ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

শবনম: বিরহে উজ্জ্বল ভালোবাসার উপাখ্যান

রুখসানা মিলি | প্রকাশিত: ০১:১৮ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বিরহে উজ্জ্বল এক তীব্রতর ভালোবাসার উপাখ্যান সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’। গল্পের গাঁথুনি, ভাষার প্রয়োগ, আবেগের হৃদয় মথিত উপস্থাপনে কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠছে এ উপ্যাখ্যান। তাই তো-
‘আমার মিলনে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না।
আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না’

প্রেমিক মজনুনের প্রতি শবনমের এই উচ্চারণ কেবল উচ্চারণই নয়, যেন ভালোবাসা আর হাহাকারের যৌথ যাত্রার প্রতিচ্ছবি। তাই প্রকাশিত হওয়ার ৬৩ বছর পর এসেও সাহিত্য আসরে সাহিত্যপ্রেমীদের আলোচনায় উঠে আসার পাশাপাশি বাস্তব প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়াবেগ প্রকাশের পাথেয় হয়ে আছে এ বাক্যযুগল।

আফগানি শিশিরবিন্দু শবনমের সাথে হঠাৎ দেখা বাংলাদেশের মজনুনের। নাম জানার আলাপচারিতা গড়ায় কবিতায়। তারপর দুজন কবিতাপ্রেমী মানুষের সম্পর্ক-প্রেম-ভালোবাসার যাত্রাটা মুজতবা আলী গদ্যে বর্ণনা করলেও তা যেন হয়ে উঠেছে কাব্য। দুটি হৃদয়ের ব্যকুলতা, কাছে আসার মুহূর্তগুলো পাঠককে কাব্যের দোলায় দোলায়িত করে।

শবনমকে প্রথম দেখার যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন, তা কেবল লেখকের বর্ণনা নয়; যেন প্রকৃতি মিশিয়ে প্রেমিকাকে উপস্থাপন করেছে কোনো প্রেমিক হৃদয়। প্রেমিকার কপালকে বন-মল্লিকার পাপড়ির সাথে তুলনা করা কি কেবল লেখক হৃদয়ের কর্ম, না সেখানে প্রেমিক হৃদয়ও হাজির? প্রথম দেখার বর্ণনাই নয়, পুরো ঘটনার বর্ণনায়ই প্রেমিক হৃদয়ের ভালোবাসা, আনন্দ, উচ্ছলতা, হাহাকার, তীব্র নীল বেদনা ছুঁয়ে যায় পাঠক মাত্রই। শবনমকে পাওয়ার উচ্ছ্বসিত বর্ণনায় মজনুন বলছেন, ‘যে বিধাতা প্রতিটি ক্ষুদ্র কীটেরও আহার জুগিয়ে দেন, তিনিই তো তৃষিত হিয়ার অপ্রত্যাশিত মরুদ্যান রচে দেন।’

ভিনদেশের দুই মানুষ। কয়েক মুহূর্তের দেখা, সেখানে এমন তীব্র ভালোবাসা কি যুক্তিযুক্ত? মজনুনের জবানিতে লেখক বলছেন, ‘এ তো বুদ্ধির কথা, যুক্তির কথা, সামান্য কাণ্ডজ্ঞানের কথা, কিন্তু হায়, হৃদয়ের তো আপন নিজস্ব যুক্তি রাজ্য আছে, সে তো বুদ্ধির কাছে ভিখিরির মত তার যুক্তি ভিক্ষা চায় না। আকাশের জল আর চোখের জল তো একই যুক্তি-কারণে ঝরে না।’ যুগে যুগে রচিত সব অমর ভালোবাসায় ‘হৃদয়ের আপন নিজস্ব যুক্তি’রই জয়গান, শবনম-মজনুনের ভালোবাসার উপাখ্যানও তাই।

প্রেমিক হৃদয়ের সাথে প্রেমিকার হৃদয়ের যোগাযোগ অনেক কিছুতেই সাবলীল হয়ে ওঠে। দুজনের ভাষার দূরত্ব ছিল, তবে কবিতার ভাষা যে সার্বজনীন, তাই তো শবনম-মজনুনের ভালোবাসার সাবলীলতা তৈরি করে দিয়েছেন হাফিজ, সাঈব, সত্যেন দত্ত, চণ্ডীদাস, জগদানন্দ, বলরাম দাস, নিজামি, ফিরদৌসি, জামি, ফিগানির মতো কবিদের রচনা। ‘একটি কথা, দুটি চাউনি, তাতেই দেহের ক্ষুধা, হৃদয়ের তৃষ্ণা, মনের আকাঙ্ক্ষা সব ঘুচে যায়, সব পরিপূর্ণ হয়ে যায়।’ ভালোবাসার যে তীব্রতর ছবি এই একটি লাইনেই লেখক তুলে ধরেছেন। তাতে প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ই কেবল নয় যে কোনো হৃদয়কে আলোড়িত করে।

আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ডামাডোলের অস্থির সময়ের পটভূমিতে রচিত এই প্রেমিকযুগলের গল্প। তাদের পাওয়া ছিল ক্ষণিকের। তবু ক্ষণিকের সে পাওয়াকে অসাধারণ বর্ণনায় পরিপূর্ণ করে তুলেছেন লেখক। শবনমের ভালোবাসাকে আখ্যায়িত করেছেন কখনো স্নিগ্ধ জোৎস্নালোক, কখনোবা নববসন্তের মধু নারগিসের সাথে। মজনুনের ভালোবাসাকে আখ্যায়িত করেছেন মরুভূমিতে মরণাপন্ন তৃষ্ণার্তকে সঞ্জীবন অমৃতবারি, কখনোবা ভরা-নিদাঘের বিরহরসঘন দ্রাক্ষাকুঞ্জের সাথে। এমনই নানা উপমায় প্রেমকে, ভালোবাসাকে উপস্থাপনে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন লেখক। দুজনের কাছে দুজন যেন বহু পাপড়ির ফুল। যার প্রতি পরতে পরতে দুজন দুজনকে আবিষ্কার করে চলেছে। শবনম তাই গুনগুন করে-
‘করেছি আবিষ্কার
তোমারে ভালোবাসিবার
প্রথম যেমন বেসেছিনু ভালো, সেই বাসি প্রতিবার।’

মজনুন-শবনমের মিলন ছিল ক্ষণিকের। সারারাতের শিশিরবিন্দুর মতোই হঠাৎ হারিয়ে যায় শবনম। কিন্তু তাদের সেই ক্ষণিকের মিলন, সেই বাসরের যে কথোপকথন তা যেন হাজার আরব্য রজনির গল্পকেও হার মানিয়েছে। একটি রাতে দুজন মানুষের হৃদয় একের কাছে অন্যকে পৌঁছানোর কি হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা। শবনমকে পাওয়ার প্রথম রাতের সেই কথোপকথনের জালে পাঠকমাত্রই মোহময়তায় জড়াবেন। ভালোবাসা পাওয়ার বর্ণনাকে আর কে কবে এমন করে উপস্থাপন করেছে! এই সৃষ্টি তাই সময়-কাল পেরিয়ে নিজের স্থান পাকা করে নিচ্ছে।

এরপর ক্ষণিকের পাওয়া শিশিরবিন্দুর বিরহের নীলে নির্বাসিত মজনুনের হাহাকার, বেদনা, চুরমার হয়ে যাওয়ার চিত্রটা এত স্পষ্ট যে, সে বিরহ সকলকেই ছুঁয়ে যায়। ‘জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতাসমষ্টির নাম জীবন আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক-একটি অভিজ্ঞতা। এক একটি অভিজ্ঞতা যেন এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব-কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি-মালা হয় তারই নাম জীবন।’ কেবল ভালোবাসাই নয়, উপন্যাসে এমন জীবন দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজের চিত্রটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

শবনম কি ফিরেছিল? সে প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায় উপাখ্যানে। তবে শবনমের স্মৃতি আকড়ে মজনুনের সাধনার বর্ণনায় বার বার উঁকি দিয়ে যায় প্রচণ্ড বিরহেও মিলনের এক অধ্যায়। মজনুন শবনমের স্মৃতি নিয়ে বলে, ‘স্মৃতি অন্ধকার ঘরে সুগন্ধ আলোর চেয়েও সতেজ হয়ে মানুষকে কতখানি অভিভূত করতে পারে।’ শবনমের বলা কথাটি স্মরণ করে মজনুন, ‘যখন সব সান্ত্বনার পথ বন্ধ হয়ে যায় তখন হৃদয় হঠাৎ এক আনন্দলোকের সন্ধান পায়।’ মিলনে না হোক বিরহে হলেও কাছে থাকার, প্রেমে জড়িয়ে থাকার, অপেক্ষায় থাকার, আবেশিত থাকার ক্ষমতা যে প্রেমিকের; সেই প্রেমই তো অবিনশ্বর। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ অবিনশ্বর প্রেমের গল্প।

উপন্যাস: শবনম
লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৬০ সাল
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
দাম: ৩৩০ টাকা।

এসইউ/জিকেএস

আরও পড়ুন