ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিনোদন

হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটকের শিল্পপ্রবণতা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ | প্রকাশিত: ০৪:০৭ পিএম, ১৯ জুলাই ২০২৩

হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগ থেকে শুরু করে আজকের ওটিটির যুগেও তাঁর নাটক দর্শকনন্দিত। সুতরাং বলাবাহুল্য, হ‌ুমায়ূন আহমেদ একটি সফল জীবন কাটিয়েছেন। নির্মাতা হিসেবেও তাঁর সাফল্য ছুঁয়েছে বিশাল দর্শকের মন। তাঁর তুলনা তিনিই। বাংলা সাহিত্যে এমন রত্ন আর আসবে কি না, জানি না। বাংলা টিভি নাটকে তাঁর সমতুল্য কেউ আছে কি না, সেটাও এখন গবেষণার বিষয়।

তাঁর নাটকে বিদেশি, পাগল, কবিরাজ, চোর, গৃহকর্মী, ভবঘুরে, কবি, দার্শনিক, খাদক, গায়েনসহ সব শ্রেণির মানুষই উঠে এসেছে। সবচেয়ে গভীর ভাবনার বিষয়, একজন খাদক বা চোরকেও তিনি মহত করে তুলছেন নাটকে। গ্রামের ভবঘুরে একটি যুবকও হয়ে ওঠেন নাটকের প্রধান চরিত্র। তার মুখের সংলাপ ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। মূলত একটি সমাজে সব শ্রেণির মানুষই যে গুরুত্বপূর্ণ-এটা বোঝাতেই তিনি সব শ্রেণির চরিত্রকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।

খাদক নাটকে দেখা যায়, মতি মিয়ার সম্পর্কে জেনে এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি খোন্দকার সাহেব আস্ত গরু খাওয়ার বাজি ধরেন। মতি মিয়াও রাজি হয়ে যায়। সামিয়ানা টানানো হয়, ব্যান্ড পার্টি বাজে, গরু রান্না হয়, মতি মিয়া খায়। এটি হার-জিতের চ্যালেঞ্জ, মান-সম্মানের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সব সময় চলমান। আশেপাশের লোকজন মতি মিয়াকে দেখছেন। আর মতি মিয়ার ছেলে অভুক্ত অবস্থায় তার বাবাকে দেখছে। এই নাটকে হ‌ুমায়ূন আহমেদ যেভাবে সমাজের ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যকে তুলে ধরেছেন, তা অনবদ্য। এভাবেই তিনি প্রতিটি নাটকে সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে অসামান্য কাহিনি নির্মাণ করেছেন।

তাঁর প্রতিটি নাটকে এক বা একাধিক গৃহকর্মীর সন্ধান মেলে। যারা নাটকের কাহিনিতে নিজের উপস্থিতি সগৌরবে জানান দেন। গল্পের ভিত্তিকে মজবুত করে তোলেন। নাটক্যার ও নির্মাতা হিসেবেও হ‌ুমায়ূন আহমেদ তার গৃহকর্মীকে মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছেন। তাঁর নাটকে ব্যান্ড পার্টি, বিয়ে বাড়ির সাজ, গায়েন দল, গ্রামীণ খেলাধুলা বা বিয়ের গান স্থান পেয়েছে। প্রায় প্রতিটি নাটকেই গানের দল দেখতে পাওয়া যায়। যারা একটি ভিন্নধর্মী গান উপস্থাপন করেন। কাউকে সংবর্ধনা জানানো, বরযাত্রীর সঙ্গে কিংবা আনন্দ-উল্লাসে ব্যান্ড পার্টিকে সঙ্গী করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো

কাহিনি বা চরিত্র নির্মাণে তিনি অনবদ্য, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে হিসেবে তার প্রতিটি নাটক শিল্পসফল। এমনকি হ‌ুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত অভিনয়শিল্পীদের পাশাপাশি নতুন অভিনয়শিল্পীও আবিষ্কার করেছেন। তিনি চ্যালেঞ্জার, ডা. এজাজুল ইসলাম, শামীমা নাজনীন, মনিরা মিঠুদের মতো অভিনয়শিল্পী আবিষ্কারে সফল হয়েছেন। শিশুশিল্পীদের দিয়েও তিনি চমৎকার অভিনয় করিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের এমন সাবলীল অভিনয় প্রথিতযশা অভিনয়শিল্পীদেরও অবাক করেছে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সৃষ্টি অভিনেতা চ্যালেঞ্জার। এরপরে আবিষ্কার করেন চ্যালেঞ্জারের ছোট বোন মুনিরা মিঠুকে। বড় ভাইয়ের মতো মুনিরা মিঠুরও ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল হ‌ুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। তার প্রথম নাটক ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’। পরে হ‌ুমায়ূন আহমেদের ‘বুয়া বিলাস’, ‘বৃক্ষ মানব’, ‘দুই দুকোণে চার’, ‘জুতা বাবা’সহ বেশ কিছু নাটকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেন মুনিরা মিঠু। এ ছাড়া কুদ্দুস বয়াতী, বারী সিদ্দিকীসহ বেশকিছু শিল্পী আবিষ্কার করেছেন টিভি নাটকের কল্যাণেই। তাদের কণ্ঠে বিখ্যাত হয়েছে কিছু গান। শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো এখনো মানুষের কণ্ঠে গীত হয়।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের নাটকে উপস্থাপিত ‘মুসলিম রীতি-নীতি’র বিষয়গুলো ভেবে দেখার মতো। আমরা বরাবরই বাংলাদেশের সিনেমা-নাটকে ইসলাম ধর্মের বিষয়কে খুব বেশি উপস্থাপন করতে দেখি না। তবে হ‌ুমায়ূন আহমেদ এ যাত্রায় সফল হয়েছেন। তাঁর ‘তিন প্রহর’ নাটকে আমরা দেখেছি, ডান পা ফেলে যাত্রা শুরু করা, কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা, কোরআন ছুঁয়ে আশির্বাদ নেওয়া, দাফনের আগে কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর কসম বলা, শোকরানা নামাজ, বিপদে কালেমা পড়া, মিলাদ পড়া, কবর বন্ধ করার নিয়ম এবং আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করার বিষয়গুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মূলত মুসলিম পরিবারগুলোতে যেসব রীতি-নীতি সচরাচর পালিত হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন: আল মাহমুদের কবিতা: প্রেমের নতুন রূপ

