ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচ্ছদের কাজ করা যায় না
আইয়ুব আল আমিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় পড়াশোনা করে খ্যাতি পেয়েছেন প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে। খ্যাতি পেয়েছেন প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে। দিন যাচ্ছে আর খ্যাতির সীমানা প্রসারিত হচ্ছে। এবারেও বইমেলা উপলক্ষে শত বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। লিখছেনও সমান তালে। প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদশিল্পী, শিল্পমান আর বই নিয়েই সম্প্রতি কথা হয় এ তরুণ শিল্পীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: প্রচ্ছদ আঁকতে আঁকতে বইমেলার মানুষ হয়ে উঠলেন। মেলার আঙিনার মতো বাড়ছে প্রচ্ছদ আঁকার আঙিনাও। বইয়ের মেলাকে কতটুকু আপন জানলেন?
আইয়ুব আল আমিন: আমি যখন মেলায় আসতে পারতাম না মানে ঢাকার বাইরে থাকতাম তখন মেলায় প্রকাশিত বই সেখান থেকেই সংগ্রহ করে পড়তাম। তখনই মেলা আমাকে আকর্ষণ করতো খুব। মনে হতো ইস! মেলায় ঘুরে ঘুরে যদি পছন্দের বইগুলো ইচ্ছামতো কিনতে পারতাম। তারপর ঢাকায় এলাম। প্রতিবছর মেলায় যাই, অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকি। আমার মনে হয় মেলায় না এসেও যতটা মেলায় ছিলাম তখন, এখন এসেও অতটা নেই মেলায়।
সংস্কৃতি তো নদীর মতো। নদীর প্রবাহকে আপনি কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারবেন না। পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে, হাইকোর্টে আইন করে সংস্কৃতি ঠেকানো যায় না। অনেকেই বলছেন এমনটা চলতে দেওয়া যায় না। ওটুকুই। এটা চলবেই। আশঙ্কার কথা হলো গোটা জাতির তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধ এটার সঙ্গে জড়িত। তারা এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে যতটা উৎসাহী এটা আপনি ঠেকাবেন কীভাবে!
জাগো নিউজ: আপনি এখন লেখকও বটে। আগের বই ‘কামনাবাসনালয়’ বেশ সাড়া ফেলেছে। এবারে ‘বুক পীঠের গল্প’ নিয়ে কী বলবেন?
আইয়ুব আল আমিন: আমাকে ওই অর্থে লেখক বললে ভুলই হবে। কারণ আমি লিখবো সেই লেখা প্রকাশ করবো বা প্রকাশ করতে হবে এটি মাথায় রেখে কোনোদিনও লিখিনি। আমি বিভিন্ন সময় অল্পবিস্তর লিখতাম, সেটার কোনো কোনোটা আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টও করতাম। সেটা দেখে অনেকে বললো বই প্রকাশ করতে। আমার মন এতে সায় দেয়নি। তারপরও কীভাবে কীভাবে যেন হয়েও গেলো। সেই বইই আমার প্রথম বই ‘কামনাবাসনালয়’।
আরও পড়ুন
• বইমেলার শেষ শুক্রবারে ভালো বিক্রিতে খুশি লেখক-প্রকাশকরা
• পড়ার আগ্রহ থেকে একরামুলের সংগ্রহে এখন ১২০০ বই
কিছু সাড়াও পেলাম আপনজনদের কাছ থেকে। আপনজনদের বললাম এজন্য যে ওই বইটা আমার বন্ধু-বান্ধব, আপনজনরাই কিনেছিল। তাছাড়া অচেনা অজানা একজন মানুষ কেন কিনবে আমার বই! এরপর করোনাকালে আরও কিছু লেখা হলো ওভাবেই। তবে আগের চেয়ে এবারের লেখাগুলো হলো অনেকটা গোছানো। সেই লেখাগুলো দিয়েই হলো আমার দ্বিতীয় বই ‘বুক ও পিঠের গল্প’। বইতে গল্পগুলো সব বুক ও পিঠেরই অর্থাৎ ভালোবাসার এবং ভালোবাসাহীনতার। এই বইটি পড়ে আনেকেই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বলেছে তাদের কাছে বইটি ভালো লেগেছে। তবে সেটাও খুব হাতে গোনা কিছু মানুষ। ওটুকুই আমার পরম পাওয়া, আমার ভালোবাসা।
জাগো নিউজ: বইয়ের থিম জেনেই প্রচ্ছদ করেন। লেখকদের লেখার মান নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ?
আইয়ুব আল আমিন: বইমেলা ছাড়াও প্রচ্ছদ কমবেশি সারাবছরই করা হয়। আমি প্রচ্ছদ করার জন্য লেখক বা প্রকাশকের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। যদিও বইমেলার সময় পুরো পাণ্ডুলিপি পড়া হয় না। ভূমিকা পড়ে বা বইয়ের মূলভাবটা জেনে নিয়ে কাজটা করি। অন্য সময় হলে আমি পড়ি বা বলতে পারেন পড়ার চেষ্টা করি। তার মধ্যে বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপিই পড়া শেষ করতে পারি না। লেখার মান নিয়ে যেটা জানতে চাইলেন আশা করি তারও উত্তর আপনি পেয়ে গেলেন। তবে একজন ক্ষুদ্র পাঠক হিসেবে এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মানদণ্ডে বলা। হয়তো এ লেখাগুলোই আনেকের কাছে ভালোও লাগছে।
জাগো নিউজ: বাংলা সাহিত্যে বিশেষ শূন্যতা বিরাজ করছে কি না?
আইয়ুব আল আমিন: বাংলা সাহিত্যে যদি বলেন তাহলে বলবো আমার মনে হয় না যে বিশেষ শূন্যতা আছে। দুই বাংলায় অনেক লেখক অনেক লিখছেন প্রতিনিয়ত। যার মধ্যে ভালোও লিখছেন অনেকে। তবে হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সাহিত্যও অনেকটা সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে সোশ্যাল মিডিয়াতে যারা আছেন তাদের সবারই কেউ লেখক, কেউ শিল্পী, কেউ অভিনেতা।
যার যা ইচ্ছা লিখছেন, গাইছেন, অভিনয় করছেন। যার সেগুলোর বেশিরভাগই মানসম্মত নয়। আসলে এসবের বাইরে নিভৃত সাধনায়ও কিন্তু অনেকেই কাজ করছেন যা সবার চোখে হয়তো পড়ছে না। তবে হতাশা যে একেবারেই নেই এমনটাও না। আপনি শূন্যতার কথা বললেন, প্রকৃতি কিন্তু শূন্যতা পছন্দ করে না। কোনো জায়গা শূন্য হয়ে গেলে প্রকৃতি সেটা পূরণ করে ফেলে। সেটা ভালো মন্দ যা দিয়েই হোক। ভালো হলে তো হলোই, মন্দ হলে বিধি বাম।
জাগো নিউজ: বইমেলা ঘিরে বেশকিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। খবর রাখছেন নিশ্চয়। অন্য আর দশটি মেলার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছি কি না আমরা?
আইয়ুব আল আমিন: এখন কোনো খবরই আর না রাখার মতো নেই অপনিও সেটা জানেন। জানতে না চাইলেও যে কোনোভাবেই হোক আপনাকে জানানো হবেই। জানতে আপনি বাধ্য, বিষয়টা হয়েছে এমন। তবে আমার মনে হয় বইমেলার মতো একটা ইভেন্টে এসব আমলে নেওয়ার মতো কিছু নয়। এসব থাকবেই। আসবে আবার আপনা আপনি চলেও যাবে। মনে রাখবে না কেউ এদের।
চাইলেও ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা যায় না। দেখা যায় একটা প্রচ্ছদ করতে আমার তিনদিন লেগে যাচ্ছে। আমার মনমতো কাজটা কোনোভাবেই হচ্ছে না। আবার চেঞ্জ করছি আবার রিজেক্ট করছি। যদি ব্যবসার কথা মাথায় থাকতো এই তিনদিনে আমি চাইলে বেশ কয়েকটি প্রচ্ছদ করে ফেলতে পারতাম। সেটা তো পারি না।
সংস্কৃতি তো নদীর মতো। নদীর প্রবাহকে আপনি কোনোভাবেই বন্ধ করতে পারবেন না। পুলিশ-মিলিটারি দিয়ে, হাইকোর্টে আইন করে সংস্কৃতি ঠেকানো যায় না। অনেকেই বলছেন এমনটা চলতে দেওয়া যায় না। ওটুকুই। এটা চলবেই। আশঙ্কার কথা হলো গোটা জাতির তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধ এটার সঙ্গে জড়িত। তারা এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে যতটা উৎসাহী এটা আপনি ঠেকাবেন কীভাবে!
