প্রেয়সী: প্রেম ও দরদের দরিয়া
ছোটগল্প কথাসাহিত্যের এক বিশেষ রূপ, যা দৈর্ঘে হয় ছোট এবং একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ছোটগল্পের আকার কী হবে? সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। একটি কাহিনি বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কিছু নান্দনিক ও শিল্পশর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন- ছোটগল্পের প্রাণ হবে খুবই ছোট, যেখানে বাহ্যিক বিষয়ে কোনো বর্ণনা থাকবে না। এর যাত্রা হবে সাহিত্যিকদের মত অনুযায়ী চকিত চমকে, রবীন্দ্রনাথের মত অনুযায়ী ছোটগল্পের সমাপ্তি হবে এমনভাবে, যেখানে পাঠকের মন অতৃপ্ত থাকবে। এ ছাড়াও নাটকীয়তা, সংঘাত, ব্যঞ্জনাধর্মিতা, ক্লাইমেক্স ছোটগল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এসব বিষয়ের সম্মিলিত প্রয়াস নিয়ে মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার লিখেছেন তার প্রথম ছোটগল্পের বই ‘প্রেয়সী’।
লেখক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দারের জন্ম খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার গাড়াখোলা গ্রামে। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে তার প্রথম লেখা প্রকাশ হয়। লেখকের গবেষণা প্রবন্ধ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে কলাম, ছোটগল্প, ফিচার ও কবিতাসহ প্রায় দুই শতাধিক লেখা প্রকাশ হয়েছে।
বাবুই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘প্রেয়সী’ বইটিতে লেখক এগারোটি ছোটগল্পকে স্থান দিয়েছেন। তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন তার পিতা-মাতাকে। বইটির প্রথম গল্পের নাম ‘কালের স্রোতধারা’। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পটি সাধারণ বিচ্ছেদের প্রেমের গল্প। প্রেম-বন্ধনের মাঝে বেকারত্ব নামক দুঃসহ বাধা প্রায়ই হয়ে ওঠে প্রেমের হন্তারক। চাকরি না পাওয়া এক যুবকের বেদনা এবং প্রেমিকার আত্মহত্যা পাঠকের মনে শীতল মেঘের আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। লেখক বলেন, ‘চাকরিই কি বিয়ের একমাত্র মাপকাঠি? মনকে যে জয় করেছে, সেটি যে ছোটখাটো কোন বিষয় নয়। মানুষের মন জয় হিমালয় জয়ের চেয়েও কঠিন। কিন্তু তার কোন পুরস্কার এ সমাজ দিতে চায় না। তারা চাকরিকে যোগ্যতার মাপকাঠি মনে করে। মনকে বাণিজ্যিকীকরণে এ সমাজ সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’ দারুণ ভাষায় লেখক এক নিদারুণ বাস্তব বিষয় তুলে ধরেছেন।
আরও পড়ুন: একাত্তরের ডায়েরী: কাব্য ও ভাষাশৈলীর সমতল ভূমি
‘রাতের গভীরতায় আতঙ্কিত তুমি’ করোনাকালীন প্রেমের গল্প। লেখকের বন্ধু মারুফ। মারুফের কাজিন আফরোজার প্রেমে পড়েন লেখক। দুজনের প্রেমের স্রোত এগিয়ে চলে এক চেনা নরম নদীর মতো। কিন্তু দুজনের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় করোনা। আফরোজার বাবার মৃত্যু হয়। পরিবারে জীবন সংকট ও মৃত্যুভয় জেঁকে বসে। আফরোজার সঙ্গে লেখকের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পূর্ববর্তী গল্পের মতো