কাহিনি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা অসম্ভব ভালো কিছু নাটক উপহার দিয়েছে আমাদের। একটি মৃতদেহ, একটি পিঁপড়া বা একটি ফুলকে কেন্দ্র করেই সার্থক একটি নাটক রচনা করতে পেরেছেন তিনি। তাই তাঁর নাটকগুলো আলাদা গল্পের, আলাদা ধাচের, আলাদা স্বাদের। সেই সঙ্গে নাটকের সংলাপেও অনবদ্য ছিলেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। কয়েকটি সংলাপে চোখ বোলালেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে-
১. কিছু দোয়া-কালাম পড়েছিলাম। আপনাকে একটা ফুঁ দেই? (বুয়া বিলাস)
২. আমরা যারা ফেল করেছি, তারা এখন কী করবে? (গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড)
৩. গাঞ্জা খেয়ে কুল পাই না, লেখাপড়া করবো কখন? (বৃক্ষ মানব)
৪. মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। (কোথাও কেউ নেই)
৫. বিপদ দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। (কোথাও কেউ নেই)
৬. ইয়া মুকাদ্দিমু বলে ডান পা আগে বাড়াও। (উড়ে যায় বকপক্ষী)
এমন অনেক সংলাপ এখনো মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে তাঁর প্রত্যেকটি সংলাপই যেন পথপ্রদর্শক।

তাই বলা যায়, জীবনের গুরুভারকে লঘু করা কিংবা বেদনাময় অপূর্ণতায় ঢাকা মহাজীবনকে তিনি হাস্য-কৌতুকরসে খানিকটা ভারমুক্ত করে দেখার অভিনব টেকনিক গ্রহণ করেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্তের যাপিত জীবনের প্রাত্যহিকতার অনুপম উপস্থাপন দেখা যায় তার অনবদ্য সৃষ্টিকর্মে। জীবনকে সহজ এবং ইতিবাচক করে দেখার বিশিষ্টতা ছিল তাঁর। ভবঘুরে জীবন কিংবা জীবনের জটিলতা ও রহস্য উন্মোচনকারী চরিত্রগুলো আমাদের সমাজেরই বাস্তব প্রতিনিধি। আমাদেরই পরিবারভুক্ত চেনাজানা মানুষ তারা। তবে তাঁর চরিত্র ও সংলাপ রচনার মধ্যে অদ্ভুত এবং উদ্ভট বিষয় পরিলক্ষিত হতে পারে। এর পেছনেও হয়তো ব্যক্তি চেতনার মনোজাগতিক চিরায়ত রহস্য থাকতে পারে। থাকতে পারে অন্তরের গভীর ভাবনা।

মূল কথা হলো, টিভি নাটকে একের পর এক সফল হওয়া এই নাট্যকার কিন্তু প্রথমে টিভি নাটক লিখতেই চাননি। প্রখ্যাত প্রযোজক ও নাট্যনির্মাতা নওয়াজীশ আলী খানের বারবার অনুরোধে তিনি একসময় নাটক লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। নাটকটির নাম ছিল ‘প্রথম প্রহর’। সেটি ১৯৮৩ সালের কথা। কিন্তু প্রথম দুটি গল্প চরিত্র চিত্রণের সমস্যার কারণে বাদ হয়ে যায়। পরে একই নামে তৃতীয় গল্পে নাটকটি নির্মিত হয়েছিল। এই একটি নাটক দিয়েই তিনি বিটিভির ইতিহাসে আলোড়ন তুলেছিলেন। সেই আলোড়নের ঢেউ অনন্তকাল বয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

আরও পড়ুন: জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

তাঁর শিল্প সফল। তিনি শিল্পী হিসেবেও সফল। তার সেই প্রবণতা এখনও বিস্তার করে আছে নাট্যজনের অন্তর। টিভি নাটকে তাঁর সফলতা ছুঁয়ে দেখবার সুযোগ অন্য কেউ যেন পেয়ে যান, সেই অপেক্ষায় আমরা থাকতেই পারি। তবে তাঁকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়, আপাতদৃষ্টে আমার তা-ই মনে হয়।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন