ভিডিও EN
  1. Home/
  2. একুশে বইমেলা

স্বপ্নের সাথে বৈরিতা: অস্তিত্ব ও আত্মবোধের লড়াই

জাগো নিউজ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০৩:১২ পিএম, ০৫ মার্চ ২০২৪

সুবাইতা প্রিয়তি

মানুষ বাঁচার জন্য স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নকে ভর করে বাঁচে। স্বপ্নহীন জীবনে বাঁচা যেমন প্রকৃত বাঁচা নয়; তেমনই জীবনের ওপর যদি স্বপ্ন সিন্দাবাদের ভূতের মতো ভর করে বসে তখন প্রাণধর্ম নির্বাসিত হয়। ‘স্বপ্নের সাথে বৈরিতা’ উপন্যাসে লেখক আবুবকর গিয়াসুদ্দীন যে নারী কেন্দ্রীয় চরিত্রকে চিত্রায়িত করেছেন, সেটি ট্র্যাডিশনকে ভেঙে দেওয়া হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।এ বছর অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত মৌলিক উপন্যাসটিতে লেখক অন্তরস্থ চেতনা ও শিল্পীর উপলব্ধিকে ভাষাগত শরীর দিয়েছেন। শিল্প শিল্পীকে টেনে আনে—প্রমাণ করতেই যেন বইটির প্রচ্ছদ করেছেন এক নবীন প্রচ্ছদকার উম্মে মেহরিন মারিয়া। কর্মের যথাযথ নামকরণ শিল্পীর অনন্যতাকে প্রকাশ করে। দ্বৈতসত্তা ও অস্তিত্বের দ্ব্যর্থতা ব্যক্তির অভ্যন্তরে যে সংঘাত তৈরি করে, তা বাইরের প্রতিকূলতার থেকে বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। ঘটনার সামগ্রিকতা কখনো কখনো নিয়তির চেয়ে এক কাঠি সরেস হয়ে ওঠে—প্রমাণ করাই ‘স্বপ্নের সাথে বৈরিতা’ উপন্যাসের সার্থকতা।

নিরিবিলি যে যাপনে লুনের উত্থান, সেখানে সে বড় হওয়ার স্বপ্নকে লালন করে প্রথমেই চ্যালেঞ্জ করে সমাজ, প্রতিবেশ ও বর্ষীয়ান রীতিকে। কাছাকাছি সময়ে তার জীবনে দুটো বার্তা আসে, একটি নারীজীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত, অপরটি দস্তয়েভস্কির অমোঘ নিয়তিকে টেনে আনে যেন। জামাল মোরশেদের আগমন সমাজ-সংস্কার অনুসারে এ উপন্যাসে অপ্রাসঙ্গিক নয়। এমন মানুষের উদাহরণ যুগে যুগে অঢেল, যারা অপরের গেরস্থালি বিষয়ে চিন্তিত। লুনের বিবাহের মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে তার অনধিকার চর্চা সমাজের সংখ্যাগুরু মানুষের লালিত ক্ষুদ্র মানসিকতার প্রতীক। আর আসে পলাশের প্রেম নিবেদন। যে আত্মবিশ্বাস ও প্র্যাগম্যাটিক মনোভাব নিয়ে লুন পলাশকে প্রত্যাখ্যান করে, তা একদিকে শতাব্দীর বহুল ঈপ্সিত চর্চা ও অপরদিকে কঠিন ব্যক্তিত্বকে নির্দেশ করে। কিন্তু যে পাথরভার বুকে নিয়ে সে প্রথম বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়, তার জন্য দায়ী ঘটনা কখনোই অপ্রতুল নয়। ‘বড়ো আপুর জীবন এখানেই থামলো, আর কী!’—এটি বোন বইচি চরিত্রের মুখ দিয়ে বলানো প্রফেসি। জীবন মৃত্যু ব্যতিরেকে কখনো থামে না, তাহলে ঔপন্যাসিক কি এখানে আত্মার মৃত্যুকে ইঙ্গিত করেছেন? হার অর্থে বিয়ে? নাকি বিবাহসঙ্গীর নির্লিপ্ততায় কোমল হৃদয়ের ক্ষয় অর্থে? পাঠক তা বিচার করবেন। স্বভাবতই এ বিয়ে টেকার নয় জেনেও লুন সমাজের মুখ বন্ধ করতে আত্মবিসর্জন দেয়, অপাত্রে বিসর্জনের ফল ভালো হয় না।

