প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম দুই হাজার টাকা : ন্যানসি
হাবিব ওয়াহিদের সুর-সংগীত ও কণ্ঠে ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হৃদয়ের কথা’ ছবিতে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো ‘ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু’ শিরোনামের গানটি। এতে কোরাস কণ্ঠে শোবিজে যাত্রা হয়েছিলো জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নাজমুন মুনীরা ন্যানসির। এরপরের বছরই মুক্তি পাওয়া ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ ছবিতে হাবিবের সুর-সংগীতে ‘পৃথিবীর যতো সুখ যতো ভালোবাসা’ শিরোনামের একটি গানে কণ্ঠ দেন ন্যানসি। সেই গান দিয়ে রাতারাতি তারকা বনে যান। দেশের সব শ্রেণির শ্রোতাদের মনে ভালোবাসার আসনে বসেন তিনি। পরের গল্প ইতিহাস। দিনে দিনে ন্যানসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সংগীতাঙ্গনের আস্থার প্রতিক শিল্পী হিসেবে। শ্রোতারা তার সব গানই লুফে নিয়েছেন ভালোবাসায়। পেয়েছেন নানা রকম স্বীকৃতি-পুরস্কার। তারমধ্যে অন্যতম ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্রজাপতি’ ছবিতে গান করে সেরা গায়িকা হিসেবে পাওয়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
গানের সঙ্গে তার সখ্যতা সেই শৈশব থেকেই, মায়ের হাত ধরে। আর শোবিজে প্রায় এক যুগ পার করেছেন ন্যানসি; গানের ভুবনে। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে এক আড্ডায় ছিলেন এই গায়িকা। গল্পে গল্পে জানালেন গান ও ব্যক্তি জীবনের অনেক কথা। লিখেছেন লিমন আহমেদ
জাগো নিউজ : প্রচারণার এই যুগেও ন্যান্সিকে দেখা যায় সবকিছুর আড়ালে। তারকাখ্যাতির কোনো বিড়ম্বনার খবর শুনিনি। কারণ কী?
ন্যানসি : জানেন, আমার আক্ষেপ হয় এত নাম, এত সুনাম অথচ আমাকে দেখে কখনো ভিড় জমে না। হা হা হা.... আমি রাস্তা দিয়ে জনমানুষের সঙ্গে হেঁটে গেলেও কেউ আমার দিকে একবারের বেশি তাকায় না। কেউ কেউ অবশ্য দ্বিধায় থাকেন আমি গায়িকা ন্যানসি কি না। একটু ভালো করে দেখেশুনে সবার ভুল ভেঙে যায়। সবাই মনে করে নেন আমি ন্যানসি নই। ন্যানসি হলে এভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম না। কারণ, আমাদের দেশের তারকারা পথে ঘাটে হাঁটেন না। তারা চারপাশে তারকাগিরির বলয় তৈরি করে রাখেন। এই বিষয়টা আমার মতো নিভৃতচারী তারকাদের জন্য সুবিধার হয়েছে।
জাগো নিউজ : তবুও কী ভক্তদের পাগলামির কোনো গল্প নেই?
ন্যানসি : আসলেই নেই। আমি যখন তারকা হয়েছি তখন সেলফির যুগ ছিলো না। কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে অটোগ্রাফ চাইতেন। তবে বাড়াবাড়ি কিছু চোখে পড়েনি। আমার চেহারাটাই মনে হয় এরকম। কেউ তারকা ভেবে হুড়োহুড়ি করে না। একটা গল্প বলা যায়। একবার বেইলি রোডে অফিসার্স ক্লাবে একটা অনুষ্ঠানে গান করতে গেছি। সেখানে হঠাৎ আমার জুতা ছিড়ে যায়। সেই জুতা হাতে নিয়ে আমি রাস্তা পার হয়ে ভিকারুন্নিসা স্কুল পর্যন্ত গিয়েছি। কেউ ফিরেও তাকায়নি। এটা কিন্তু খুব সুবিধার। ইচ্ছে মতো চলাফেরা করা যায়।
জাগো নিউজ : এখন তো সেলফির যুগ। সেলফি তুলতে হয় না ভক্তদের সঙ্গে?
