ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

বই পরিচিতি

সব মেঘে বৃষ্টি হয় না, আসলেই তো...

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৬:১০ পিএম, ২২ জুন ২০২৪

বাসার তাসাউফ

আমার আত্মজীবনীর নাম ‘সব মেঘে বৃষ্টি হয় না’। এ কথা আসলেই তো সত্য। সব মেঘে কখনো বৃষ্টি হয় না। ১৯৮৬ থেকে ২০১৯, সময়ের হিসাবে ৩৪-৩৫ বছর। এ সময়গুলোর স্মৃতি ও ইতিহাস আমি লিখেছি আমার আত্মজীবনীতে। শুধু একটা জীবন নয়। আমার জীবনের এগিয়ে চলা, পিছিয়ে পড়া, হেরে যাওয়া, হারিয়ে দেওয়া, হারিয়ে যাওয়া এবং আবার খুঁজে পাওয়া। আঘাতে ঠোক্করে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হওয়া। আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে আবার সেই মাটিকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা! কুঁড়েঘরের খিড়কির ফাঁক দিয়ে বিশাল আকাশ দেখতে পেয়ে নিজেকে বিশালভাবে গড়ে তোলার দুর্বার অভীপ্সা—এসবই লিখেছি আত্মজবানে।

লিখতে গিয়ে এমন কিছু কথা আমি অকপটে বলে ফেলেছি, যা বলতে যে কোনো লেখকের দুঃসাহস থাকা প্রয়োজন। আর আমার এসব দুঃসাহিক কথা পড়ে অনেকে প্রশংসা করেছেন। কেউ আবার বলেছেন, এত খোলামেলা কথা না বললেও পারতে। কিন্তু আমি তো কাল্পনিক কোনো কাহিনি লিখিনি। আমি কেবল আমার জীবনের যাপিত দিনগুলো জমা রাখতে চেয়েছি দুই মলাটের মাঝখানে। তবু কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। মাত্র ১৭৬ পৃষ্ঠার দৈর্ঘে কি জমা রাখা যায় আকাশের মতো, মেঘের মতো প্রকৃতির মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ একটা গোটা জীবন?

অনেকে আমাকে বলেছেন, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আত্মজীবনী লিখে ফেলেছেন? ৭০ কিংবা ৮০ বছর বয়স হলে তবেই না...! আমি জানি না, আত্মজীবনী লেখার কোনো নির্দিষ্ট বয়স আছে কি না। আত্মজীবনী লেখার জন্য আমি যে ৭০ কিংবা ৮০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবো, তার কোনো নিশ্চয়তা কি আমাকে স্রষ্টা দিয়েছেন? যে কোনো সময় মরে যেতে পারি? মরে যাওয়ার পর অন্য কেউ যদি আমার জীবনী লেখে, তাতে কতটা পরিপূর্ণতা থাকবে কে জানে। তাই সুস্থ, সবল দেহ ও মনে স্মৃতিচারণ করে করে লিখে রাখলাম আমার জীবন।

লিখতে গিয়ে আবেগে বুঁদ হয়ে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারছি। বয়স স্বল্পতার ছাপ আছে লেখায়। এটা আমার লেখার চিরকালীন দুর্বলতার প্রভাবে হতে পারে। আসলে এখানে কল্পনায় সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা থেকে একদম বিরত ছিলাম যে, তাই লেখার সময় অতিরঞ্জিত কিছু লিখে অযথা মেদ বাড়াতে চাইনি। তাই যতক্ষণ লিখেছি; ততক্ষণ কেবল আমার জীবনটুকু ছাড়া আর কিছু ছিল না মনের দর্পণে, চোখের ক্যানভাসে। এখানে যা কিছু লেখা হয়েছে, তার সবই পেয়েছি জীবনেরই কাছ থেকে।

একজন মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনিতে সাহিত্যগুণ না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে বিদগ্ধ পাঠক-সমালোচকদের ওপর বিচারের ভার ন্যাস্ত করে একটা বিষয় অবগত করে দিতে চাই, এখানে আর কিছু না থাকুক সত্য আছে। নিগূঢ় ও বাস্তব সত্য আছে। যে সত্যের শরীরে কোনো পোশাক নেই, অলংকার নেই। সেই সত্যকে, রূঢ় বাস্তবতাকে, অলংকারবিহীন অমল অবয়বে উপস্থাপনের নেপথ্যে একটা কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল আমার। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আমি কী রকমভাবে বেঁচে-বর্তে আছি তা জানিয়ে দেওয়া আমার উত্তর-প্রজন্মকে। আমার উত্তর প্রজন্ম মানে—আমার অনাগত সন্তানদের। যারা বইটি পড়েছেন, তারা যদি উৎসর্গপত্রটি খেয়াল করে থাকেন—তাহলে কিছুটা ধারণা পেতে পারেন, আমার আত্মজীবনী মূলত কার জন্য লেখা।

কার জন্য লেখা সেটা না হয় সময় হলে সেই জন পড়ে নেবে। কাকে নিয়ে লেখা সেটা এখন বলা যাক। আমার কিষাণ পিতার মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে শুরু হলেও তিনি কীভাবে জীবনসংগ্রামে উপনীত হয়ে পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন, তা বর্ণনা করার পাশাপাশি আমাদের অভাবী সংসারে আমি কীভাবে বেড়ে উঠেছি—তা বর্ণনা করেছি পুরো বইয়ে। ‘...আব্বা আমাদের ভরণ-পোষণ করতে মাটি কাটার কাজ ছাড়াও আরও অনেক রকম কাজ করেছেন। ইশ্বরপুরের হিন্দুদের সাথে গিয়ে রাতভর মাছ ধরেছেন, কামলা হয়ে সিলেটে গিয়ে ধান কেটেছেন। তখন আমাদের গ্রাম থেকে অনেকেই ধান কাটতে সিলেটে যেত। সিলেটে ধান কাটতে যাওয়াকে ‘ধানী যাওয়া’ বলতো গ্রামের লোকেরা। তখন সিলেটে ধানের ভালো ফলন হতো। সেই এলাকায় লোকবল কম ছিল বলে আমাদের এলাকা থেকে লোকজন গিয়ে টাকার বিনিময়ে তাদের ধান কেটে দিয়ে আসতো। সিলেটে ধানী চলে গেলে আব্বা এক দেড় মাস বাড়ি ফিরতো না। যতদিন আব্বা বাড়ি না ফিরতো ততদিন আমাদের সামলাতে আম্মার কী যে কষ্ট হতো! আব্বা সিলেটে যাবার আগে আম্মার কাছে যে চাল কিনে দিয়ে যেতেন, কয়েকদিন খাওয়ার পরই তা ফুরিয়ে যেত। তখন চালের চেয়ে আটার দাম কম ছিল। তাই কয়েক মুঠো চাল বাঁচাতে আম্মা আটা দিয়ে রসগোল্লার মতো একধরনের খাবার তৈরি করে আমাদের খেতে দিতেন। আটার তৈরি রসগোল্লা খেয়ে আমরা দিন কাটাতাম আর আব্বা কবে চাল নিয়ে আসবে সেই অপেক্ষায় থাকতাম। এমন নয় যে আব্বা বাড়ি ফেরার সময় পকেট ভরে টাকা আর বস্তা ভরে চাল নিয়ে আসতেন। অহর্নিশি ধান কেটে যে টাকা পেতেন, তা দিয়ে নিজে বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার শুধু ততটুকু খরচ করে বাকি টাকা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, লবণ কিনে নিয়ে আসতেন। ভাগ করে আমরা ডাল-ভাত খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছিলাম। আম্মার ভাগে তো ডাল-ভাতও মিলতো না। আম্মা না খেয়েই পেট ভরে খেয়ে ওঠার ভান করাটা শিখে নিয়েছিলেন...।’ (সব মেঘে বৃষ্টি হয় না, পৃষ্ঠা ৪১-৪২)

আমার মায়ের দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার পরও হাসিমুখে সংসারের কাজকর্ম সামলে রাখার কথাগুলো কেউ কি জানতো আমাদের ছাড়া? এ ছাড়া আমার আত্মজীবনীতে আছে নব্বইয়ের দশকের স্মৃতিচারণ। নব্বইয়ের দশককে বলা হয় সোনালি দশক। আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে এই দশকে। কাজেই সেই দশকের স্মৃতিচারণ থাকাটা স্বাভাবিক। আমি সেই সময়টা এমনভাবে লিখেছি, পড়ে মনে হবে চিত্রায়ণ করেছি। পড়তে পড়তে আপনি ফিরে যাবেন নব্বইয়ের দশকের সেই সোনালি দিনগুলোতে। আমার ছেলেবেলায় খুঁজে পাবেন আপনার ছেলেবেলাকে। বইয়ের একটা একটা পাতা উল্টাবেন আর মনে হবে, আরে! এ তো আমারই কথা! আমার জীবনের কথা। এই যে আজকাল মোবাইল, ফেসবুক, ইমো, ভাইভার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব আর ইমেইল-জিমেইলের যুগে আমরা ‘থ্রি জি’ ও ‘ফোর জি’র স্পিডে ছুটে চলেছি, আমরা তো ভুলেই গেছি, চৈতালি দুপুরে ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশের কাছাকাছি পাঠিয়ে নাটাই-সুতো হাতে নিয়ে ছুটে চলার গতি কেমন ছিল? ইউটিউবে ভিউজ আর ভাইরালের যুগে বিটিভিতে শুক্রবারে বাংলা সিনেমা দেখার অনুভূতি কী রকম ছিল—এ বইয়ের মাধ্যমে সেই সব পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছি।

সেই যে ছোটবেলায় তুষপোড়া ছাই দিয়ে দাঁত মাজা। মক্তবে আরবি পড়তে গিয়ে হুজুরের হাতে জালিবেতের মার খাওয়া। আদর্শলিপি বই নিয়ে প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া। স্কুলে যাওয়ার সময় বৃষ্টি এলে কচুপাতা কিংবা কলাপাতা দিয়ে ছাতা বানিয়ে মাথায় ধরা। টিফিনের সময় এক টাকা দিয়ে লাঠি বিস্কুট কিংবা আট আনা দিয়ে দুধমালাই আইসক্রিম কিনে খাওয়া। কট্কটিওয়ালার কাছ থেকে হাওয়াই মিঠাই কেনা। ক্লাসরুমে সুর করে নামতা পড়া। মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই সহপাঠী সুন্দরী মেয়েকে প্রেমপত্র লেখা। নিজের নামের পাশে যোগ চিহ্ন দিয়ে বেঞ্চির ওপরে সহপাঠী মেয়ের নাম লেখা। পাটকাঠিতে মাদার গাছের আঠা লাগিয়ে ফড়িং ধরা। নদীতে গোসল করতে গিয়ে লাই খেলা। বন-বাঁদাড়ে ঘুরে ঘুরে পাখির বাসা ভাঙা। পাখির ছানা ধরে এনে বাড়িতে পোষা। অন্যের গাছ থেকে ফল চুরি করা। পলো দিয়ে মাছ ধরা, চাঁই, ওচা, ঠেলা জাল ও বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে সাপ দেখে ভয় পাওয়া। পাশের গ্রামে গিয়ে রাতভর বাউল গান শোনা, যাত্রাপালা দেখা। পাল তোলা নৌকোয় চড়ে নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া। নৌকাটা ছোট কোনো পুল বা ব্রিজের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় ‘তা তা’ শব্দ করে প্রতিধ্বনি তুলে আনন্দ পাওয়া।

রেডিওতে অনুরোধের আসর গানের ডালি আর রকমারি গানের অনুষ্ঠান গীতালি শোনা। বেবি লজেন্স সংগীতমালা কিংবা হাঁস মার্কা নারকেল তেল গানের দোলা অনুষ্ঠানে ধাঁধার উত্তর দিয়ে চিঠি লেখা। রেডিও ম্যাগাজিন উত্তরণ, সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান দুর্বার, রাত আটটা পাঁচ মিনিটে খেলাধুলার খবর, নিশুতি অধিবেশনে ছায়াছবির গান শোনা। মোহামেডান-আবাহনী ফুটবল ম্যাচ ও ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফির ফাইনাল খেলার ধারাবিবরণী শোনা। ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মনির খান, রবি চৌধুরী, তপন চৌধুরী, ডলি সায়ন্তনী, মুজিব পরদেশীর ক্যাসেট কিনে ব্যাটারি চালিত ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনা। শুনতে গিয়ে ক্যাসেটে ফিতা পেঁচিয়ে গেলে টেনে বের করে প্যাঁচ খুলে পেন্সিল কিংবা বলপেন ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক করে আবার গান শোনা।

বিটিভিতে আলিফ লায়লা, ম্যাকগাইভার, ইত্যাদি, রবিনহুড, হারকিউলিস, আকবর দ্য গ্রেট, হুমায়ূন আহমেদের নাটক আর শুক্রবারে পূর্ণদৈর্ঘ বাংলা ছায়াছবি দেখতে অধীর হয়ে অপেক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে টিভিতে এন্টেনার বদলে সিলভারের ঢাকনা ব্যবহার করা। রিল ক্যামেরায় ফটো তোলা। জাম্বুরা কিংবা ডিয়ার বল দিয়ে ফুটবল খেলা। পেলে, ম্যারাডোনার পোস্টার কেনা। ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু ঘোষের ভিউকার্ড সংগ্রহ করা। বাজার থেকে ভিসিআর ভাড়া করে এনে উঠোন ভরা পাড়ার লোকদের সাথে বসে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা দেখা। রাজ্জাক-শাবানার ছবি দেখে চোখের জল ঝরিয়ে কেঁদে ফেলা। সালমান শাহর মৃত্যু সংবাদ শুনে মন খারাপ করা।

পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পত্র পাঠিয়ে পত্রমিতালি করা। বড় ভাবিকে তার প্রবাসী স্বামীর কাছে চিঠি লিখে দেওয়া। হাতে ক্যাসিও ঘড়ি আর পায়ে রূপসা চপ্পল পরে ঘুরে বেড়ানো। কেরোসিন তেলে জ্বলা কুপির আলোয় পড়ালেখা করা। হ্যাজাক লাইটের ঝলমলে আলোয় বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত খাওয়া।

শিকায় রাখা কাচের বোতল থেকে ঢেলে মাথায় সরষের তেল মাখা। লাঙল-জোয়াল আর গরু দিয়ে হালচাষ করা, ধান মাড়াই করা। ঢেঁকিতে ধান বানা চালের ভাত খাওয়া। বাবার সাথে নৌকায় চড়ে বাজারে গিয়ে বড় বটগাছের তলায় পিঁড়িতে বসে নাপিতের কাছে চুল কাটানো—এসব স্মৃতিকথা পড়ার পর আপনি নস্টালজিক হতে বাধ্য, হবেনই।
প্রকাশের পর বিক্রির তালিকায় আমার লেখা বইয়ের মধ্যে এটি তৃতীয় স্থান দখল করেছে।

বইয়ের নাম: সব মেঘে বৃষ্টি হয় না
লেখক: বাসার তাসাউফ
ধরন: আত্মজীবনী
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান
মূল্য: ৩৩০ টাকা।

এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন