মুগ্ধতার ৮৩ বছরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়!
বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি তিনি। এই উপমহাদেশে যে ক’জন অভিনেতা মেধায় আর সাবলীলতায় অভিনয়কে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তাদের মধ্যে অন্যতম একজন চির তরুণ নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
জাদরেল এই অভিনেতা জীবনের ৮২টি বসন্ত কাটিয়ে দিয়েছেন সাফল্যের মুগ্ধতায়। আজ বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি তিনি পা রাখলেন ৮৩ বছরে। কিংবদন্তিকে জাগো নিউজ পরিবারের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
৫৬ বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে প্রায় তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এখনো করে চলেছেন নিয়মিতভাবে। সর্বশেষ ‘বেলাশেষে’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের অনুরাগীদের।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একই সঙ্গে অভিনেতা, নট ও নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি। তার চিত্রশিল্পী পরিচয়ও সবাইকে মুগ্ধ করেছে। একসময় ‘এক্ষণ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তবে নিজের অভিনয় প্রিতীর কথা জানিয়ে সৌমিত্র গেল বছর ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘সেই শৈশব কাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ।’
নিজের অভিনয় শুরু নিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবা একজন সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল তার। কিন্তু তখনো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্নটি ওঠেনি। সে কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। এ সব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে। বাবা আমাকে বোঝাতেন কীভাবে অভিনয় করতে হয়, আবৃত্তি করতে হয়। এভাবে চিন্তার ক্রমাগত উৎকর্ষতায় পরবর্তীতে কলকাতায় শিশির কুমার ভাদুরীর অভিনয় দেখে অভিনয়ের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ বাড়ে। কথার একটু মোড় ঘুরিয়ে তিনি বলেন, অভিনয় যে করব, সে অঙ্গনের মানুষের ভালবাসা কাড়ব, সে নিয়ে আমার মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা ছিল। আপনারা নিশ্চয়ই আজকের এই প্রতিষ্ঠিত সৌমিত্রকে দেখে ভাবছেন এমন একজন লোকের অভিনয়ে আসার ক্ষেত্রে হীনমন্যতা কেন? কারণ ছেলেবেলায় আমি দেখতে তেমন সুদর্শন ছিলাম না। ভাবতাম সংকোচ ও রুগ্ন দেহ নিয়ে কীভাবে আমি এই পথ পাড়ি দেব?’
সৌমিত্র আরো বলেন, ‘এম এ পড়াকালীন পথের পাঁচালি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন জগদ্বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তিনি এর দ্বিতীয় পর্ব ‘অপরাজিত’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবতে শুরু করেন। এটার জন্য একজন অভিনেতা খুঁজতে লাগলেন। সত্যজিৎ বাবু তার সহকারীর বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারেন আমার নাম। আমি তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও কাজ করি। অভিনয়ের প্রতি বেশ আগ্রহী। তা জেনেই তিনি আমাকে ডাকলেন। গেলাম। সত্যজিৎ বাবু আমাকে দেখামাত্র বললেন, ‘আরে না না তোমার বয়সটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।’ প্রথমে না করলেও পরে নিজেই আগ্রহভরে নিলেন। সুধীজনের আগ্রহ ও দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় ছবিটির পর তিনি আবার পরবর্তী সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত দেন। সেটির নাম ‘অপুর সংসার’। আমার সঙ্গে কোনোরকম কথা না বলেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অপুর সংসারে আমার কাজ করতে হবে। এভাবেই শুরু। তার পর একের পর এক হাঁটা অভিনয় জগতে।’
উপমহাদেশের কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিত রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয় করে ১৯৫৮ সালে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের। এরপর সত্যজিতের ১৪টি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। তপন সিনহার ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, অসিত সেনের ‘স্বয়ংম্ভরা’, পাশাপাশি মৃণাল সেনের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘আকাশকুসুম’, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ’ ছবিতে নানা ধরনের চরিত্রে সৌমিত্র অনায়াস বিচরণ করেছেন।
১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কবি ও নাট্যকার দ্বীজেন্দ্রলাল রায়ের শহর নদীয়ার কৃষ্ণনগরে তার জন্ম। নাট্যচর্চার এই তীর্থক্ষেত্রেই গড়ে উঠেছিল তার নাটক করার মানসিকতা। ছাত্রজীবনেই নাটকে অভিনয় শুরু। কলেজ জীবনে অহীন্দ্র চৌধুরী ও পরবর্তী সময়ে নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ির সান্নিধ্যে এসে অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যাপারে সৌমিত্র মনস্থির করে নিয়েছিলেন।
তবে প্রথমে আকাশবাণীতে কিছুদিনের জন্য ঘোষক হিসেবে কাজ করেছিলেন এই বাংলা চলচ্চিত্রের কালজয়ী অভিনেতা।
নায়ক হিসেবে তিনি তার সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। তেমন করে তাই কারো সঙ্গে জুটি গড়ে উঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘দত্তা’ ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক অভিনেতা। তেমনি করে সাবিত্রি, সুপ্রিয়া, অপর্ণারাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।
জীবনের যে মুগ্ধতা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি, আরো কেটে যাক অনেকগুলো যুগ। জীবনের শতবর্ষে সৌমিত্র ভরাট কণ্ঠে পাঠ করুন নিজের লেখা কোনো প্রেমের কবিতা। আজকের চমৎকার দিনটিতে তার ভক্ত-অনুরাগীদের নিশ্চয়ই এই প্রত্যাশা।
এলএ