ন্যানসি : আজকাল সবাই সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অটোগ্রাফের জায়গায় ফটোগ্রাফ চলে এসেছে ট্রেন্ড হিসেবে। কোথাও গেলে কিছু মানুষ কাছে এসেই যান। তাদের সঙ্গে সম্ভব হলে সেলফিতে পোজ দেই।
জাগো নিউজ : গানের বাইরে আপনাকে শোবিজের কোনো পার্টি, অনুষ্ঠান বা গেট টুগেদারগুলোতেও খুব একটা দেখা যায় না। কারণ কী?
ন্যানসি : আমি ভেতরে ভেতরে অনেক উচ্ছ্বল আর বাঁদর টাইপের একটা মেয়ে। অল্পতেই সবকিছু নিয়ে মাতামাতি করি, উত্তেজিত থাকি। আমার পরিবার ও কাছের মানুষরা সেটা জানেন। আমি অনেক মজা করতে পছন্দ করি। তবে এসব একান্তই কাছের মানুষদের সঙ্গে। কাজের জায়গায় আমি কারো ক্লোজ নই। তাই পার্টি বা গেট টুগেদারগুলো আমি এড়িয়ে চলি। আসলে আমি এগুলো মানিয়ে নিতে পারি না। অন্যদেরকেও ব্রিবত করতে চাই না বলে কোথাও যাই না।
জাগো নিউজ : তবে গানের বাইরের সময়টুকু কীভাবে কাটে?
ন্যানসি : ঘরেই থাকি। স্বামী আর দুই মেয়েকে নিয়ে সময় কাটাই। গান শুনি। আমি প্রচুর বই পড়ি। এভাবেই সময় কেটে যায়।
জাগো নিউজ : আপনার স্বামী নাজিমুজ জামান জায়েদের সঙ্গে দিনগুলো সাধারণত কীভাবে কাটে? একটা দিন কাটানোর রুটিন শুনতে চাই....
ন্যানসি : হা হা হা! তেমন কিছুই নয়। দুজনেই বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। আমি আগে উঠে চা বানিয়ে খাই। ও আবার চা খায় না। কোনো নেশাই নেই ওর। একেবারে নিপাট ভদ্রলোক। তো চা পর্ব সারি আমি গান শুনতে শুনতে। তারপর ফ্রেশ হয়ে খাবার রেডি করি। খাওয়া শেষে দুজন মিলে ছবি দেখতে পছন্দ করি আমরা। নানান দেশের নানা ভাষার ছবি দেখা হয়। কখনো ইচ্ছে করলে বাইরে ঘুরতে যাই। তবে এটা খুবই কম। আমি আসলে ভীষণ ঘরমুখী মানুষ।
জাগো নিউজ : আপনার কোন বিষয়গুলো আপনার স্বামী সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন?
ন্যানসি : বেশ কঠিন প্রশ্ন। আসলে আমি জানি না। বলেছি না, আমি খুব বাঁদর টাইপের একটা মেয়ে। হয়তো ওই বাঁদরামিটাই ওর পছন্দ হতে পারে। হা হা হা.....! তবে ওর অনেকগুলো পছন্দের দিক আছে। যেমন কথা বলে কম। সবকিছুই ঠান্ডা মাথায় গ্রহণ করে। ওর এই বিষয়টা দারুণ ভালো লাগে আমার। দায়িত্ব নিতে পারে। আফটার অল দাম্পত্য সুখী হবার মতো স্বামী ও।
জাগো নিউজ : আপনার দুই মেয়ে রোদেলা ও নাইলা। তারাও কী গানের সঙ্গে যুক্ত হবে?
ন্যানসি : আল্লাহর রহমতে আমার দুই মেয়েই ভালো গায়। মা বলে বলছি না, সত্যি ওরা অনেক ভালো গায়। সব ধরণের গানই ওরা গায়। আমার সব গান ওরা শোনেই মুখস্ত করে ফেলে। সেগুলো নিজেরা রেকর্ডও করে। বিশেষ করে আমার ছোটো মেয়ে গানের প্রতি খুব আসক্ত। সারাক্ষণ গান নিয়ে মেতে থাকে। বড় মেয়েটা অনেক লাজুক। কখনো কারো সামনে গান করে না। আমার রুমে বসে শুনি ওর গলা। ডেকে গাইতে বললেই আর পারে না। ওরা নতুন যুগের মানুষ। আমি মা হিসেবে কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। গানে তারা আসতে চাইলে খুশি হবো। না আসলেও কষ্ট পাবো না।
জাগো নিউজ : অনেক বাঁদর আপনি। তো শৈশবে আপনার বাঁদরামি নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার বাবা-মা অতিষ্ঠ ছিলেন?
ন্যানসি : বাবা তো ব্যস্ত মানুষ। অতোটা টের পেতেন না। হাড় জ্বালিয়েছি মায়ের। আমাকে শায়েস্তা করতে মা পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙে লাঠি বানিয়ে বালিশের নিচে রাখতেন। এই ডালের বিশেষত্ব হলো যতোই মারা হোক কাটবে-ফাটবে না। কিন্তু তিনদিন পর্যন্ত সাক্ষী থাকতো যে মারা হয়েছে। মা আমাকে অনেক কড়া শাসনে রাখতেন। সবসময় খবরদারি করতেন। তিনি ভাবতেন যেহেতু আমার একটাই মেয়ে তাকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাময়ী বানাতে হবে। তিনি আমাকে নাচতে শিখালেন, গাইতে শিখালেন, আবৃত্তি করতে শিখালেন। হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা এই সেই। স্বাধীনতা পেতাম না। সবসময় কিছু না কিছু একটা করতেই হতো। এজন্য আমি নিজের সব রাগ মেটাতাম বড় ভাই জনির উপর। দেখা গেল সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে আর আমি আ আ আ করে রেওয়াজ করছি। বিরক্ত লাগতো, হিংসাও হতো। মা তো রাজনীতি করতেন, সমাজ সেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের ঘরে রেখে বাইরে গেলেই আমি বড় ভাইয়ের সঙ্গে লেগে যেতাম। সুযোগ পেলেই মেরে দিতাম। বড় ভাই অনেকটা হাবাগোবার মতো ছিলো। বড়রা একটু বোকাই হয় আসলে। সে ম্যা ম্যা করে কানতো আমি মজা পেতাম। মা এসে সব শুনতেন, আবার বকা শুরু। আসলে তার শাসনটুকু যে কতো বড় ভালোবাসা আর স্নেহমাখা ছিলো আজ টের পাই। তিনি শ্রেষ্ঠ করে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন বলেই আজ আমি কিছু একটা হতে পেরেছি। মায়ের কাছেই পেয়েছি সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা, আদর্শ মানুষ এবং শিল্পী ন্যানসি হবার অনুপ্রেরণা।
জাগো নিউজ : আপনার মায়ের এই শাসনের প্রভাব কী আপনার উপরও পড়েছে? মানে আপনার মেয়েদেরকেও কী এভাবেই শাসন করেন?
ন্যানসি : হা হা হা.....! বাই বর্ন মায়ের একটা প্রভাব তো আছেই। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে আমার মেয়েরা আমার মতো সব সহ্য করবে না। আজকালকার ছেলে মেয়েরা শাসনে কিন্তু রিঅ্যাক্ট করে। সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই আমি মেয়েদের শাসন করি, আদর করি, গাইড করি।
জাগো নিউজ : আপনার সংগীত যাত্রায় আপনার মায়ের বিশেষ ভূমিকার কথা বলেন আপনি। সেই গল্পটা কেমন?
