মাকে নিয়ে কালজয়ী ছয়টি উপন্যাস
মাকে নিয়ে লেখা উপন্যাসের কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়ে ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসের কথা। এই উপন্যাসের কথা বাংলাভাষি সবারই কম-বেশি জানা আছে। এ ছাড়া বাংলা ভাষায়ও কয়েকটি উপন্যাস রচিত হয়েছে মাকে নিয়ে। সেগুলোর কোনোটি পারিবারিক, কোনোটি সামাজিক আবার কোনোটায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে। তেমন ছয়টি উপন্যাসের কথাই জানবো আজ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী’
শক্তিমান এই লেখকের অমর কীর্তি ‘জননী’ নামের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। এটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস, যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শ্যামা নামে এক গৃহবধূর জননী সত্তার বহুবিধ আত্মপ্রকাশ এই উপন্যাসের উপজীব্য। উপন্যাসে লেখক জননী চরিত্রটিকে স্বর্গীয় বা দৈবিক মহিমায় ভাস্বর করেননি। এক জননীর কাহিনি বাস্তবতার আয়নায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাস বললে বরং ভুলই হবে, এ যেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চিরন্তন ঘটে যাওয়া মানব জীবনের চক্রেরই স্বার্থক খণ্ডচিত্র।
শওকত ওসমানের ‘জননী’
শওকত ওসমানের ‘জননী’ উপন্যাসটি সম্ভবত তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। এটি একটা কালজয়ী উপন্যাসই বটে। উপন্যাসের মূল চরিত্র দরিয়াবিবি। তবে দরিয়াবিবির দ্বিতীয় স্বামী কিংবা পাঠকের সামনে হাজির করা একমাত্র স্বামী ও তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাসও কম আসেনি। এমনকি লেখক তার মূল উপন্যাস শুরুর আগেই দরিয়াবিবির স্বামী পরিবারে অতীতের গৌরবান্বিত উপাখ্যানের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’
‘হাজার চুরাশির মা’ হলো র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর একটি বাংলা উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০-এর দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি রচিত হয়। এ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র ‘হাজার চুরাশি কি মা’ তৈরি করা হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একজন মা, যার নাম সুজাতা। স্বামী ও শাশুড়ির অত্যাচারের মধ্যে চার সন্তান নিয়ে তার সংসার। মাতাল স্বামী দিব্যনাথ তাকে সন্তান জন্মদানের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। প্রসবকালেও সুজাতা পাশে পাননি কাউকে। শেষে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। তার বিপ্লবী ছেলে ব্রতী রাষ্ট্রীয় হত্যার শিকার হন, তার লাশের নাম্বার হয় ১০৮৪। সুজাতার পরিচয় হয় ‘হাজার চুরাশির মা’ বলে।
আরও পড়ুন
ইমদাদুল হক মিলনের ‘একাত্তর ও একজন মা’
১৯৭১ সাল। দশ ছেলেমেয়ে নিয়ে বিধবা হলেন এক মা। বড় ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে নাইট কলেজে আর ঢাকা থেকে টঙ্গিতে গিয়ে চাকরি করছে। বড় মেয়ে এবং মেজো ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। অন্য ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ে। ছােট মেয়েটি কোলে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ঠিক গুলি করে হত্যা করলাে না তার স্বামীকে, হত্যা করলাে অন্য ভাবে। ঘরে দশটি টাকা নেই, খাবার নেই। দেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। দশ ছেলে-মেয়ে নিয়ে অসহায় মা শুরু করলেন বেঁচে থাকার যুদ্ধ। এই উপন্যাস এক বাঙালি মায়ের জীবনযুদ্ধের অনুপুঙ্খ কাহিনি।
আনিসুল হকের ‘মা’
আনিসুল হক রচিত মা উপন্যাসটি ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি তার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ। এটি বাস্তব ঘটনাভিত্তিক উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ ও তার মায়ের জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত হয় উপন্যাসটি। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। যুদ্ধের সময় আজাদের বাড়িতে রেড হয়, আজাদ তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ধরা পড়েন। এসময় আজাদকে ভাত খাওয়াতে না পেরে আজাদের মা আর কোনোদিন ভাত খাননি। যুদ্ধের ১৪ বছর পরে মা মারা যান, নিস্ব অবস্থায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে কবরে শায়িত করলে আকাশ থেকে ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে বৃষ্টি।
আনিসুল হকের ‘কখনো আমার মাকে’
বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায়। টিনে ছাওয়া বাংলো বাড়ি, বাড়ির সামনে বাগান, কাঁটামেহেদির বেড়া, কামিনী ফুলের পাগল-করা গন্ধ—এ-ই ছিল সত্তরের দশকের মফস্বল শহরগুলো। তেমনই এক শহরে দুই মায়ের সংসারে বড় হচ্ছিল চার ভাই-বোন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা বাবা সরকারি চাকরি হারান অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করার অপরাধে। কারাগারে যেতে হয় বাবাকে। বড় ভাই বাবুল সংসারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ সংবাদ দেন ছোটমা, হাসপাতালে শেষ শয্যায়। জানিয়ে যান, কেন মা কখনো গান করেননি। কে তাঁর কণ্ঠ থেকে গান নিংড়ে বের করে নিয়েছিল! এমনই কাহিনি নিয়ে এগিয়েছে উপন্যাসটি।
এসইউ/এমএস