অর্থনৈতিক সংকটেও কি জমবে বইমেলা?
অমর একুশে বইমেলার বাকি আর দুই মাস। কম করে হলেও প্রস্তুতি নিচ্ছেন লেখক ও প্রকাশকরা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিগত দুই বছর ধরে বইমেলার ওপর ভর করে আছে অশুভ শক্তি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বইমেলার ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে দিচ্ছে। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন লেখক ও প্রকাশকরা। এবারও চিন্তা হচ্ছে—কেমন হবে বইমেলা? তাই আসন্ন বইমেলা নিয়ে কবি-লেখক-প্রকাশকদের ভাবনা তুলে ধরা হলো—
লেখক ও সাংবাদিক অঞ্জন আচার্য বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কালে আয়োজিত হতে যাচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ। ধনীরা এর প্রভাবমুক্ত। তারা বই পড়েন না। সামাজিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কেউ কেউ বইকে আসবাব হিসেবে ঘরে রাখেন মাত্র। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর, তারাও বই পড়েন না। বই তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বিলাসী-বস্তু। বইপড়ুয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণিরা পড়েছেন উভয় সংকটে। বাজারের ফর্দ মেলাতেই তাদের পকেট ফুটো। বই তাদের দৃশ্যলোকে থাকলেও, দিন দিন সেটি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বছরব্যাপী বইক্রেতারাও এখন মিতব্যয়ী হয়ে উঠেছেন। সেই তালিকায় বই নেই। আগামী বইমেলায় অবধারিতভাবে এই সংকটের প্রভাব পড়বে। কেননা বইয়ের নানা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে এর দাম বাড়ছে। তাই ব্যাগভর্তি বইয়ের জায়গায় স্থান করে নেবে মেলা শেষে নিতান্ত দু-তিনটি না-হলেই নয়, এমন বই। সীমাবদ্ধতায় থেকে এর চেয়ে বেশি সীমান্ত অতিক্রম করার ক্ষমতা যে নেই।’
কবি ও কথাশিল্পী খান মুহাম্মদ রুমেল বলেন, ‘ডিসেম্বর এসে গেল। বইমেলাও আসছে। বাঙালির প্রাণের মেলা। অমর একুশে বইমেলা। মনে পড়ে ২০২১ সাল। ছোট্ট একটা জীবাণুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ পুরো পৃথিবীর। বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডও জবুথবু, ঘরবন্দি এই জীবাণুর কাছে। এ সময়ও হয়েছিল বইমেলা। তবে ছিল প্রাণহীন। শূন্য খাঁ খাঁ ময়দানে মানুষের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। এরপর ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মার্চ–দুই মাসের প্রথম এবং শেষ অর্ধজুড়ে হওয়া বইমেলার প্রথম ভাগে যতটা উচ্ছ্বাস ছিল, বেচাবিক্রির ধুম ছিল, পাঠক ক্রেতা লেখকের আনাগোনা ছিল–শেষভাগে সব মিলিয়ে কোথায় যেন তাল কেটে গিয়েছিল। বছর ঘুরে এবার আসছে ২০২৩ সালের বইমেলা। কাগজের অস্বাভাবিক দাম ভাবাচ্ছে সবাইকে। অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশের মানুষের পকেটেও টান। তবুও সব মিলিয়ে আমি আশায় থাকি—এবারের মেলা হবে রঙে-রসে, প্রাণে-উচ্ছ্বাসে, আনন্দ-হিল্লোলে ভরা এক মেলা। যেখানে প্রাণের সঙ্গে মিলবে প্রাণ। বইয়ের ঘ্রাণে মাতাল হবে বসন্তকাল। বইমেলার জয় হোক। মানুষ পাঠমুখী হোক। সবার জন্য শুভ কামনা।’
কথাসাহিত্যিক ইসরাত জাহান বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের মিলনমেলা। আশা করছি একুশে বইমেলা ২০২৩ নির্ধারিত সময়ে স্বমহিমায় দৃশ্যমান হবে। বিগত দুই বছর করোনার কারণে বইমেলার আয়োজন বিঘ্নিত হয়েছিল। অবশ্য বইমেলা ২০২২ বেশ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। পাঠক, লেখক ও প্রকাশক সবাই মোটামুটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। এ বছর মহামারি কেটে গেলেও নতুন এক সংকটের মুখোমুখি আমরা। কাগজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিসহ অন্যান্য খরচ বৃদ্ধির ফলে বইয়ের মূল্য বেড়ে যাবে। মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক মন্দা। যার প্রভাব সাধারণ পাঠকের ওপর পড়বে। আমাদের বইগুলোর বেশিরভাগ পাঠক ছাত্রসমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে দিশেহারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাই বইয়ের মূল্য বৃদ্ধি তাদের কিছুটা বিমুখ করবে বই কেনা থেকে। তারপরও আশা করছি বইমেলা সংস্কৃতি সচেতন মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত হবে। এ সংকট কেটে যাবে। মানুষ তো আশায় বুক বাঁধে।’
কিংবদন্তী পাবলিকেশনের কর্ণধার অঞ্জন হাসান পবন বলেন, ‘কাগজের বাজারের অস্থিরতার জন্য প্রকাশকরা এবার বইমেলায় খুব কম বই প্রকাশ করবেন। অস্বাভাবিক হারে কাগজের মূল্য বৃদ্ধির ফলে বইয়ের দামও বাড়বে। পাঠকের ওপর কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। তবে এই বইমেলায় মানহীন বই কম প্রকাশিত হবে। পাঠক নিশ্চয়ই ভালো বইয়ের টানে বইমেলায় আসবেন।’
কবি ও ছড়াকার এনাম আনন্দ বলেন, ‘আমাদের জাতীয় মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা। এ মেলার সঙ্গে একুশের জাতীয় চেতনা যুক্ত থাকে। আমরা সবাই জানি, বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রকাশনা শিল্পের কাগজ-কালি ও প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। এ নিয়ে লেখক ও প্রকাশকদের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা। আমার দৃষ্টিতে লেখক ও প্রকাশকদের শঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ গত বইমেলায় করোনার মাঝেও বই বিক্রি হয়েছিল। যেহেতু নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠকরাই বই কিনে থাকেন, তাই বই বিক্রি নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। যারা বই কিনবেন, দাম যতই হোক বই কিনবেনই। আশা করি ২০২৩ সালের বইমেলা হবে বিগত বইমেলার চেয়ে প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর।’
কথাশিল্পী ইসমত আরা প্রিয়া বলেন, ‘বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আমাদের আবেগী মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা। এ যেন লেখক-পাঠকের উৎসব। আমার কাছে মেলা আসার ঠিক আগমুহূর্তে কেমন যেন এক অদ্ভুত আনন্দ কাজ করে। মহামারি কোভিডের জন্য গত দুটি মেলার পুরোটা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে পাইনি। আমাদের ভাষার মাস, এ মাসের শুরুতেই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আসতে শুরু করে। আশা রাখি, এবারের বইমেলা ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হবে এবং প্রতিবারের মতো আমার নতুন উপন্যাস ‘বসন্ত ফিরে আসে’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আলাদা আনন্দ কাজ করছে। দীর্ঘ ১১ মাস এ সময়টার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি। কারণ নানা ব্যস্ততায় বইমেলা ছাড়া পাঠকদের সঙ্গে তেমন দেখা হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ বইমেলাই লেখক-পাঠকদের একত্রিত করে। বহুদিন পর প্রিয় লেখক-পাঠক সবার সাথে দেখা হয়। বই নিয়ে কথা, নতুন বইয়ের তাজা ঘ্রাণে আমোদিত স্টলে স্টলে বই কেনা, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান, বই হাতে নিয়ে মোবাইলে ছবি তোলার ধুম, ব্যস্ত কবি-লেখকগণের অটোগ্রাফে প্রশংসা; এ যেন এক প্রাণের মিলনমেলা।’
এসইউ/জিকেএস