হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে ভারতে বির্তক তুলেছে ‘মুল্ক’
বলিউডের নতুন ছবি ‘মুল্ক’ ভারতের একটি মুসলিম যৌথ পরিবারের জীবনকে যেভাবে তুলে ধরেছে তা দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
চারদিন আগে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে বেনারসের একটি মুসলিম পরিবারের চিত্র, যাদের এক সন্তান সন্ত্রাসবাদী পরিচয়ে নিহত হওয়ার পর গোটা পরিবারের ওপর দিয়ে যেভাবে ঝড় বয়ে যায়, কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের- তা নিয়েই এই সিনেমার গল্প।
সত্যি ঘটনার ওপর নির্ভর করে তৈরি এই ছবি দেশজুড়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই ছবিটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, অ্যাক্টিভিস্ট বা সমাজকর্মীরা মিডিয়াতে কলম ধরে ব্যাখ্যা করছেন কেন মুল্ক তাদের চোখে জল এনে দিয়েছে।
পাশাপাশি ছবির পরিচালক অনুভব সিনহাকে অনেকের কাছেই এই অভিযোগও শুনতে হচ্ছে যে, তিনি মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল কিংবা মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের টাকায় ছবি বানান! মুসলিমদের প্রতি ভারতীয় সমাজের এই বাস্তব চিত্র তুলে ধরার বিষয়টি সহ্য হচ্ছে না কারো কারো। যে কারণেই পরিচালকের এই সমালোচনা।
গত ৩ আগস্ট পুরো ভারতজুড়ে মুক্তি পেয়েছে পরিচালক অনুভব সিনহার সিনেমা মুল্ক, যিনি এর আগে তেরে বিন বা রা-ওয়ানের মতো সম্পূর্ণ বিনোদনধর্মী ছবি বানানোর জন্যই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মুল্ক ছবিতে তিনি এনেছেন ইসলামোফোবিয়ার কাহিনী, যে পরিবারের একটি ছেলে উগ্রবাদী হয়ে যায়। সমাজে তাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কাহিনী।
ছবির একটি সংলাপে অভিনেতা ঋষি কাপুরকে বলতে শোনা যায়, ‘যতদিন পাকিস্তানের জয়ে ভারতে একটি মুসলিম পরিবারও উল্লাস করবে ততদিন তাদের মহল্লার দেওয়ালে পাকিস্তানি লেখা থাকবেই।’ কিংবা আদালতে সরকারি কৌঁসুলি বলেন, ‘মুসলিম পরিবারে অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয় বলে তাদের এক-আধটাকে জিহাদের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়।’
মুসলিমদের প্রতি ভারতীয় সমাজের এই ‘মানসিকতা’ই ছবিটির বিষয়বস্তু।
এই ছবির রিভিউ লিখতে গিয়ে সাংবাদিক সাবা নাকভি বলেছেন, ‘মুল্ক অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছে- এবং যখন আসামে চল্লিশ লাখ বাসিন্দার নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠছে তখন এই ছবি বোধহয় আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।’
অ্যাক্টিভিস্ট রানা সাফভি লিখছেন, ছবির প্রোটাগোনিস্ট মুরাদ আলি- যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঋষি কাপুর, তাকে যেভাবে ভারতের জন্য দেশপ্রেম প্রমাণ করতে হয় তা দেখে চোখ বারে বারে ভিজে উঠেছে।
‘মাদারিং আ মুসলিম’ বইয়ের লেখিকা ও গবেষক নাজিয়া এরাম বলেন, এই ছবিতে সাঙ্ঘাতিক একটা সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে, আমার ঘরেই আমাকে স্বাগত জানানোর তুমি কে হে? এটা তো আমারও ঘর। অর্থাৎ হিন্দুরা বিরাট উদারতা দেখিয়ে ভারতে মুসলিমদের থাকতে দিযেছে - এই চিন্তার গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছে এই সিনেমাটি।
তিনি বলেন, ‘ছবির দ্বিতীয় যে জিনিসটা আমাকে ভাবিয়েছে তা হল সন্ত্রাসবাদ মানে শুধু কারও জীবন নেয়া নয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক ফায়দা লোটার জন্য যখন কাউকে ভয় দেখানো হয়, হুমকি দেয়া হয় সেটাও কিন্তু সন্ত্রাসবাদ!’
ফলে ছবির মুক্তির আগে থেকেই কেন পরিচালক অনুভব সিনহাকে নিয়ে কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল হচ্ছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। মুসলিমদের প্রতি সমাজের এই চিত্র তুলে ধরেই একটি শ্রেণির চক্ষুশূল হয়েছে পরিচালক। ‘দাউদ ইব্রাহিমের টাকায় ছবি বানাচ্ছেন’ বা ‘পাকিস্তানের দালালি করছেন’ - এই জাতীয় অভিযোগ উঠছে তার নামে। সে সবের জবাবে তিনি অবশ্য খোলা চিঠি লিখে বলেছেন, ‘আপনাদের মনিবদের জন্য আমি এই ছবি বানাইনি।’
তিনি বলেন, পরিচালক হিসেবে তার কাজ প্রশ্ন তোলা, উত্তর দেয়া নয়। তার কথায়, ‘অনেকে ছবিটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলেও আসলে এটা রাজনীতির ছবি নয়, বরং আবেগের ছবি, কোর্টরুম ড্রামার ছবি। হ্যাঁ, ‘মুল্ক’ প্রশ্ন তুলেছে ঠিকই- কিন্তু উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেনি। উত্তর খোঁজার ভার দর্শকেরই।’
ছবির অন্যতম অভিনেত্রী তাপসী পান্নু আবার ছবি রিলিজ করার সময়েই সরাসরি বলেছিলেন, ভারতে একটা বিশেষ ধর্মের মানুষকে যেভাবে আক্রমণের নিশানা করা হচ্ছে সেটাই তাকে এই ছবি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
নাজিয়া এরামও মনে করেন, ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের সূক্ষতাকে দারুণ ভারসাম্যে ধরেছে এই ফিল্ম।
তিনি বলছেন, ‘ছবির শুরুতেই দেখি মুসলিম পরিবারে উৎসব আর খানাপিনা চলছে- আর তাদের নিরামিশাষী হিন্দু পড়শীরা বলছে আমরা তো ওদের বাড়িতে খাই না। আবার একই ছবিতে দেখি বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দাঙ্গায় সেই হিন্দু প্রতিবেশীরাই ওই পরিবারটিকে সারা রাত জেগে রক্ষা করেছিল। এই জটিল সহাবস্থানের রসায়নেই কিন্তু লুকিয়ে আছে আমাদের ছেলেবেলা!’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে লেখালেখি বা আলোচনা কম হয়নি। কিন্তু সেই আবহে একটি মুসলিম পরিবারের চোখে ভারত নামক মুল্কের চেহারা কীভাবে বদলে যাচ্ছে, তারই মর্মস্পর্শী গল্প বলেছে এই সিনেমাটি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এমবিআর/জেআইএম