বিবর্ণ সময়ের শৈল্পিক বিবরণ
সময়ের গতিধারায় পাল্টে যায় সবকিছু। নতুন নতুন বিষয় এসে যোগ হয় জীবনে। আবার কিছু বিষয় ভেসে যায় জীবনের স্রোতে। জীবনের এই বিষয়গুলো নিয়েই ‘বিবর্ণ সময়’।
কবি জান্নাতুল ফেরদৌস পান্নার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ এটি। এর আগে ‘আমার দু’চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন’, ‘আকাশ সমুদ্রের ঢেউ’ ও ‘সপ্তশৈলী (যৌথ)’ প্রকাশ হয়।
‘বিবর্ণ সময়’ ৩৬টি কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। এটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির আদরের মেয়ে জেরিন ফেরদৌস পঙক্তিকে। বইটি প্রকাশ করেছে দোয়েল প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন প্রতীক নিশা। মূল্য রাখা হয়েছে ১৪০ টাকা। অমর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৫৮ নম্বর স্টলে পাওয়া যাচ্ছে বইটি।
কবি পান্না পেশাগত জীবনে একজন নিবেদিত সংবাদকর্মী। পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। মানুষের কষ্টের সময় পাশে থাকতেই ভালো লাগে তাঁর। তাঁর সেই ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ দেখি আমরা কাব্যেও। আর তাইতো তার কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বিবর্ণ সময়’।
সময় তো রঙিন হতে পারতো। আলো ঝলমল প্রোজ্জ্বল ক্ষণ হতে পারতো। কিন্তু কবির চোখে আমরা এখন ‘বিবর্ণ সময়’কে ধারণ করে চলেছি। কবি তাঁর নামকবিতা ‘বিবর্ণ সময়ে’ বলেছেন-
‘তবে বিবর্ণ সময় কেন?
কেন রঙিন নয়?
আপাদমস্তক ভাবতে হলো...
এই বৈরী সময়ে, আকাশের নীল রঙে
সাদা মেঘের ভেলায়, অথবা ঘুটঘুটে অন্ধকারে-’
কবিতার শেষের দিকে করি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন-
‘সাদা সময়, কালো সময়
কোনোটাতেই হিসাব মেলে না।
হিসাব মেলে না প্রিয় কোনো সময়েই।
সব ফ্যাকাসে... ফ্যাকাসে, বিবর্ণ সময়।’
কিংবা
‘সময় নিয়ে যায় এক অদ্ভুত সময়ে।’ (জীবন বিলাস)
তার প্রায় কবিতাতেই সময় এসেছে বিভিন্ন অনুষঙ্গে। সময় কখনো ‘শূন্য সময়’ হয়ে এসেছে। কবি বলেছেন-
‘সময় কি আর আছে এখন সময়েরই সাথে।’ (ফুটন্ত ফুল)
কখনো কখনো সময়কে দেখি ভর দুপুর, মেঘলা বিকেল, সোনালি সন্ধ্যা, নিস্তব্ধ মধ্যরাত, নষ্ট বিকেল কিংবা নির্ঘুম রাতে।
সময়ের আবর্তে তার কবিতায় উঠে এসেছে বীর বাঙালির কথা। এক অকুতোভয় নির্ভীক সৈনিকের কথা। তিনি দেশের কথা বলেছেন, ইতিহাসের কথা বলেছেন, স্বাধীনতার স্থপতির কথা বলেছেন। কবির ভাষায়-
‘আমি প্রিয় নেতার কথা বলছি।
হ্যা, আমি বাংলাদেশের, বাঙালিদের
প্রিয় নেতৃত্বের কথা বলছি।
আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা বলছি।’ (আমি বলছি)
তবে কবির কবিতায় হিসাবের গড়মিল লক্ষ্য করা যায়। হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কখনো কখনো রোমাঞ্চিত হয় মন। ভালোবাসা চায়- ভালোবাসতে চায়। জীবনকে টেনেহিচড়ে বয়ে চলার একটা প্রবণতা আছে। ক্লান্ত তবু থেমে যাবার নয় যে জীবন। জীবনের গভীর উপলব্ধি আছে। তাইতো কবির মুখে শুনি-
‘অবিরাম, অবিরত ছুটে চলা
ভালোবাসা আর সুখের সন্ধানে!!!’ (সুখ)
কখনো কখনো স্বপ্নগুলোর অপমৃত্যু হয়। চারিদিকে ‘খুন খুন বলে চিৎকার শুরু’ হয়। গ্রন্থে ‘আত্মাহুতি’ নিয়ে দুটি কবিতা রয়েছে। তবে সে আত্মাহুতি কাউকে প্ররোচিত করে না। বরং বাঁচতে শেখায়। কবি বলেন-
‘আর আত্মাহুতির নামে যে যাতনার জন্ম
তা থেকে দূরে, বহুদূরে...হাঁটছি...আর হাঁটছি
এক গৌরবময় অধ্যায়ে।’ (আত্মাহুতি-২)
কবিতায় ‘সময়ের ব্যাকরণটা’ ভালোই রপ্ত করেছেন কবি। প্রতারণার ক্ষতটাকে উপড়ে ফেলে সাম্য, মানবতা, সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কবির ভাষায়-
‘এবার আর ভুল হলো না
ঠিক করলাম,
মানুষ নয় কুকুর পুষবো অথবা বিড়াল।’ (ইতিহাস)
কবি যৌবনের বন্দনাও করেছেন কিছু কবিতায়। কবি যৌবনের পূজারী। এখনো যৌবনের অারাধনাই করেন। কবি ভালোবাসার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন ২০১৪ সালের ২৭ জুন। আর তাইতো ‘পুরোটা’ কবিতা রচনা করেছেন ওই বছরের জুলাই মাসের ২ তারিখে।
কবি সময়, ইতিহাস, দ্রোহ, প্রেম, প্রতারণা আশা-নিরাশা ছাড়াও সমসাময়িক অসঙ্গতীর বিরুদ্ধে দৃঢ় উচ্চারণ করেছেন ‘শব্দ’। খেটে খাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। তার আছে অনেক প্রত্যাশা। আছে দেশাত্মবোধ, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ।
বিভিন্ন বিষয়ে নিবেদিত কবিতাও দেখা যায়। সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহতের স্মরণে উৎসর্গ করেছেন ‘জীবন তুমি কার?’ শিরোনামের কবিতা। ক্ষোভে-দুঃখে কবি বলেছেন- ‘যেন এই দেশে জন্মানোটাই আজন্ম পাপের।’ কবি হেলাল হাফিজকে উদ্দেশ্য করে ‘কষ্টবিহীন হৃদয়’ রচনা করেছেন। ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের জন্য লিখেছেন ‘একটি মৃত্যুর বর্ণনা’ ও ‘কষ্টেরা ওপারে থাকে’।
বিবর্ণ সময় বইয়ের কবিতাগুলো ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে রচিত। তাই সমসাময়িক অনেক বিষয় উঠে এসেছে। এমনকি সময়কে আমরা বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন বলয়ে আবির্ভূত হতে দেখি। কবি বলেন-
‘এরপরেও থেকে যায়, বয়ে যায় বিবর্ণ সময়।
যে সময়ে আমরা ঘরে ফিরে
অপেক্ষা করি, চেপে ধরি, কণ্ঠরোধ করি।’ (কণ্ঠরোধ)
সবমিলিয়ে মন্দ নয়। সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা প্রাণপণ চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোথাও মুদ্রণজনিত ত্রুটি বা ভুল বানান পরিলক্ষিত হয়েছে। তবুও আশার কথা, পান্না এগিয়ে যাবেন। কোনো একদিন রঙিন সময়কে ছুঁয়ে দেখবেন। নিরন্তর শুভকামনা তাঁর জন্য।
এসইউ/এবিএস