ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তানেরই ক্ষতি
কাশ্মীর উপত্যকা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ চরমে। বিশ্ব রাজনীতিতে এই দুই দেশে বিরাজমান আগ্রাসী অবস্থান উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ভারতে বিজেপি শাসিত মোদি সরকার সেদেশের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরকে স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যের মর্যাদা বিলুপ্ত করে। যার ফলে কাশ্মীর এখন থেকে চলবে কেন্দ্রীয় সরকারের আঙুলের ইশারায়।
ভারতের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফুঁসছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভারতের সাথে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তারা ছিন্ন করেছে ভারতের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্কও।
পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছে ভারতের তথা বলিউড সিনেমা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক বিশেষ দূত ফিরদৌস আশিক আওয়ান সেদেশের জিও নিউজকে এমন তথ্য জানান।
পাকিস্তানে বলিউড সিনেমা নিষেধাজ্ঞা নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানে ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল। বছরের হিসেবে সেটা হবে ৪০ বছর। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে মূলত পাকিস্তান নিষিদ্ধ করেছিল ভারতীয় ছবি। ২০০৫ পরবর্তী সময়েও কয়েকদফা পাকিস্তান বলিউড ছবি নিষিদ্ধ করে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পুলওয়ামা কাণ্ডে সাময়িক নিষিদ্ধ হয়েছিল বলিউড ছবি। এতে প্রত্যেকবারই লোকসানটা হয়েছে পাকিস্তানের।
কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতিতে বলিউড ছবি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। বিবিসির দেয়া তথ্য মতে, সেদেশের চলচ্চিত্র রাজস্বের ৭০ শতাংশ আসে ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে। তার মানে, পাকিস্তানের সিনেমা হলগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে ভারতীয় সিনেমা।
কেননা, সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখার জন্য বছরে যতগুলো ছবি প্রয়োজন ততগুলো ছবি পাকিস্তানে নির্মিত হয় না।
যে চার দশক পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি নিষিদ্ধ ছিল সে দশকগুলোতে পাকিস্তানের অনেক সিনেমা হল লোকসানের মুখ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের এখন যেমন সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন নির্মিত হচ্ছে, পাকিস্তানেও সেসময় সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ভবন, শপিং কমপ্লেক্স বানানো হয়েছে।
পাকিস্তানে গড়ে প্রতি বছর ১৫টি সিনেমা নির্মিত হয়। এই সিনেমাগুলো দুই সপ্তাহ করে ১২০টি সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়। এই স্বল্প সংখ্যাক ছবি দিয়ে সেখানকার সিনেমা হল মালিকরা লাভের মুখ দেখতে পারছেন না। কারণ, পাকিস্তানের খুব কম ছবি আছে যেগুলো দুই সপ্তাহ অব্দি দর্শক টানতে পারে। সেজন্য পাকিস্তানের হল মালিকরা ভারতীয় ছবিকে ত্রাতা হিসেবে ভেবে থাকেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, পাকিস্তানের অধিকাংশ হল মালিক মনে করেন, সিনেমা কখনোই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে না। শুধু হল মালিক নয়, সাধারণ মানুষও তাই মনে করেন।
পাকিস্তান যদি আবারও স্থায়ীভাবে বলিউড ছবি নিষিদ্ধ করে তাহলে এখন যে সিনেমা হলগুলো টিকে আছে সেগুলোও থাকবে কিনা সন্দেহ! এমনকি পাকিস্তানি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি অনেক অর্থলগ্নিকারক হারাবে।
পাকিস্তান সরকার ২০০৫ সালে যখন ভারতীয় ছবির ওপর থেকে নিষেধজ্ঞা তুলে নিয়েছিল তখন পাকিস্তানের সিনেমায় বেশ কিছু প্রযোজকের আবির্ভাব হয়েছিল, যারা চেয়েছিলেন বলিউডের সাথে তাল মিলিয়ে মানসম্মত সিনেমা নির্মাণ করতে। যদিও তারা সে চেষ্টায় এখনো সফল নন। তবে তাদের সিনেমায় কারিগরি দিক অনেক উন্নত হয়েছে।
বলিউডে অনেক পাকিস্তানি শিল্পী ক্যারিয়ার গড়েছেন। পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। পাক-ভারত বৈরি সম্পর্কের কারণে তাদের বলিউড ক্যারিয়ারও হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারে। আগে যে তাদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়েনি তা কিন্তু নয়। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পুলওয়ামা কাণ্ডে ভারতের সর্বভারতীয় সিনে ওয়ার্কার্স সমিতি পাকিস্তানি অভিনেতা-কলাকুশলীদের বলিউডে কাজ করার ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে করে পাকিস্তানের অনেক শিল্পীই বিব্রত হয়েছেন, বিরক্ত হয়েছেন নিজের দেশের উপর।
এদিকে আবারও ওই সংগঠনটি ভারতে পাকিস্তানি শিল্পীদের কাজ বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকার বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে।
বোঝাই যাচ্ছে, চলচ্চিত্র নিয়ে দুই দেশের অবস্থান বিপরীতমুখী। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। তাদের এমন প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ বৈশ্বিক চলচ্চিত্রের জন্য প্রচন্ড রকমের ক্ষতিকর।
কারণ, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে চলচ্চিত্রের বিশ্বায়ন অত্যন্ত জরুরি। কোনো দেশের চলচ্চিত্রকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা অনুচিত। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি বানানো উচিত নয় চলচ্চিত্রকে। প্রতিযোগিতা না থাকলে কোনো দেশের চলচ্চিত্র কখনো এগিয়ে যেতে পারে না।
বিশ্বাব্যাপী বলিউড সিনেমার যে বাজার রয়েছে তা তৈরি হয়েছে একমাত্র প্রতিযোগিতার কারণে। বলিউড নিয়িমিত হলিউড কিংবা তাদের স্বদেশীয় দক্ষিণী ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে।
এদিকে কলকাতার চলচ্চিত্র একটা সময় বাংলাদেশের থেকে নীচু অবস্থানে ছিল। তাদের ভেতর যখনই প্রতিযোগিতার মনোভাব চলে এলো তখন থেকেই তারা উন্নত হতে শুরু করলো। এখন তো তারা বলিউডের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
সুতরাং বলা যায় পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি। এতে করে পাকিস্তানে ক্ষতি ছাড়া উপকার হবে না কিছুই। তাই পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের মুক্ত আকাশে দেয়াল টেনে দেয়ার সিদ্ধান্ত বদলানো উচিত। এছাড়া অনেকেই মনে করছেন দুই দেশের সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি পারে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে ধুলিসাৎ করে দিতে। এটা বারবার হয়েছে। আবারও হতে পারে। ভূমিকা রাখতে পারেন দুই দেশের জনপ্রিয় ও কিংবদন্তী শিল্পীরা।
লেখক : রেজওয়ান সিদ্দিক অর্ণ
সাংবাদিক
সারাবাংলাডটনেট
এলএ/এমকেএইচ