প্রচ্ছদে চোখ বুলিয়ে মেলায় পথশিশুদের বইপড়া
করোনা সংক্রমণের কারণে এ বছর অমর একুশে বইমেলা আয়োজন নিয়েই সংশয় ছিল। তবে সব সংশয় দূর করে দ্বার খুলেছে বইমেলার। লেখক-পাঠক-দর্শনার্থীদের প্রাণের মেলা বসেছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তবে এবারের মেলার দ্বিতীয় দিনেই অন্যান্য দর্শনার্থীর পাশাপাশি ‘ভিন্নধর্মী দর্শনার্থীর’ উপস্থিতি দেখা গেছে। তারা হলো ছিন্নমূল পথশিশু।
সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তারা বইমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে দেখে বইয়ের হরেক রকম প্রচ্ছদ। একজন আরেকজনকে ডেকে বলে, ‘এ বইটা সুন্দর,’ ‘এটা দেখ’, ‘এটার গল্পটা আমি জানি’। এরকমভাবে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের শিশুচত্বরের স্টলগুলোতে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে বেড়ায় পথশিশুরা।
এসব পথশিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। জীবিকার তাগিদে তারা ফুলের বালতি নিয়ে বইমেলায় আসে ফুল বিক্রি করতে। এর ফাঁকে তারা দেখে নেয় শিশুসাহিত্যের বই ‘রাপুনজেল’, ‘পানতাবুড়ি’, ‘ঘুমন্ত রাজকন্যা’, ‘তুষার রানি’, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘আলাদিনের জাদুর চেরাগ’, ‘গরিব দেশ’, ‘মৎস্য কুমারী’, ‘উপকথা’সহ বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ।
ভাবনা আক্তার টুম্পা তাদের একজন। মেলায় আগত পথশিশুদের মধ্যে সে বড়। বয়স ১০ বছরের কাছাকাছি হবে। কয়েক বছর আগে সে একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে কিছু পড়তে পারে না। টুম্পা বলে, ‘আমি এক বছর স্কুলে গেছিলাম। পড়া ভুইল্লা গেছি। এখন দেখতে পারি, বলতে পারি না। কিন্তু এসব কার্টুনের কী গল্প তা আমি মোবাইলে দেখছি।’
জার্মানির বিখ্যাত রূপকথা ‘রাপুনজেল’ বইয়ের ছবি দেখে বইয়ের গল্প বলে ৭ বছরের পথশিশু মারিয়া মারিয়াম। বইয়ের গল্পের সঙ্গে তার বর্ণনা মিলে যায়। বইয়ের ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে পুরো গল্পটি ভাগ করে। রাপনজেল কীভাবে জীবনযাপন করেছিল, ডাইনির জন্য তাকে কী কী করতে হতো, রাপুনজেলের সঙ্গে রাজপুত্রের প্রেম এবং রাজপুত্র কীভাবে ডাইনি থেকে রাপুনজেলকে মুক্ত করে বিয়ের মাধ্যমে সুখী জীবনযাপন করেছিল তা হুবহু বইয়ের মতো করেই বর্ণনা করে মারিয়া। শুধু সে ডাইনিকে শাকচুন্নি বলে। সে বইটি পড়তে না পারলেও কিনে দেওয়ার জন্য আবদার করে।
একইভাবে শান্ত নামে আরেক পথশিশু তার বন্ধুদের নিয়ে কয়েকটি স্টলের প্রদর্শনী ঘুরে ঘুরে দেখে। বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে একে অন্যের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করে। ‘ঘুমন্ত রাজকন্যা’ বইয়ের প্রচ্ছদের চরিত্রগুলোর পরিচয় জানতে চায় এই প্রতিবেদকের কাছে। উত্তর পেয়ে অন্য বইয়ের ওপর তার ফুলের বালতিটি রেখে সে মনোযোগের সঙ্গে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টায় আর বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে।
এরপর মারিয়া, ভাবনাসহ কয়েকজন অন্য স্টলগুলোতে ঘুরতে থাকে। তারা ‘প্রকৃতি পরিচয়’ নামে একটি শিশুগ্রন্থের স্টলে গিয়ে বিদিশা নামে এক বিক্রয়কর্মীর কাছে ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার আবদার করে। বিদিশা তাদের আবদার রেখে তিনজনকেই লিপস্টিক দিয়ে দেয়।
তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদিশা জাগো নিউজকে বলেন, আমি গত বছরের বইমেলায়ও এ স্টলে কাজ করেছি। পথশিশুরা আসতো। তারা বিভিন্ন কিছু জানতে চাইতো। কয়েকজন ছবি দেখতো, পড়তে পারতো না। আবার কয়েকজন ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে পড়তে পারতো। আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের পড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারাও পড়ছিল। এখনও তাদের পড়ানো হলে পড়বে। পড়াশোনার প্রতি তাদের অনেক আগ্রহ। তাদের পড়ানো গেলে দেশের জন্যও ভালো হতো। তারা পড়াশোনা না জানলে দেশ কখনো নিরক্ষরমুক্ত হবে না।
লাবনী প্রকাশনীর প্রকাশক লাবনী হোসেন বলেন, যারা সত্যি সত্যি পড়ে তাদের আমরা বই দেই। এমনিতে যারা পড়তে পারে না তারা ছবি দেখে ‘এটা সুন্দর’, ‘এটা এ রকম’, ‘এগুলো তো টিভিতে দেখি’- এ রকম বলতে থাকে। এরা এটা ইনজয় (উপভোগ) করে। ওদের শিক্ষা ও সুরক্ষা দেওয়া গেলে তারাও আমাদের মতো সুন্দর-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।
এদিকে করোনা মহামারির কারণে এবার দুই সপ্তাহ দেরিতে শুরু হলো অমর একুশে বইমেলা। মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বইমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বইমেলার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।
ইএ/জেআইএম