পণ্যসংস্কৃতির প্রচারণায় মানুষ সুখ খুঁজছে: আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত, আলোচিত কবি ও নজরুল গবেষক। কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়া, গবেষণা ইত্যাদি মিলিয়ে এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৭। তিনি একসময় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। তখন বাংলা একাডেমি ও বইমেলা ইত্যাদি সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিছুটা সংশ্লিষ্টও ছিলেন।
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: তন্ত্র থেকে দূরে; মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম; শেষ হেমন্তের জোছনা; কুয়াশার বর্ণমালা; পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি; স্বপ্নের হালখাতা; জলচিঠি নীল স্বপ্নের দুয়ার; শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ; জোছনার রাত বেদনার বেহালা; আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস একাউন্ট; ভালোবাসার ভূগোলে; প্রেমসমগ্র; কবিতাসমগ্র প্রভৃতি।
তিনি সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ সাংগঠনিক সম্মাননা; বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার; শিশুকবি রকি সাহিত্য পুরস্কার; নজরুল সংগীতশিল্পী পরিষদ সম্মাননা; গাঙচিল সাহিত্য পুরস্কার; কবিকুঞ্জ পদক এবং আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
সম্প্রতি বইমেলা ও বই প্রকাশ সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—
জাগো নিউজ: আগামী বইমেলায় আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হচ্ছে?
আমিনুল ইসলাম: অন্তত কবিতার বই ১টি এবং প্রবন্ধের বই ১টি। বেশিও হতে পারে।
আরও পড়ুন: মেলাকে পাঠক উপযোগী করা হোক: খান মুহাম্মদ রুমেল
জাগো নিউজ: বাংলা একাডেমি আয়োজিত আগামী বইমেলা কেমন দেখতে চান?
আমিনুল ইসলাম: একুশে বইমেলা আমাদের সবচেয়ে বড় মিলন-উৎসব। ঈদ, পূজা, নববর্ষ সবই একদিনের উৎসব। কিন্তু বইমেলা মাসজুড়ে আলোকিত আনন্দ আয়োজন। বাঙালি জাতি এবং তার একমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের গড়ে ওঠার পেছনে কবি-সাহিত্যক-শিল্পী-বাউল-যাত্রাশিল্পী-লোক গায়ক—এদের সম্মিলিত ও ধারাবাহিক ভূমিকা ছিল। অবশ্য রাজনীতি এদের কথা বলে না, বলবে না। এদের কথা বলে এবং বলবে মূলত লেখকগণ। আর লেখক-প্রকাশক-বইপ্রেমীদের বার্ষিক মহামিলনের প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। আমার চাওয়া হচ্ছে—একুশে বইমেলার ক্রম-অগ্রগতি ও ক্রম-উন্নয়ন। উন্নত মানের বইয়ের প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার ঘটানোর ব্যাপারে বাংলা একাডেমি এবং প্রকাশকদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
জাগো নিউজ: আপনার দেখা বইমেলায় কোনো অসংগতি ধরা পড়েছে?
আমিনুল ইসলাম: এটা সত্য যে, ২০২৩ সালের একুশে বইমেলা তুলনামূলকভাবে সুন্দর ছিল; গোছানো ছিল। সার্বিকভাবে সফল হয়েছিল। তবে নিরাপাত্তার অজুহাতে ছুটির দিন ছাড়া বাকি দিনগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিকের গেট বন্ধ রাখা ছিল বইমেলায় গমনকারীদের জন্য বড় ধরনের দুর্ভোগের কারণ। নিরাপত্তার অজুহাতে সবচেয়ে নিরাপদ, স্পেশাস ও সুন্দর গেটটি বন্ধ রাখা হচ্ছে মাথা কেটে মাথা ব্যথা দূর করার উপমা। আরেকটি বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল—বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে যেসব বইকে মেলার শেষ পর্যায়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল, আমি অন্তত ২টি বই তাৎক্ষণিকভাবে সংগ্রহ করে পড়েছিলাম। একেবারে নিম্নমানের বই। আমাদের প্রাক্তন ও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথা ধার করে বলা যায়: রাবিশ!
জাগো নিউজ: বইমেলায় বই বিক্রি বাড়ছে না কমছে?
আমিনুল ইসলাম: কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে মাঝখানে বইয়ের বিক্রি একেবারেই কমে গিয়েছিল। স্বস্তি এই যে, আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। বই প্রকাশিত হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারেনট ফ্যাসিলিটি, ফেসবুক, রিল, সিনেমায় যৌনতা ও থ্রিলার—এসব বইপড়ার মন তৈরির ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এসব সার্বক্ষণিকভাবে এবং সর্বত্র সহজলভ্য হওয়ার কারণে বই না পড়েও চলছে মানুষের। আগে অনেকে আনন্দের জন্য বই পড়তেন। এখন আনন্দের কত উপকরণ! তাছাড়া পণ্যসংস্কৃতির প্রচারণায় মানুষ সুখ খুঁজছে, আনন্দ খুঁজছে, অন্তরঙ্গ জীবনের ঠিকানা খুঁজছে—অন্যত্র, অন্যকোথাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত ‘জন্মদিনে’ কবিতায় বইপড়ার কারণ ও উপকারিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিপুলা এ পৃথিবীরে কতটুকু জানি।/ দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী—/ মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,/ কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু/ রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;/ মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।/ সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে/ অক্ষয় উৎসাহে—/ যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী/ কুড়াইয়া আনি।/ জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে/ পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।’
আরও পড়ুন: প্রাণ জাগাতে বইয়ের বিকল্প নেই: ইমরুল ইউসুফ
কিন্তু আজকাল জিওগ্রাফি চ্যানেল বা ডিসকভারি চ্যানেল খুললেই পৃথিবীর সমস্ত দেশ, প্রাণী, উদ্ভিদ, সমুদ্র, রাজধানী ইত্যাদি দেখা যায় জীবন্ত ব্যঞ্জনায়। এমনকি ফেসবুক রিল বা ইউটিউব খুলেও এসব দেখা যায়। তাহলে ‘ভ্রমণবৃত্তান্ত’ কেন কিনে পড়বে মানুষ। ভিডিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বাসায় বসে, বাসে বসে, অফিসের বা বাসার কাজের ফাঁকেও। তাহলে ‘চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী’ পড়ার দরকার কী? তো নানাবিধ কারণে মানুষ চলে যাচ্ছে বইয়ের ভুবন থেকে অন্য দুনিয়ায়। তারা ভুল না ঠিক, সে প্রশ্ন ভিন্ন কিন্তু তাদের চিন্ময় বিচরণক্ষেত্র অন্যত্র সরে যাওয়ার ব্যাপারটি তো সত্য। আর এবারের জন্য নতুন ভয় হচ্ছে, নিত্য দরকারি জিনিসপত্রের দাম খুবই বেশি। বিল গেটস-শাহরুখ খানদের মতো উজ্জ্বল ব্যতিক্রমীদের কথা মনে রেখেও বলা যায়, ধনীলোকেরা কোনোদিনও সেভাবে বই কেনেন না। কিনবেন না। বই কেনে মূলত মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত। এই দুই শ্রেণির মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে। বিষয়টি ২০২৪ সালের একুশে বইমেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না বলা যায় না।
জাগো নিউজ: বইয়ের প্রচারণাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
আমিনুল ইসলাম: বইয়ের প্রচারণার বিষয়টি আমি খুবই ইতিবাচক চোখে দেখি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’ এখন কথাটি ঘুরিয়ে বলার সময় এসে গেছে। এখন ‘সেই সত্য যা বলিবে মিডিয়া, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’ এমনকি এখন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, ভাষা সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদির প্রধান অস্ত্র মিডিয়া তথা প্রচারণা। আর এখন তো পণ্যসংস্কৃতির রমরমা অবস্থা। গ্রন্থপাঠ থেকে মানুষের মন ও রুচিকে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে পণ্যসংস্কৃতি প্রযোজিত ও পরিচালিত মিডিয়া। বইকেও কমবেশি এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। বই যদি পণ্য হয় এবং বাজার দখল করতে পারে, তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত আমি। ভালো জিনিসের বাজার সম্প্রসারিত হলে তার ভোক্তা ও ক্রেতা বাড়লে সেটি সমাজের জন্য ভালো হবে। বই তো সবচেয়ে ভালো একটি জিনিস। বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান যেমন অতুলনীয় মানের অলরাউন্ডার অভিনেতা, তেমনই তার প্রচারকৌশলও অনন্য। বইয়ের প্রকাশক ও লেখক উভয় দলকেই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে।
জাগো নিউজ: বইমেলায় পাঠকের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
আমিনুল ইসলাম: আমি বলবো—বেশি বেশি বই কিনুন, বই পড়ুন। আমি প্রায় ৩৫ বছর সরকারি চাকরি করেছি। দেখেছি সারাদেশ এবং পৃথিবীর বহু দেশ, বহু রাজধানী, বহু সমুদ্র, বহু বনভূমি এবং হাজার কিসিমের মানুষ। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বইপড়ার অভ্যাসটা রয়ে গেছে। বইপড়ার কোনো বিকল্প নেই, বই পড়ার বিকল্প হয় না। আমি ফেসবুকে সক্রিয় ও সোচ্চার, আমি প্রচুর সিনেমা দেখি, ফেসবুকে রিল-ভিডিও-স্টোরি দেখি। নেটে বসে পড়ি নানারকমের সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও সিনে-ম্যাগাজিন। আবার একইসঙ্গে প্রতিদিন বই পড়ি। আমার সংগ্রহে কয়েক হাজার বই আছে। প্রতি বছর বই কিনি; প্রায় প্রতি মাসেই বই কিনি। ছাত্রজীবনে সিগারেট খেতাম। ছেড়ে দিয়েছি। চা খাই না। মদ খাওয়ার মাঝে প্রগতিশীলতার আলো কিংবা বেখুদি হওয়ার আনন্দ খুঁজি না। আমার অনিঃশেষ ও অদম্য আনন্দ—বইপড়া, গান শোনা আর লেখালেখি। কিন্তু বইপড়ার আনন্দ অনেক গভীর, অনেক বিচিত্র এবং অনেক উন্নতমানের। ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন, ‘Some books are to be tasted, others to be swallowed, and some few to be chewed and digested.’ তিনি যথার্থ কথাটিই বলেছেন।
আরও পড়ুন: গোছানো ও পরিপাটি বইমেলা চাই: রনি রেজা
প্রিয় পাঠক, জীবন তো একটাই এবং ওয়ানটাইম। কেন নিজেকে বঞ্চিত করবেন বইপড়ার এই বহুবিধ ও বহুমাত্রিক আনন্দ থেকে? একমাসে মোবাইল ফোনের পেছনে ন্যূনতম যত টাকা ব্যয় হয়, তা দিয়ে তো এক অথবা একাধিক বই কেনা যায়। সব ধরনের ব্যয়-অপব্যয়ের টাকা জুটবে, শুধু বইকেনার সময় দেউলিয়া—এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আসুন ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায়! ব্যাগভর্তি বই কিনুন! বাসায় নিয়ে যান। পড়ুন সারাবছর। কোনো বই হালকাচালে পাতা উল্টায়ে পড়বেন। কোনোটি গ্রোগ্রাসে গিলে খাওয়ার মতো করে পড়বেন! আবার কোনো কোনোটি চিবিয়ে চিবিয়ে ধীরে ধীরে পড়বেন!
এসইউ/জেআইএম