আরও পড়ুন
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী: একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস
উদার আকাশ: সত্যনিষ্ঠতায় তুলনাহীন

দ্বিতীয়বার বিয়ের ক্ষেত্রে লুন মনের ডাকে সাড়া দেয়। নিয়তি তখনো অনুকূল হয় না, হওয়ারও নয়। নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া ব্যক্তিরাই আক্রান্ত হয় বেশি। অনাগত সন্তানের মৃত্যু ও হাসিবের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ লুনকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিতে পারতো, এখানেই চরিত্রটির অলৌকিকতা। তাবৎ বাঙালি নারীর মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ডিঙিয়ে লুন ভাঙা স্বপ্ন ও আহত মনকে যাপন করার জন্য বেঁচে ওঠে। প্রতীক্ষিত আদর্শ নারী আঙ্গিক গড়তে লেখক লুনকে দ্বিতীয় জীবন দান করেন। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নয়, পেছনে ফিরে বিচার করতে। লুন যাচাই করে দেখে সে কতটা কঠোর ছিল ভ্রান্তির ছলনায়, আত্মবিশ্বাসের নাম করে স্বার্থপর ছিল যে স্বপ্নের দায়ে, তা আজ তাকেই মাড়িয়ে গেছে। স্বপ্নের জন্য জীবন নয়, মানবজীবনের জন্যই কার্যকরী স্বপ্ন। সমাজ, সময় ও প্রতিকূল মতবাদই শুধু তার সাথে শত্রুতা করেনি—সে বৈরিভাবাপন্ন ছিল স্বয়ং নিজের প্রতি। স্বচ্ছল একটি পরিবারে জন্ম নিয়েও লুন ট্র্যাজেডি এড়াতে পারে না। তার অস্তিত্ব চৈতন্যের সাথে লড়াই করেছে। অবশেষে আত্মপরাভব আত্মবোধের জন্ম দিয়েছে।

লুন চরিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিবরান লুনের ভগ্নাবস্থাকে স্থিতিশীলতা দেন। যে প্রেমবোধ অস্থিরতা দেয় না, পুলকিত বেদনাই যার একমাত্র দান, কেবল গভীর এক প্রশান্তিতে সাধারণ মানুষকে দার্শনিক করে তোলে; সেই নিষ্কাম প্রেম লুনকে জাগ্রত করে। ‘অবেলায় তোমাকে ভালোবাসলাম, লুন’—এ সম্ভাবনা ও অসম্ভাব্যতায় ভর করে সে স্বপ্নকে বর্তমানের সাথে মডিফাই করে। তার ঠিক বিপরীত চরিত্র বোন বইচি যে মুহূর্তে সফল জীবনের স্বাদ আস্বাদন করছে, সে মুহূর্তে সে এক মূর্তিমান উদাহরণ। এই সমাপ্তি নিষ্ঠুর নয়, মানবেতর-জটিল ও অস্বাভাবিক নয়, সাবলীল। শেষটায় লুন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, বোন বইচির কথায় উত্তর করে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ‘লালসালু’ উপন্যাসে প্রাণধর্মের প্রতীক জমিলার ইতি টেনেছিলেন যে ম্যাজিক বাক্যটি দিয়ে, তার সাথে এই সমাপ্তি সাযুজ্যপূর্ণ। পাঠকের আকাঙ্ক্ষা—লুনদেরই জয় হোক, কিন্তু জয় যে বড়ই দুর্লভ!

নিভৃতচারী সাহিত্যিক আবুবকর গিয়াসুদ্দীনের এটি চতুর্থ গ্রন্থ হলেও প্রথম উপন্যাস। যেখানে অলংকারের চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে ভাবনা, চরিত্রের চেয়ে চেতনা। সুখের উৎস কেবল প্রাপ্তির তৃপ্তিই নয়, আর প্রাপ্তিমাত্রই বস্তুগত ও স্পর্শযোগ্য নয়—চেতনা ও দর্শনের এই স্তর থেকে বার্তা পৌঁছে দেওয়াই লেখকের কাম্য।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন