ফিরোজা বেগম, তোমারে দেব না ভুলিতে
ভারতীয় উপমহাদেশে নজরুল সংগীতের জন্য বিখ্যাত তিনি। তাকে নজরুলসংগীত সম্রাজ্ঞীও বলা হয়। তিনি ফিরোজা বেগম। তিনি কিংবদন্তি। আজ তার জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৮৬তম জন্মদিনে পা রাখতেন।
মাত্র দু’বছর আগে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া এ শিল্পী জন্মেছিলেন ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলায়। শৈশবেই সংগীতের প্রতি ভালোবাসা জন্মে ফিরোজা বেগমের। ১৯৪০-এর দশকে তিনি সংগীতের জগতে আসেন। ফিরোজা বেগম ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গানে কণ্ঠ দেন।
ততদিনে তিনি সংগীতে বিখ্যাত। দু-দুইবার আধুনিক গানের ক্ষেত্রে মাসের সেরা শিল্পী হয়েছিলেন। একবার তার গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনে তাকে গান শেখানোর জন্য পঙ্কজ মল্লিকের মতো শিল্পী ফিরোজা বেগমের কলকাতার বাড়িতে চলে আসছেন। গুণী শিল্পীরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অন্যদিকে তিনি আব্বাসউদ্দিন এবং পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের কাছে অল ইন্ডিয়া রেডিওর জন্য মাঝে মাঝে লোকগীতির তালিম নিতেন। রেডিওতে পাশাপাশি স্টুডিওতে গান গাইতেন তিনি এবং ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ।
অনেক জনপ্রিয় গানের জন্যই তিনি সমাদৃত ছিলেন। তবে তার তীব্র ইচ্ছা ছিলো নজরুলগীতিতেই। তখন নজরুল সংগীত বলা হতো না, বলা হতো আধুনিক গান লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরে সেটা থেকে নজরুলগীতি হয়। আর ফিরোজা বেগমের চেষ্টাতেই তা পায় নজরুলগীতির অভিধা।
তিনিই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গানের অনুষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক করেন। নজরুলগীতিকে জনপ্রিয় করার জন্যই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন অন্য গান নয়, নজরুলের গানই গাইবেন। গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তারা অবাক। ফিরোজার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। তাদের কথা হলো, ‘এত ভালো গলা তোমার! এভাবে নিজের ক্যারিয়ার কেউ নষ্ট করে? তাছাড়া এখন তো আর লোকে সেভাবে নজরুল সংগীত শোনে না। ভেবে দেখ কী করবে!’ কিন্তু ফিরোজা বেগম অবিচল। গাইলে নজরুলগীতি। সেটাই হবে তার ধ্যান ও জ্ঞান। অগত্যা হতাশ হতে হচ্ছে সবাইকে।
নজরুলের গান নিয়ে প্রকাশিত প্রথম রেকর্ডের কথা বলতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি আমার গলায় নজরুলের গান রেকর্ড করতে রাজি হয়। তখন আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা... গেয়েছিলাম। পুজোর রেকর্ডের ক্ষেত্রেও আমি একই সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছি । এজন্য আমাকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত জয় আমারই হয়েছে। কোম্পানি পুজোয় আমার গাওয়া নজরুল সংগীতের রেকর্ড বাজারে ছাড়তে রাজি হয়েছিল।’
১৯৬০ সালের পুজোয় সেই রেকর্ড বেরোয়। তবে দুর্গাপুজোর আগে নয় পরে। সেই রেকর্ডে ফিরোজা গাইলেন সর্বকালের জনপ্রিয় দুটি গান ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ আর ‘মোমের পুতুল’। ফিরোজার জনপ্রিয়তাকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯৬১ সালে তার গাওয়া নজরুলসংগীত নিয়ে লংপে রেকর্ড বেরোয়। ১৯৬৮ সালে আমার গাওয়া ‘শাওন রাতে যদি’র রেকর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে দু’লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায়। এজন্য জাপানের সনি কর্পোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সিবিএস আমাদের গোল্ড ডিক্স দিয়ে সম্মানিত করেছিল তাকে।
এভাবেই চলতে থাকে গানের এই পাখিটির সংগীত সাফল্য যাত্রা। একই সঙ্গে সামলেছেন সংসারও। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ টানা ১৩ বছর ছিলেন কলকাতায়। এই সময়টাকে তিনি নির্বাসন হিসেবেই দেখেন। ওই সময়েই ১৯৫৬ সালে বিরলপ্রজ সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার। কিন্তু নিজের সত্যকেই তিনি সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কলকাতেই জন্মেছে তার তিন সন্তান- তাহসীন, হামিন ও শাফিন। তার দুই পুত্র হামিন ও শাফিন মাইলস ব্যান্ডের জন্য বিখ্যাত। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই পিজি হাসপাতালে মৃত্যু হয় কমল দাশগুপ্তের। মাত্র ১৮ বছরের সুরময় দাম্পত্যের ইতি ঘটে। এর আগে বাচ্চাদের কথা, স্বামীর চিকিৎসার কথা ভেবে ১৯৬৭ তে তিনি দেশে ফিরলেন। আসতে না আসতেই পড়েছিলেন দুর্বিপাকে। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছিল টেলিগ্রাম। বিভিন্ন সময়ে নানা সংকটে জর্জরিত ছিলো তার জীবন।
ফিরোজা বেগম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৮০টিরও বেশি একক সংগীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। নজরুলসংগীত ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত-সহ বিভিন্ন ধরনের সংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন। জীবদ্দশায় তার ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে।
দীর্ঘ সংগীত চর্চার জীবনে তিনি পেয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা। পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও স্বীকৃতি। তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ টিভি শিল্পী পুরস্কার (পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ স্বর্ণপদক, দীননাথ সেন স্বর্ণপদক, সত্যজিৎ রায় স্বর্ণপদক, বাচসাস পুরস্কার, সিকোয়েন্স পুরস্কার ইত্যাদিতে ভূষিত হয়েছেন। তবে কোন কারণে তার মতো কিংবদন্তিকে একুশে পদক দেয়া হয়নি সে এক অমীমাংসিত রহস্যই বটে। এ নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্ষোভ আছে অনেক।
তবে সকল ক্ষোভের উর্দ্ধে থাকা ফিরোজা বেগম চিরকাল রইবেন আমাদের অন্তরে অন্তরে। তার কণ্ঠে নজরুলের গানের মতোই চিরতরে দূরে সরে গেলেও ফিরোজা বেগমকে বাংলা গানের মানুষ দেবে না ভুলিতে...
এলএ/আরআইপি