পরকীয়া, যৌনতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এমনকি লেখকের বাস্তব জীবনের যৌনতা নিয়েও বিখ্যাত অনেক লেখকের বিখ্যাত বিখ্যাত বই আছে। সেগুলো নিয়ে তো কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা সেসব জানেও না। বইতো পড়ে না। শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখে দেখে এসব ঘটছে। আমি হলফ করে বলতে পারি এই বইগুলোও তারা পড়েনি। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, কোনটা স্থূল কোনটা পরিশীলিত সেই মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে না পারলে এসব ঠেকাতে পারবে না কেউ কখনো। আমার মতে স্বইচ্ছায় দুজন মানুষের মধ্যে যৌনতায়, বিবাহে, মেলামেশায় কোনো অপরাধতো নেই-ই বরং এটা সুন্দর। কিন্তু এর প্রকাশ এবং গ্রহণটা অসুন্দর হলে সেটা অবশ্যই খারাপ।
জাগো নিউজ: অসংখ্য প্রচ্ছদ করেন মেলা উপলক্ষে। ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়েই নাকি আনন্দের সঙ্গে কাজ কাজ করছেন?
আইয়ুব আল আমিন: চাইলেও ব্যবসাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা যায় না। দেখা যায় একটা প্রচ্ছদ করতে আমার তিনদিন লেগে যাচ্ছে। আমার মনমতো কাজটা কোনোভাবেই হচ্ছে না। আবার চেঞ্জ করছি আবার রিজেক্ট করছি। যদি ব্যবসার কথা মাথায় থাকতো এই তিনদিনে আমি চাইলে বেশ কয়েকটি প্রচ্ছদ করে ফেলতে পারতাম। সেটা তো পারি না। তবে অর্থনৈতিক ব্যাপারটা তো থাকেই।
মনের আনন্দ নিয়েই কাজ করি। আর কাজ করলে তো টাকা পাবোই। ওটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। এই সুযোগটাই আবার অনেকে কাজে লাগায়। কাজ হয়ে যাওয়ার পরও কিছু বলছি না দেখে চোখ বন্ধ করে আমার টাকাটা মেরে দেয়।
জাগো নিউজ: লেখা, প্রচ্ছদ নিয়ে কোথায় যেতে চান?
আইয়ুব আল আমিন: একজন শিল্পী তার শিল্প নিয়ে যেখানে যেতে চায় সেখানে একজীবনে যেতে পারে না। শিল্পীর পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি কখনোই আসে না। তবে চেষ্টা থাকে প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করার। আর এই প্রচ্ছদ নিয়ে বহুদূর যাওয়ার পরিসরও অনেক বড় নয়। একজন বিখ্যাত কোনো লেখকের বিখ্যাত কোনো বইয়ের কন্টেন্টকে সেই বইয়ের প্রচ্ছদ কখনো ছাপিয়ে যেতে পারে না। আমার মনে হয় জগদ্বিখ্যাত কোনো লেখকের জগদ্বিখ্যাত কোনো বইয়ের প্রচ্ছদটা সেই বইয়ের বিষয়বস্তুর চেয়েও সুন্দর হবে, এমন একটা প্রচ্ছদ যদি কোনোদিন করতে পারতাম।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম