বিতর্কিত বিজ্ঞাপন দিয়ে সমালোচনায় অ্যাডকম
শিল্প বিপ্লবের ইতিহাসে ফিলিপ কটলারের মতো মানুষেরা পণ্যের প্রসারে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছেন। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী নানামাত্রিক বিজ্ঞাপনের ভাবনা ও উপস্থাপনা লক্ষ করা গেছে। তার মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য উপায়টি হলো টিভিসি।
অনলাইনের এই যুগে ইউটিউবে চোখ রাখলেই দেখা যায় বিশ্বের নানা দেশে অসংখ্য নান্দনিক বিজ্ঞাপনের ভিডিও। হৃদয় ছোঁয়া থিম, আইডিয়াতে নির্মাণের মুন্সিয়ানায় সেসব বিজ্ঞাপনচিত্রগুলোতে পণ্যের প্রচারণাই প্রাধান্য পেয়েছে। পাশাপাশি পণ্যটির সামাজিক দায়বদ্ধতা, পণ্যের প্রতিষ্ঠানটির উন্নত মানসিকতারও প্রচার করা হয়েছে।
সেই ধারাবাহিকতায় যখন থেকে বাংলাদেশে টেলিভিশন এলো, তখন থেকে এদেশের মানুষও টিভিসির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলো। নামি দামি নির্মাতারা দিন দিন বদলে দিয়েছেন এদেশীয় বিজ্ঞাপনের হালচিত্র। একটা সময় আফজাল হোসেন, আনজাম মাসুদরা বিজ্ঞাপনচিত্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ততদিনে বিজ্ঞাপন নির্মাণকেও শিল্পের সঙ্গে তুলনা করার শুরু। এখন এটিকে বিজ্ঞাপন শিল্প বলেই সম্বোধন করা হয়। তাদের হাত ধরে দর্শক যেমন নির্দিষ্ট পণ্যটির সম্পর্কে জেনেছেন তেমনি নান্দনিক উপস্থাপনায় উপভোগ করেছেন সুস্থ ও রুচিশীল বিনোদন।
এই প্রজন্মের পরপরই মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজারা হাল ধরেছেন বিজ্ঞাপনচিত্র শিল্পের। এই নির্মাতাদের হাত ধরে বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছে বিজ্ঞাপন নির্মাণে। এসেছে নতুনত্ব, মুন্সিয়ানাতেও এসেছে বৈচিত্র্যতা। তারা তৈরি করেছেন নতুন একটি প্রজন্মও। সেই প্রজন্মের ভিড়ে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু কিছু নির্মাতা পণ্যের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে গিয়ে তাদের আইডিয়ায় তুলে আনছেন অপ্রাষঙ্গিক আর সামাজিকভাবে গ্রহণের অযোগ্য বা বিতর্কিত কিছু বিষয়।
পাশাপাশি হঠাৎ করেই দেশীয় কোম্পানীগুলো ব্যাক্তি নির্মাতাকে পাশ কাটিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাতা এজেন্সির প্রতি ঝুঁকতে শুরু করলো। ওইসব এজেন্সিই এখন পণ্যের ধরন বুঝে থিম ও আইডিয়া দিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করে থাকে। তারাই বিজ্ঞাপন নির্মাতা নিয়োগ দেয়, তারাই এর প্রচারণাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন করে। স্বভাবতই এখানে শিল্পের ব্যাপারটি হারিয়ে গিয়ে ব্যবসায়ের বিষয়টিই মুখ্য হয়ে উঠেছে। তারই উৎসাহে গেল কয়েক বছর ধরে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থার পরিচালনায় কয়েকটি বিজ্ঞাপন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকম লিমিটেডের নামটি উঠে এসেছে সমালোচনার শীর্ষে। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির হয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করা শাকিব ফাহাদ নামের নির্মাতাও হচ্ছেন বিতর্কিত।
এর আগে অ্যাডকম লিমিটেডের বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের সংলাপ, ভাবনা সমালোচিত হলেও সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ-ইংল্যান্ডের সিরিজের সময় জাতীয় পতাকাকে অবমাননার দায়ে পড়ে নিষিদ্ধ হয়েছে টেলিকমিউনিকেশন রবি’র একটি বিজ্ঞাপন। তুমুল সমালোচনার মুখে রবি বাধ্য হয়েই বিজ্ঞাপনটির প্রচার বন্ধ করেছে। সেইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে দর্শকদের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে অ্যাডকম লিমিটেড ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা শাকিব ফাহাদ।
একইভাবে সাম্প্রতিক কোমল পানীয় অস্কারের বিজ্ঞাপনের জন্যও সমালোচিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠান ও পরিচালক। বিজ্ঞাপনটি প্রচারে এলে এর থিম এবং কোমল পানীয় খাবার জন্য ‘একটু প্রাইভেসি তো দরকার’ সংলাপটি সমালোচনার জন্ম দেয় মিডিয়াতে। পাশাপাশি ক্রিকেটার সাব্বির রহমান ও নায়লা নাঈমকে নিয়ে কোমল পানীয় অস্কারের বিজ্ঞাপনটি উপস্থাপনের জন্যও নিন্দিত হয়েছে। নায়লা নাঈমের মতো বিতর্কিত মডেলের সঙ্গে বিজ্ঞাপনে অংশ নেয়ায় ক্রিকেটার সাব্বিরকে সতকর্তার নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বিজ্ঞাপনটির প্রচার বন্ধ রাখতেও নির্দেশ দিয়েছে বোর্ড। সেইসঙ্গে এই পণ্যটির সঙ্গে নিজের চুক্তি বাতিল করতে সাব্বিরকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে বোর্ড। এখানে পণ্যটির মালিক প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট বিভাগের পাশাপাশি দর্শকদের অভিযোগের কাঠগড়ায় উঠেছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকম লিমিটেড ও নির্মাতা শাকিব ফাহাদের নাম।
অন্যদিকে সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া নারীদের স্তন ক্যান্সার বিরোধী সচেতনতামূলক একটি বিজ্ঞাপনে নায়লা নাঈমের খোলামেলা উপস্থিতি ও তার সংলাপগুলোও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এটিও অ্যাডকমের ব্যানারে নির্মিত হয়েছে।
এর আগে একটি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেও বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলো অ্যাডকম। সেই বিজ্ঞাপনটিতে জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার অনিন্দ্যসুন্দর দ্যোতনাকে অত্যন্ত অযাচিত, অপ্রয়োজনীয়ভাবে স্রেফ আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো বলে অভিযোগ উঠেছিলো অনেকের।
পাশাপাশি সম্প্রতি হিরো আলমকে নিয়ে টিভিসি নির্মাণের জন্য সমালোচিত হয়েছে বাংলালিংকসহ আরো বেশ কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপনগুলোর জন্য সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে দেশীয় তারকারাও আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, হিরো আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একজন কমেডিয়ান হিসেবে পরিচিত। তাকে জোর করে তারকা বানিয়ে কিংবা তারকাদের সঙ্গে তুলনা করে প্রতিষ্ঠিত তারকাদের ও তাদের সৃষ্টিশীলতাকে অপমান করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
এই সমালোচিত বিজ্ঞাপনগুলোর জন্য পণ্যের মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোই মূলত ভোগান্তির শিকার হয়। সেইসঙ্গে আর্থিক ক্ষতিরও। কিন্তু টিভিসিগুলো নির্মাণের পেছনে যারা সৃষ্টিশীলতার জায়গাটিতে বসে থাকেন তাদের দায় কতটুকু? এ বিষয়ে জানতে অ্যাডকমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র ব্যবস্থাপক এবং এডভারটাইজিং এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এএএবি) অফিস সেক্রেটারি রবিন দত্ত বলেন, ‘আসলে এ দায় একটি সম্মিলিত বিষয়। তবে বিজ্ঞাপনী এজেন্সিগুলোকে এখানে খুব একটা দায়ী করার সুযোগ থাকে না। এই শিল্পে আমরা ব্যবসা করতে এসেছি। দীর্ঘদিন ধরে আমরা ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। অনেক ভালো কাজ যেমন আছে কিছু সমালোচিত কাজও হয়েছে। এটা সব এজেন্সিগুলোরই আছে। কারণ, নিখুঁত হওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর পুরোপুরি নেতিবাচক বা সমাজবিরোধী ভাবনা থেকে কেউই কোনো কাজ করতে চায় না। আমরাও চাইনি। সবসময় বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ রেখেই কাজ করেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশে বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও প্রচারের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই তাই এখানে সমালোচিত হবার ঝুঁকিটাও অনেক বেশি। বিটিভি ছাড়া দেশের সবগুলো টিভি, রেডিও এবং প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা যেখানে এজেন্সিগুলো বিজ্ঞাপন দেয় সেখানে কোনো নীতিমালা মানা হয় না। আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ক্লায়েন্টের চাওয়া অনুযায়ী একটা আইডিয়া দিয়ে বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতেই পারি। ক্লায়েন্ট কিন্তু আমাদের তার চাওয়া, একটা ভাবনার কথা বলে দেয়। সেই আলোকে আমরা পরিকল্পনা করি। যদি প্রচারের নীতিমালা থাকতো তবে গণমাধ্যমগুলো সেটি বিবেচনা করে তারপর বিজ্ঞাপনটি প্রচার করতো। সেক্ষেত্রে সমালোচিত বিজ্ঞাপনগুলো নিশ্চয়ই আটকে যেত। কিন্তু এমনটি হচ্ছে না। গণমাধ্যমগুলো বিজ্ঞাপন থেকেই আয় করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। তাই এসব নিয়ে তারাও সচেতন নয়। একটি সমালোচিত বিজ্ঞাপনের দায় এজন্যই একটি প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনী সংস্থার পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও থাকে। তবে সরকার চেষ্টা করছে একটা ব্রডকাস্টিং নীতিমালা দাঁড় করাতে। আশা করছি শিগগিরই এই বিষয়গুলোর প্রতি আমরা সচেতন হতে পারবো।’
তবে গেল দুই বছরে অ্যাডকমের বিজ্ঞাপনগুলোই সমালোচিত হতে দেখা গেছে। বারবার অ্যাডকমই কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রবিন দত্ত বলেন, ‘দেখুন কাজ বেশি করলে ভুলের পরিমাণটাও হয় বেশি। এটা আমরা আনন্দের সঙ্গে বলতে পারি, দেশে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর মধ্যে আমরা প্রচুর বিজ্ঞাপন নির্মাণ করি। সেখানে অনেক প্রশংসিত বিজ্ঞাপন রয়েছে আমাদের। এই যেমন কক্সবাজারের ক্ষুদে শিল্পী জাহিদকে নিয়ে আমরা রবির টিভিসিটি বানিয়ে অনেক প্রশংসিত হয়েছি। যারা এই বিজ্ঞাপনটির প্রশংসা করেছেন তারাই কিন্তু অন্য বিজ্ঞাপনটির সমালোচনা করছেন। আবার যেগুলো সমালোচিত হচ্ছে সেগুলো আবার কারো না কারো কাছে কিন্তু ভালো লাগছে। তবে একটা নীতিমালা আমরা যখন পাবো, অনেক নেতিবাচক বিষয়ই কমে যাবে।’
সবার প্রত্যাশা, বিভিন্ন পণ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্যের প্রচার-প্রসারে টিভিসি নির্মাণের সময় রুচিবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, দর্শকদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। ভাবনা ও নির্মাণের মুন্সিয়ানায় পণ্যের প্রচারণাও হয়ে উঠবে নান্দনিক শিল্প।
এলএ/পিআর