লোক গানের অ্যালবাম নিয়ে ফিরছেন সাহানা বাজপেয়ী
প্রথাগত রবীন্দ্রসংগীত থেকে অনেকটাই সরে এসে দুই বাংলার তরুণ প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্র গানকে যে ক’জন মানুষ শুদ্ধস্বরে-সুরে-সংগীতে বৈচিত্রের প্রলেপে তুলে ধরেছেন, জনপ্রিয় করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সাহানা বাজপেয়ী। বলতে বাঁধা নেই, সাহানার গলায় রবীন্দ্রসংগীত মুগ্ধ করেছে রবীন্দ্র গানের পুরনো অনুরাগীদেরও।
তবে বরাবরই নিজেকে বৈচিত্রময় গানের মানুষ ভাবতে পছন্দ করেছেন সাহানা। তার কণ্ঠেও শোনা গেছে নানামুখী গান। তিনি নানা রকম গান ও সংগীত সাধকদের নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন নিজেকে ঋদ্ধ করতে। ছুটেছেন এখানে সেখানে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়াতেও তিনি ছুটে এসেছেন ফোক গানকে জানতে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো লোকগানের অ্যালবাম নিয়ে আসছেন সাহানা বাজপেয়ী। আর গানে ফিরছেন ঠিক এক বছর পর।
জীবনের নানা বাঁক পার হওয়া সাহানার মনে বোধহয় প্রশ্নের শেষ নেই। এই সময়টাতে এসে সেইসব প্রশ্ন তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন শ্রোতাদের কাছে। তাই বুঝি নতুন অ্যালবামের নামকরণেও প্রশ্ন রেখেছেন- ‘মন বান্ধিবি কেমনে?’।
ফেসবুকে জানালেন, তার তৃতীয় একক অ্যালবামটি কলকাতার হিন্দুস্থান রেকর্ডস থেকে প্রকাশ পাচ্ছে ২৭ সেপ্টেম্বর। এখানে থাকছে ৮টি লোকগান থাকছে। যাতে লালন-করিম ছাড়াও থাকছে ভবা পাগলার গান। ‘মন বান্ধিবি কেমনে’র সংগীত পরিচালনা করছেন কলকাতার গুণী দুই সংগীতকার স্যমন্তক সিনহা ও সত্যাকি ব্যানার্জি। কিছু গানে বাজিয়েছেন লন্ডনের ফোক গিটারিস্ট মাল ডারউইন এবং জ্যাজ মিউজিশিয়ান ইদ্রিস রহমান।
সাহানা জানালেন, অডিও গানের পাশাপাশি অ্যালবামের কিছু গানের ভিডিও নির্মাণও করা হচ্ছে। ট্রেন্ড বলে একটা ব্যাপার থাকে। সেটাকেই ধারণ করার চেষ্টা করছেন। মানুষ এখন গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে দেখতেও চায়।
শান্তিনিকেতনের ছাত্রী এবং রবীন্দ্রগানের শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সাহানাকে শ্রোতারা ফোক গানে কতোটা গ্রহণ করবে? সাহানার জবাব, ‘বিষয়টা এমন নয় যে রবীন্দ্র গান করলে লোক গান করা যাবে না আবার রীবন্দ্রসংগীত থেকে একলাফে আমি লোক গানের শিল্পী বনে গেছি তাও নয়। শৈশব থেকে শান্তিনিকেতনের অসংখ্য বাউলদের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের কাছে লোকগান শিখেছি। মঞ্চে বরাবরই রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি লোকগান করেছি। শায়ান (অর্ণব), আনুশেহ, বুনোদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে ‘বাংলা’ ব্যান্ড করেছি। সেটির হয়ে লোকগান গেয়েছিও প্রচুর। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই এই সাহস করেছি। হতাশ হবার কিচ্ছু নেই।’
পশ্চিম বঙ্গের মেয়ে হলেও ঢাকাতে সাহানার জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বেশ ভালো। অবশ্য যে সম্পর্কের সূত্রে সাহানা এ বাংলায় সবার মনে জায়গা নিয়েছিলেন সেই সম্পর্কটা চুকেবুকে গেছে। এখন তিনি আর ‘ঢাকার বউ’ নন। জনপ্রিয় গানের মানুষ অর্ণবের সঙ্গে বিবাবহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে তার। নতুন করে রিচার্ড নামে এক বৃটিশ নাগরিক বিয়ে করে লন্ডনে থিতু হয়েছেন। সেই সংসারে রয়েছে রোহিণী নামের এক রাজকন্যাও। তবে সাহানা বিশ্বাস করেন, মানবিক সম্পর্কের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী গানের সম্পর্ক, শিল্প আর সংস্কৃতির সম্পর্ক। সেই সূত্রে এখনো তিনি বাংলাদেশিদের আত্মীয়, বাংলাদেশও তার কাছে চিরকালের বিশেষ ভালোলাগা। আর সেই ভাবনা থেকেই গেল বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার এমই লেভেল থেকে সাহানা প্রকাশ করেছিলেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘যা বলো তাই বলো’। চলতি বছরে সেই ইচ্ছেটা থাকলেও সময়ের অভাবে সম্ভব হবে না। আসা হবে না সাহানার, ঢাকাতেও ঘটা করে প্রকাশ হবে না তার ফোকগানের প্রথম অ্যালবাম।
তবে তবে তার গানে কিন্তু বাংলাদেশ থেকেই যাচ্ছে জগতখ্যাত দুই বাউল সাধক লালন সাঁইজি ও শাহ আব্দুল করিমের গানে গানে। তাই সাহানা, বাংলাদেশি শ্রোতা-ভক্তদেরও আমন্ত্রণ জানালেন ফোক গানে তার প্রথম অ্যালবাম ‘মন বান্ধিবি কেমনে’ শোনার জন্য।
প্রসঙ্গত, শাহানা বাজপেয়ীর ছোটবেলা কাটে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। তার বাবা-মা দুজনই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। শাহানা ১৯৮২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে ছিলেন। সেখানেই তার সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি বাবা বিমল বাজপেয়ীর কাছ থেকে। তিনি মাত্র তিন বছর বয়সেই প্রথম গান শেখেন। পরবর্তীতে তিনি বিজয় সিনহা, চিত্রা রায়, শ্যামলী বন্দোপাধ্যায়, চন্দন মুনশী, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, মধুমিতা রায় এবং মিতা হকের অধীনে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও রবীন্দ্রসংগীত প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী শায়ান চৌধুরী অর্ণবকে বিয়ে করেন সাহানা। তারা একসাথে পড়াশোনা করেছিলেন শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে। বিয়ের সাত বছর পর ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। দীর্ঘ সাত বছর বাংলাদেশে ছিলেন সাহানা। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন।
গেল বছরে বাংলাদেশের ছবিতে প্লেব্যাক করে নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি। রুবাইয়াৎ হোসেনের ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ‘তোমায় গান শোনাব’ ব্শে প্রশংসিত হয়েছে তার কণ্ঠে। আজকাল গান গাইছেন ভারতের বাংলা ছবিতেও।
এলএ/আরআইপি