’র পরিচালক স্বপন আহমেদ। এই ছবিটি আগ্রহ পায়নি বুকিং এজেন্টদের, হল মালিকদের। তাই আগামীকাল শুক্রবার (৫ মে) ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে ১২টি সিনেমা হলে (!)। অথচ, কলকাতা থেকে আসা সাফটা চুক্তির আওতায় ‘ওয়ান’ নামের ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে ৮০টিরও বেশি হলে।
আরও মজার ব্যাপার হলো ‘ভালো সিনেমা চাই, ভালো সিনেমা চাই’, ‘ভালো সিনেমা হচ্ছে না’, ‘দেশীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হবে’ বলে গলা ফাঁটানো মানুষগুলো কেউই কিছু বলছেন না, নিচ্ছেন না কোনো ব্যবস্থা। সবাই লোক দেখানো আন্দোলনেই বিশ্বাসী থেকে গেলেন। দিনে দিনে সরকারকে বোকা বানিয়ে, দেশের সিনেমা শিল্পের যে ধ্বসটা নামানো হচ্ছে সে বিষয়ে নির্বিকার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষেরা। কেউ ঘোষণা দিতে পারছেন না কোনো সঠিক নির্দেশনার। প্রতি সপ্তাহেই শুক্রবার আসে, আর দেখতে হয় দেশীয় নির্মাতাদের হতাশা, আফসোস। তারা অকারণে পরাজয় বরণ করেন বিদেশি ছবির কাছে, হল দখলের লড়াইয়ে।
দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক হতে পারছেন না চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোও। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও যেন সবকিছু বুঝেও না বুঝার ভান করে আছেন; কোনো এক অজানা রহস্যে। সেন্সর বোর্ডও শাসনের জায়গাটিতে মজবুত হতে পারছে না। ফলাফল, হল দখলের লড়ােইয়ে বিদেশি ছবির কাছে দেশীয় ছবির করুণ আত্মসমর্পণ।
সাফটা চুক্তির নামে চলছে অনিয়মের রাজত্ব। একটি ছবি যাবে, একটি ছবি আসবে নীতিতে ছবি আসার খবরই পাওয়া যায়। যাবার খবরটি কেন জানি অন্তরালে রাখা হচ্ছে। খোঁজ করে যেসব ছবির নাম পাওয়া যাচ্ছে রপ্তানির তালিকায় সেগুলো উল্টো বিব্রত করে যায়। মানহীন, সুপার ফ্লপ, অপরিচিত সব নির্মাতা, তারকাদের ছবি যাচ্ছে ভারতে। সেগুলো ওপারে কোনো আলোচনাই পাচ্ছে না, পাচ্ছে না কোনো হল। বরং ছবির মানহীনতার জন্য বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে খাটো করে দেখারই বিজ্ঞাপন করছে ‘নগর মাস্তান’, ‘যদি তুমি জানতে’ নামের ছবিগুলো।
আরও মজার একটি বিষয় হলো, সার্কচুক্তিভুক্ত দেশসমুহের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকেই সংক্ষেপে এবং ইংরেজিতে সাফটা (SAFTA) বলা হয়। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ইসলামাবাদে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সার্কভুক্ত সবকয়টি দেশের মধ্যে চুক্তি হলেও ছবি আসছে কেবল ভারতের ক্ষুদ্র একটি রাজ্য কলকাতাই থেকেই। কেন, সেই উত্তর জানা নেই। অন্তত কেউ দিতে পারছেন না, বা চাইছেন না। আমরা সবাই নিরব। চলচ্চিত্রের মন্ত্রণালয়, এফডিসি, শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক, গণমাধ্যম; সবাই।
সবার অন্ধত্বের সুযোগে ফায়দাটা লুটছে কে? সরকার বা রাষ্ট্র? উত্তর হবে না। সবকিছুকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে এইসব চক্রান্তই বলা হোক আর মুনাফাখোর অনৈতিক ব্যবসায়ের কথাই বলা হোক, মজাটা মারছেন ছবির আমদানিকারক, বুকিং এজেন্ট ও হল মালিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থে হওয়া সাফটা চুক্তিকে অপব্যবহার করে চলেছেন আমদানিকারকরা। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো ওপার থেকে ছবি আনছেন, নিজেদের ইচ্ছেমতোই দুর্বল, মানহীন ছবিগুলো ওপারে পাঠাচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া দেশীয় ছবিগুলোকে কোনঠাসা করে রাখছে। তাদের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে বুকিং এজেন্ট ও হল মালিকরাও দেশীয় ছবির প্রতি মনযোগী হতে পারছেন না। আমদানিকরকরা নানাভাবে বুকিং এজেন্ট ও হল মালিকদের প্রভাবিদত করেন, পরিচালিত করেন।
এইসব বিষয়ে জানতে চাইলে বরাবরই বুকিং এজেন্ট ও হল মালিকরা দেশের ছবির দুর্বলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কিন্তু ‘ওয়ান’ ছবির চেয়ে ‘পরবাসিনী’ কোনদিক থেকে দুর্বল এই প্রশ্নের উত্তরটা চট করে দিতে পারেননি দুটি সমিতির নেতারা। শেষমেষ তারা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন ওপার বাংলার তারকা প্রজেনজিৎ বড় তারকা। আর ঢাকাই ছবির ইমনের দর্শক তুলনামূলক কম। সে কারণে ব্যবসায়ে ক্ষতির আশংকা রয়েছে।
কিন্তু গেল কয়েক মাসে সাফটা চুক্তির আওতায় আসা কোন ছবিটি ব্যবসা করে মুনাফা দিয়েছে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর মিলেনি। তবে কেন নিজের দেশের ছবিগুলোকে নিরব অপমান করে বিদেশি ছবিকে মাথায় তুলে নাচা হচ্ছে? একবার কী জবাবদিহিতা চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়? জবাবদিহিতা চেয়েছে বিএফডিসি, সেন্সর বোর্ড, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সমিতি-সংগঠনগুলো? কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে কেউ কী একবার বুঝানোর চেষ্টা করেছেন কী ভয়ানক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পকে তছনছ করে দিতে!
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন বললেন অনেক কথা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দর্শক যেসব ছবি দেখতে চায় সেইসব ছবিই তো চালাবে হল মালিকরা। তারা মনে করেছে ওয়ান ছবির দর্শক পরবাসিনীর চেয়ে বেশি হবে তাই হলের ব্যবধানে হেরে গেছে পরবাসিনী।’
কিন্ত এখন পর্যন্ত সাফটা চুক্তির আওতায় যে কয়টি ছবি এসেছে সবগুলোই তো হলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। লস করেছে। তবে ওপারের ছবি দর্শক বেশি দেখেন কেন বলছেন? এর উত্তরে প্রদর্শক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘আপনার কথা সত্যি। এখন পর্যন্ত আমদানি করা কোনো ছবিই চলেনি। ‘কেলোর কীর্তি’ ছবিটি একটু ব্যবসা করেছিল। আমাদের হলের যা পরিবেশ এতে ‘বাহুবলী’ চালালেও ভাবতে হবে। এখানে আসলে অনেক অনিয়ম রয়েছে, ফাঁক-ফোঁকর রয়েছে।’
সেগুলো কেন বন্ধ করছেন না? তিন-চার কোটি টাকা বাজেটে একটি ছবি বানানোর পর নিজের দেশের ভেতর সেই ছবিটি ভিনদেশি ছবির কাছে শোচনীয়ভাবে হল হারাচ্ছে। এটা কেমন কথা? উত্তরে মিয়া আলাউদ্দিন বলেন, ‘এটা অবশ্যই বেদনার। সবার আগে আমাদের নিজেদের দেশের ছবির প্রমোট করা উচিত। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ হলগুলোই একটি বিশেষ গোষ্ঠির কাছে দায়বদ্ধ। সেই গোষ্ঠির কথামতো তাদের ছবি নিতে হয়। না চললেও ছবির পোস্টার টানিয়ে রাখতে হয়। ওই সিন্ডিকেটটা ভাঙা যাচ্ছে না। সবাই মনে করে হল মালিকরা ইচ্ছে করেই এমন করে। এটা ঠিক নয়। যেসব ছবি আমদানি হচ্ছে সেসব তো আমাদেরে দেশের ছবির চেয়ে বেশি ব্যবসা করছে না। তো হল মালিকদের দেশের ছবি চালাতে কোনো আপত্তি থাকবে কেন! এখানে আসলে ছবির আমদানিকারক, ডিস্ট্রিবিউটরসহ আরও বেশ কিছু সংগঠন ও ব্যক্তিদের দাপট কাজ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাফটা চুক্তিতে অনেক অনিয়ম আছে। এখানে বেনিয়াদের আধিপত্য বাড়ছে দিন দিন। যারা এদেশের মানুষই না। ভিনদেশের সিনেমা ব্যবসায়ীরা এদেশে ছবি আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করার লাইসেন্স পেয়েছে। তাদের কাছে ব্যবসাটাই মুখ্য। তারা কখনো দেশের ছবি বা ভিনদেশের ছবি এসব ভাববে না। আর ভাবলেও সে যে দেশের তাকেই প্রাধান্য দেবে। বর্তমানে ‘আরাধনা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা এদেশে ছবি আমদানি করার লাইসেন্স পেয়েছে। এরা বাংলাদেশি নয়। কলকাতার সিনেমা ব্যবসায়ী। এখানকার বিশেষ একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সহযোগী হয়ে সিনেমা আমদানি করছে। ফ্লপ ছবিগুলো নিয়ে এসে প্রভাব খাটিয়ে হল দখল করছে। যখন ওই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ছবি আসে তখন কিন্তু তারা হলে দেশীয় ছবিই দেখাচ্ছে। যখন নিজের হাউজের ছবি থাকে না তখন হল বিদেশি ছবিকে দিয়ে দেশীয় ছবিকে হুমকিতে ফেলা হয়। আর এই দেশ থেকেও ফ্লপ ও মানহীন ছবি ওপারে দিচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। চলচ্চিত্রের মানুষদের সোচ্চার হতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, আরাধনা ‘তোমাকে চাই’ ও ‘ওয়ান’ ছবি দুটো এনেছে। কিন্তু ভিনদেশি ছবির কাছে হল দখলের লড়াইয়ে দেশীয় ছবিগুলোর পরাজয় তো সাফটা চুক্তির পর থেকেই দেখা যাচ্ছে। এতদিন কেন এমনটা হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘এতদিন ব্যবধানটা এত করুণ ছিলো না। আর ওই যে বললাম, দেশীয় হলগুলোতে আমাদের দেশের সিনেমা ব্যবসায়ে জড়িত বিশেষ একটি গোষ্ঠির বিশেষ প্রভাব রয়েছে। হলগুলোকে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান আসবে না। বুকিং এজেন্টরা বাধ্য হয়ে ওইসব ছবি হলে দিচ্ছেন। হল মালিকরাও বাধ্য হয়ে নিচ্ছেন। এখানে সরকারি জবাবদিহিতারও কঠোরতা বাড়াতে হবে। তবে একটা কথা বলবো, সিনেমা ব্যবসায়ের সঙ্গে লাভ, লোভসহ অনেক কিছুই জড়িত। কিন্তু দেশপ্রেমটাও থাকতে হবে। দেশপ্রেম না থাকলে আপনি যা খুশি তাই করতে পারবেন।’
মিয়া আলাউদ্দিন আরও বলেন, ‘আজকে যেসব সমস্যা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি দিনে দিনে খারাপ সময়ে ধাবিত হচ্ছে তার থেকে উত্তরণের বিশাল ভূমিকা রাখতে পারতো প্রযোজক সমিতি। কিন্তু আমাদের তো সেই সমিতিই নেই। চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা এক থাকতে পারলে বাইরের আমদানিকারকরা আসতে পারতো না। একটি গোষ্ঠিও গড়ে উঠতো না, যারা দেশের হল মালিক ও সামগ্রিক ইন্ডাস্ট্রিকেই পুতুল বানিয়ে রেখেছে।’
কিছুদিন পূর্বেই নির্বাচিত হয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির কমিটি। আগামীকাল অনুষ্ঠিত হবে শিল্পী সমিতির নির্বাচন, আসবে নতুন কমিটি। এরইমধ্যে ঢাকাই ছবির প্রযোজকরাও যদি সংগঠিত হতে পারতেন তবে এক হয়ে এইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যেত বলে মনে করেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারাও। তাদের দাবি, সাফটা চুক্তি অব্যবহারকে খুব দ্রুত কঠিন হাতে রুখে দিতে হবে। দেশের হলগুলোকে সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত করে বাঁচাতে হবে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে।
এলএ