ঈশপের গল্প থেকে কবিতা: বিবর্তনের ছোঁয়া
‘ঈশপ’ নামটি সবারই পরিচিত। তিনি গ্রিসে জন্মেছিলেন। একজন ক্রীতদাস ছিলেন। ঈশপ দারুণ গল্প বলতে পারতেন। তার প্রত্যেকটি গল্পই অনেক শিক্ষণীয়। প্রত্যেকটি গল্পের চরিত্র জীব-জন্তু। তবে প্রত্যেকটি গল্পকেই নীতিবাক্য মনে হবে। মানুষের জীবনের বিভিন্ন অসংগতি জীব-জন্তুর চরিত্র দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। সেই গল্প ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে মুখে। যুগ যুগ ধরে প্রচারিত হচ্ছে।
তারই ধারাবাহিকতায় শিশুসাহিত্যিক মিজানুর রহমান মিথুনের নতুন বই ‘ঈশপের গল্প থেকে কবিতা’। ফলে নাম শুনেই কেমন পরিচিত মনে হয়। কোথায় যেন শুনেছি। কারণ ঈশপের গল্প শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। সেই গল্পগুলোকেই কবিতায় রূপান্তর করেছেন মিজানুর রহমান মিথুন।
বইটিতে দশটি কবিতা রয়েছে। কবিতার শিরোনামগুলো হচ্ছে—‘শিয়াল ও আঙুর’, ‘ময়ূর ও কাক’, ‘বন্ধুর পরিচয়’, ‘কাক এবং পানি’, ‘শিয়াল ও বোবা কাক’, ‘লোভের সাজা’, ‘গাধার গর্ব’, ‘রাজা এবং সাত চোর’, ‘ঘণ্টা বাঁধবে কে’, ‘পিঁপড়ে দেখে শেখো’।
এর প্রত্যেকটি গল্পই সবার হয়তো পড়া। কাহিনিও সবার জানা। অথবা দাদি-নানি বা বাবা-মায়ের মুখে শুনে থাকবেন। তাহলে এই বইয়ের বিশেষত্ব কী? এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে। এ প্রসঙ্গে বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘ঈশপের গল্প বিশ্বব্যাপী পাঠকপ্রিয়। তার লেখা গল্পগুলো সব শ্রেণির পাঠক পছন্দ করে। বিশেষ করে ঈশপের গল্পগুলো বেশ আকর্ষণ করে। এ কথা চিন্তা করে শিশুদের জন্য কবি, ছড়াকার, গীতিকার ও সাহিত্যিক মিজানুর রহমান মিথুন ঈশপের বেশ কিছু গল্প ছড়া-কাবিতায় রূপ দিয়েছেন। সব শিশুই ছড়া-কবিতা পছন্দ করে। তাই ঈশপের গল্পগুলো ছন্দবদ্ধ হওয়ায় তারা আরও আগ্রহের সঙ্গে পড়বে।’
গল্প পড়া সহজ নাকি কবিতা? কোনটি মনে রাখা সহজ? মূলত বিষয় সেটি নয়। গল্পের আবেদন গল্পে, কবিতার আবেদন কবিতায়। গল্পকে কবিতায় রূপ দেওয়া অতটা সহজও নয়। সেই কঠিন কাজটিই করেছেন মিজানুর রহমান মিথুন। বইয়ের নীতিগল্পগুলোই তিনি নীতিকবিতায় রূপান্তরিত করেছেন। যেমন কবিতার ঢঙে তিনি বলেছেন—
‘গাছের তলায় ঘুরলো অনেকক্ষণ
আঙুর খেতে চেষ্টা প্রাণপণ।
পারলো না সে একটা আঙুর খেতে
‘আঙুর ফল খেতে টক’—তাই বললো যেতে যেতে।’
(শিয়াল ও আঙুর)
আরও পড়ুন
একটি তৃষ্ণার্ত কাকের পানির কলসে পাথর ফেলে পানি পানের গল্পটিও আমরা জানি। ছেলেবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। সেই গল্পটির কবিতারূপ হচ্ছে এমন—
‘চারিদিকে ভীষণ গরম
বুকের মাঝে তৃষ্ণা পরম।
সব কিছুই নিথর নিথর দেখেই হতবাক,
তৃষ্ণা বুকে অনেকখানি,
নেই কোথাও একটু পানি,
উড়ে উড়ে দিশেহারা একটি কালো কাক।’
(কাক এবং পানি)
কাহিনিকে ছন্দে, অন্ত্যমিলে নির্মাণ করা শ্রমসাধ্য বিষয়। শব্দচয়নে অনেক সতর্ক থাকতে হয়। শব্দ ব্যবহারের আগে মাথা ঘামাতে হয়। বিষয় ও আঙ্গিক হুবহু একই রেখে নতুন কিছু নির্মাণ করা সাহসিকতার পরিচায়ক। মিজানুর রহমান মিথুন এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সচেষ্ট ছিলেন।
আমরা জানি, কাঠুরের লোভের পরিণতি কী হয়েছিল? তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তারপরও কবিতায় জেনে নিতে পারি নতুন আঙ্গিকে। এ জন্যই কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন এভাবে—
‘সোনার কুঠার পাওয়ার লোভে মন করে আনচান,
পরী এবার বুঝতে পারে এই লোভীটার ভান।
‘মিথ্যা বলা নয়তো ভালো’—বললো পরী শেষে।
লোভের সাজা পেয়ে লোভী বুঝতে পারে ভুল,
ভালো হয়ে যাওয়ার ধ্যানে যায় হয়ে মশগুল।’
(লোভের সাজা)
শিক্ষণীয় গল্পগুলো মূলত শিশুতোষ। ফলে শিশুদের উপযোগী করেই তাকে কবিতা বা ছড়ায় রূপান্তর করতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সহজ-সরল এবং শিশুতোষ শব্দ ব্যবহারের বিষয়টি কবিকে মাথায় রাখতে হয়েছে। যাতে সহজেই শিশু-কিশোরদের বোধগম্য হয়।
মিজানুর রহমান মিথুন পেশায় একজন গণমাধ্যমকর্মী। শিশুসাহিত্যের পাশাপাশি নিয়মিত গানও লেখেন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার। তার একাধিক শিশুতোষ গ্রন্থ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শিশুদের মনন তিনি বুঝতে পারেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি শিশুর মনোজাগতিক উৎকর্ষতা নিয়ে কাজ করেছেন। ফলে কঠিন কাজ হলেও খুব সহজেই বিবর্তনটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। একটি নতুন আঙ্গিক খুঁজে পেয়েছে।
১৬ পৃষ্ঠার চার রঙা বইটি নান্দনিক অলংকরণে সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। তবে বানানের ক্ষেত্রে আরেকটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল। প্রকাশনীর সম্পাদনা বিভাগ এ জন্যই জরুরি। আশা করি লেখকও ভবিষ্যতে বিষয়টি খেয়াল রাখবেন। কেননা ভুল বানান যেন শিশুদের কাছে না পৌঁছায়।
গুরুত্বপূর্ণ বইটি প্রকাশ করেছে শিশুতোষ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হুল্লোড়। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন হাসান মাহমুদ সানি। বইটি পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে। ২০০ টাকা মূল্যের বইটি শিশুর মেধা বিকাশে সহায়ক হবে বলে মনে করি। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।
এসইউ/এএসএম