ন্যানসি : আমার মা নিজে গান করতেন। হয়তো তার সুপ্ত বাসনা ছিলো শিল্পী হবার। তিনি পারেননি। সেই স্বপ্ন আমার মাঝে তিনি প্রবাহিত করেছেন। মায়ের প্রিয় শিল্পী রুনা লায়লা। কিন্তু কী গান গেয়ে রুনা লায়লা সেটা তিনি জানেন না। তাই সব গানই শিখতে হয়েছে আমাকে। উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নিতে হয়েছে। নজরুল-রবীন্দ্র সংগীত শিখেছি। আবার রুনা লায়লার গানও করতাম। তবে নজরুল সংগীতেই বেশি মনযোগ দিয়েছি। কোনো ফাংশানে গেলে গেয়েছি। এমনকি আমি যখন বেতারে তালিকাভুক্ত হলাম নজরুলের গানের শিল্পী হিসেবেই হিয়েছি। তবে শেষাবধি শুধু শিল্পী ন্যানসিই হয়ে গেলাম। তবে আমার গান করা নিয়ে মা অনেক সন্তুষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমার সাফল্য দেখে যেতে পেরেছেন এটা সন্তান হিসেবে আমার অনেক বড় তৃপ্তি।
জাগো নিউজ : জীবনের প্রথম কোন গানটা হারমোনিতে তুলেছিলেন, মনে আছে?
ন্যানসি : খুব মনে আছে। আমরা সবাই রাজা। মা গানটা তুলে দিয়েছিলেন। আমাদের শৈশবে আসলে দুটা গান দিয়েই বাচ্চাদের গানে হাতেখড়ি হতো। এক- আমরা সবাই রাজা, দুই- আয় তব সহচরি।
জাগো নিউজ : তবে রুনা লায়লাই কি আপনার পছন্দের শিল্পী?
ন্যানসি : রুনা লায়লাকে তো অবশ্যই ভালো লাগে। তবে কণ্ঠের সিগনেচারের জন্য আমার খুব প্রিয় শাকিলা জাফর। উনার কণ্ঠ আমার কাছে বিশেষ একটি কণ্ঠ। কী যেন এক জাদু আছে। একদম তৈরি একটা কণ্ঠ। ভালো লাগে সামিনা চৌধুরীর গলাও। আজকাল দেখবেন গানে নিজস্বতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের সমসাময়িক নির্ঝর, মিলা ও এলিটার কণ্ঠ বেশ আলাদা। ছেলেদের মধ্যে হাবিব ভাই, বালাম ভাইয়ের গলা সবার থেকে আলাদা। আর অর্ণব ভাইয়ের গলাটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ইউনিক।
জাগো নিউজ : এবার একটু শুরুর দিকে যাই। হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গেই আপনার প্রথম কাজ। সেই প্রথম দিনের গল্পটা শুনতে চাই....
ন্যানসি : সেই দিন চিরকালই আমার কাছে নতুন আর স্মৃতিতে তরতাজা। হাবিব ভাইয়ের বাবা ফেরদৌস ওয়াহিদ হঠাৎ কল দিয়ে বললেন একটু বাসায় আসো। হাবিব তোমাকে দিয়ে সিনেমায় গান করাবেন। আমি তো আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পাগল হবার উপক্রম। মাকে নিয়ে চলে এলাম হাবিব ভাইয়ের বাসায়। কিন্তু এসে যারপরনাই হতাশ হলাম। কোথায় কী সিনেমার গান। আমাকে কেবল ‘ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু’ গানের কোরাস করতে দেয়া হলো। মনটাই ভেঙে গেল। তবে মজার ব্যাপার হলো এই অল্প একটু কাজের জন্যই হাবিব ভাই আমাকে একটা পারিশ্রমিকের খাম ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই ছিলো প্রথম কাজ। তবে তার কিছুদিন পরেই হাবিব ভাই আমাকে ডাকলেন বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে কণ্ঠ দেয়ার জন্য। ধীরে ধীরে অনেকগুলো জনপ্রিয় জিঙ্গেলে কণ্ঠ দেয়া হলো। আমি যাই, হাবিব ভাই মিউজিক ছেড়ে দিয়ে আমাকে স্টুডিওতে রেখে চলে যান। আমি গানটা তোলার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর সেটা রেকর্ড করে খামটা ধরিয়ে আমাকে বিদায় করেন। হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে এই ছিলো আমার প্রথমদিককার পরিচয় পর্ব। কথা তিনি একদমই বলতেন না। একটা বছর পরেই ‘আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা’ ছবির জন্য গান করতে ডাকলেন। ‘পৃথিবীর যতো সুখ’ গানটি করলাম। এবং সবকিছু বদলে গেল। রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে তো গান করেই চলেছি।
জাগো নিউজ : আপনার প্রথম দিনের পারিশ্রমিক কতো ছিলো?
ন্যানসি : দুই হাজার।
জাগো নিউজ : এখন আপনি অনেক বেশি পারিশ্রমিক নেন বলে অভিযোগ শোনা যায়। এ বিষয়ে কিছু বলুন-
ন্যানসি : অভিযোগ আসলেও আমার কিছু করার নেই। আমি অনেক ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গানে শিল্পীরা টাকা একবরাই পায়। কিন্তু গানের ব্যবসাটা চলবে অনন্তকাল। যেহেতু অনন্তকাল সেই গান থেকে আমার আয়ের ব্যবস্থা নেই সেহেতু আমি এককালীন টাকা নেয়ার সময় অবশ্যই পারিশ্রমিকটা বাড়িয়ে নেব। আমার চাহিদা, যোগ্যতা অনুযায়ী আমি যতটুকুর যোগ্য ততোটাই নেব।
জাগো নিউজ : এককালীন বেশি পারিশ্রমিক নেয়ার মধ্য দিয়ে কী আপনি গানের মালিকানা ছেড়ে দিচ্ছেন?
ন্যানসি : শুধু আমি কেন, সবাই ছেড়ে দিচ্ছে। কেউ তো কোনো পরিবর্তন আনতে পারছেন না। সেখানে আমি একটা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। বেশি পারিশ্রমিক নেয়াটা আমার একটা আন্দোলন বলতে পারেন। আজকাল কিন্তু অনেকেই বলছেন, ন্যানসিকে অতো টাকা সম্মানী দিচ্ছেন আমাকে দিবেন না কেন? আমি চাই এভাবে সবাই বলুক। এভাবে বলতে পারলে শিল্পীরা ঠকবেন না। গীতিকার হিসেবে জাহিদ আকবরের এই বিশেষ গুণটি আছে। কাজ বেশি না করে তিনি নিজের সম্মানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটা সবারই করা উচিত। আমি দেখেছি পারিশ্রমিক যখন আমি বাড়িয়ে দিলাম আমার কাজ অনেক কমে গেল। কিন্তু তাতে আমি দমে যাইনি। অনেকেই আমার পাশে থাকেননি, কিন্তু অনেকেই এটাকে অনুসরণ করছেন। একটা দিন কিন্তু আসবে যখন গানের শিল্পী, সুরকার, গীতিকাররা তাদের সম্মানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। এতে করে দেখবেন গানের জায়গাটা অনেক সুন্দর হচ্ছে।
জাগো নিউজ : আপনার একটি বিশেষ খবর সবার কাছেই খুব প্রশংসিত। সেটি হলো দেশের গানের ক্ষেত্রে আপনি কোনো পারিশ্রমিক নেন না। এই ভাবনাটা কেন?
ন্যানসি : খুবই সিম্পল। আমি ভেবে দেখলাম যে দেশ আমাকে জাতীয় স্বীকৃতি দিয়েছে সেই দেশের জন্য আমার কোনো গান থাকবে না! সবাই প্রেম-ভালোবাসার গান নিয়ে আমাকে ভাবে। দেশের গান তো কেউ করতে বলছে না। তাই বিনা পারিশ্রমিকে দেশের গান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
জাগো নিউজ : কিন্তু আপনি বিনা পারিশ্রমিকে করলেও অন্যরা তো এটা নিয়ে ব্যবসা করছে। সেই দিকটি আপনি খেয়াল রাখতে পারেন?
ন্যানসি : এটা আমার বিষয় নয়। কিছু ব্যাপার থাকে দায়বোধের, মূল্যবোধের। যদি নিজের মধ্যে এসব না থাকে তবে খেয়াল রেখেও আপনি কিছু করতে পারবেন না। আমি নিজের দায়িত্বটা পালন করছি, আপনি আপনারটুকু করুন, প্রত্যেকে প্রত্যেকেরটা করলেই ব্যাপারটা সুন্দর হয়।
জাগো নিউজ : ভিন্ন প্রসঙ্গ। আপনি একসময় আবৃত্তি করতেন। অনেক বই পড়ার অভ্যাসও আছে। কখনো কী লেখালেখির ইচ্ছে আছে?
ন্যানসি : একদম না। বই পড়া আর লেখালেখি করার মধ্যে অনেক পার্থক্য। এটা ঠিক অনেক কিছু মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আমি কোনোদিন এক লাইন লিখতে পারবো বলে মনে হয় না।
জাগো নিউজ : আজকাল গান প্রকাশের যে সিস্টেম এটা আপনার কাছে কেমন লাগে?
ন্যানসি : খুবই অপছন্দ আমার। অ্যালবামে গান করে যে তৃপ্তি সেটা এইসব ডিজিটাল সিস্টেমে কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। আমার বাসায় এখনো বিশাল সাইজের সিডি প্লেয়ার আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চায়ের মগ হাতে সিডিতে গান শুনি। কিন্তু ডিজিটাল সিস্টেমে আজকাল যেভাবে গান প্রকাশ হচ্ছে আমার তা ভালো লাগে না। আজকাল তো দেখি একটা গান নিয়েও অ্যালবাম হয়ে যাচ্ছে! আমাকেও এমন প্রস্তাব দেয়া হয়েছে আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। এইসব নিয়েও সোচ্চার হওয়া উচিত। সিনিয়র, গুণী শিল্পীদের খোঁজ রাখছে না কেউ। চাকচিক্যে মজে গিয়ে যাকে তাকে প্রমোট করা হচ্ছে। এটা হতাশার।
জাগো নিউজ : আপনার নতুন গান নিয়ে বলুন-
ন্যানসি : এই মুহূর্তে বেশ কিছু গান করছি চলচ্চিত্রের জন্য। আর সম্প্রতি ‘পাগল তোর জন্য রে-২’ গাইছি। এখানে আমার সঙ্গে গাইবে এস এ কিরণ। ‘পাগল তোর জন্য রে’ গানটিও কিরণের গাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু এ নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছে আপনারা জানেন। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। কিরণের ইচ্ছে ছিলো ‘পাগল তোর জন্য রে’ সে আমার সঙ্গে গাইবে। কিন্তু পারেনি। তাই আমি নিজেই বলেছি তুমি ‘পাগল তোর জন্য রে-২’ রেডি করো। আমি তোমার সঙ্গে গাইবো। তাই গানটির আয়োজন করা। আশা করছি প্রথমটিকে ছাড়িয়ে যাবে দ্বিতীয়টির জনপ্রিয়তা।
জাগো নিউজ : আপনার নিজের গাওয়া পছন্দের কিছু গান-
ন্যানসি : নিজের গাওয়া সব গানই আমার পছন্দের। তারমধ্যে ‘পৃথিবীর যতো সুখ’, ‘ভুবনডাঙার হাসি’, ‘ভিতর বলে বাহির বলে’, ‘আমি তোমার মনের ভেতর’, ‘দুই দিকে বসবাস’ ইত্যাদি গানগুলো খুব প্রিয়।
জাগো নিউজ : আপনার নিজের গাওয়ার বাইরে প্রিয় গান কী কী?
ন্যানসি : রুনা লায়লার ‘অনেক বৃষ্টি’, সাবিনা ইয়াসমিনের ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, সামিনা চৌধুরীর ‘চন্দ্র সূর্য’, শাকিলা আপার কিছু গান খুব প্রিয়। আবার ‘যে ছিলো দৃষ্টির সীমানায়’ গানটিও অদ্ভুত রকমের ভালো লাগে।
জাগো নিউজ : আপনার প্রিয় খাবার.....
ন্যানসি : চালের রুটি ও গরুর মাংস আমার খুব প্রিয়।
জাগো নিউজ : সামনেই ভালোবাসা দিবস। ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলুন আপনার কাছে ভালোবাসার ব্যাখ্যা কী?
ন্যানসি : আমার কাছে ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভালোবাসা তার মতো। কিছুই মানে না। না নিয়ম, না সংজ্ঞা, না ব্যাকরণ। আমি গান ছেড়ে দিতে চাইলাম কিন্তু গান আমাকে বারবার টেনে আনে। এটাও একরকম ভালোবাসা। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার স্বামী আমার ভালোবাসে, আমার বাচ্চারা আমায় ভালোবাসে- এটাই শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা।
জাগো নিউজ : স্কুল-কলেজ জীবনে ভালোবাসা নিয়ে মজার কোনো স্মৃতি-
ন্যানসি : হা হা হা। এগুলো নস্টালিজিক বিষয়। ভাবতে ভালো লাগে। অনেক গল্পই আছে। একটা বলি। তখন স্কুলে পড়ি। গান বাজনা করি নিয়মিতই। বিভিন্ন রকম ফাংশানের সঙ্গে জড়িত। এলাকায় মোটামুটি পরিচিত একটা মেয়ে। অনেক ছেলেরাই মন জয় করতে চাইতো। প্রায় সময়ই বাসায় অনেক কিছুই রেখে যেত ছেলেরা। একবার কে যেন একটা প্রেমময় চিঠি রেখে গেল। সেখানে শেষ লাইনে লিখেছিলো ইতি বুঝে নিও। এই চিঠি গিয়ে পড়লো মায়ের হাতে। এবার তো তিনি রেগে আগুন। বারবার জানতে চাইছেন কে এই ছেলে। আমি যতোই বলি আমি চিনি না মা বিশ্বাস করেন না। তার কথা হলো যদি নাই চিনবো তবে বুঝে নেয়ার কথা লিখলো কেন! কী যে ভীষণ বিপদে ফেলেছিলো আমাকে সেই বীর প্রেমিক। আজও মনে পড়লে হাসি পায়।
জাগো নিউজ : বেশ মজার গল্প। আচ্ছা, দেশের বাইরে তো অনেকবার গিয়েছেন। কোথায় ঘুরে বেড়াতে ভালো লেগেছে?
ন্যানসি : আমি দেশের বাইরে গেলে ঘরেই বসে থাকি। আমার ঘুরাঘুরি ভালো লাগে না। বরং ময়মনসিংহের নিজের বাসা থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের দৃশ্যই আমাকে বেশি মুগ্ধ করে।
জাগো নিউজ : গান, পরিবার, ব্রহ্মপুত্র নদসহ প্রতিটি অনুসঙ্গের মুগ্ধতা নিয়ে কেটে যাক জীবন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
ন্যানসি : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। সেইসঙ্গে জাগোনিউজ ও তার পাঠকদের জন্য শুভকামনা।
এলএ