এটাও বিচ্ছেদে সমাপ্তি। এই গল্পে লেখকের দার্শনিক সত্তা ও জ্ঞানের উদ্ভাসিত নমুনা পাওয়া যায়। গল্পে আছে, ‘মনের দর্শন, দর্শনের একটি শাখা যা দেহের সাথে অ্যান্টোলজি, প্রকৃতি এবং মনের সম্পর্কের অধ্যয়ন করে। দ্বৈতবাদ এবং একত্ববাদ মন-দেহের সমস্যা সম্পর্কিত দুটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, যদিও সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি উত্থাপিত হয়েছে। যেগুলো এক বা অন্য শ্রেণির সাথে খুব সুন্দরভাবে খাপ খায় না।’ এ রকম আরও কিছু বিষয়ে লেখকের দর্শন ভাবনার সঙ্গে পাঠক পরিচিত হতে পারবেন।
‘রহস্যময়ী নাকি ধ্রুব’ গল্পটিও উত্তম পুরুষে লেখা এক বিচ্ছেদের গল্প। যেখানে আফরিন নামের এক মেয়েকে তার পছন্দ হয় কিন্তু বিষয়টি মেয়েকে জানানোর সাহস পায় না। হঠাৎ একদিন আফরিন তার বিয়ের কার্ড দিয়ে লেখককে সারপ্রাইজ দেয়। ‘বিপ্লবীদের প্রেম করতে নেই’ গল্পে লেখক নিজেই বিপ্লবী বেশে হাজির হয়েছেন। জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সরকারের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা। লেখক বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয়। প্রেমিকা স্বর্ণা ও বন্ধু মমিন তাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারেনি। আন্দোলনে লেখক আহত হন। গল্পে লেখক বলেন, ‘বিপ্লবীদের প্রেমে পড়তে মানা। তার পরও যদি প্রেমে থেকেও থাকে তবে আবেগ থাকতে নেই।’ গল্পের শেষে এসে লিখেছেন, ‘আর্তনাদ করা বিপ্লবীদের শোভা পায় না। বিপ্লবীদের সবকিছু হাসিমুখে বরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।’
বইয়ের নামগল্প ‘প্রেয়সী’। এটিও উত্তম পুরুষে লেখা এক বিচ্ছেদের গল্প। যেন বিচ্ছেদের বেদনা লেখককে ঘিরে ধরেছে অমাবস্যার অন্ধকারের মতো। গল্পটি বৃষ্টিস্নাত শ্রাবণ সন্ধ্যায় স্মৃতিকাতরতামূলক গল্প। বর্ষার ছন্দিত তালে তার মনে পড়ে প্রেয়সী অন্নির কথা। অন্নির বৃষ্টিভেজা গতর আজও লেখককে তাড়িত করে। অন্নি দ্বাদশ শ্রেণির পর স্থান ত্যাগ করে সপরিবারে মেহেরপুর চলে গেলে লেখক অন্নির সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি। গল্পে চমৎকার কিছু লাইনের মধ্যে, ‘প্রেমে প্রাপ্তি তৃপ্তি এনে দিলেও বিফলতা অমর করে দেয়।’
আরও পড়ুন: রাহেল রাজিবের প্রেমের কবিতা: বাস্তবতার অভিজ্ঞান
‘সে আসবে চুপিচুপি’ গল্পে লেখক বাস্তবতার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। নারীদের সমাজে মর্যাদা না থাকার দরুণ হয়তো বা প্লেটো ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন তাকে পুরুষ হিসেবে সৃষ্টি করার জন্য।’ ‘আজ তার গায়ে হলুদ’ গল্পে সাক্ষাৎ পাই নতুন মানবিক লেখকের। যিনি রাজনৈতিক সচেতন, দেশপ্রেমিক, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি সহানুভূতিশীল আর বন্ধুর জন্য উজাড় হৃদয়ের অধিকারী। গল্পের একাধিক মোড়, কাহিনি ও ক্লাইমেক্স পাঠককে চমকিত করতে পারে। এই গল্পে মনে রাখার মতো উক্তি, ‘নেশার চেয়ে বড় নেশা আবেগের সম্পর্কের খেলা।’
‘বর্ষা আমার ভালোবাসা’ ও ‘সৌন্দর্যে ঘেরা বসুরাবাদ’ গল্প পাঠ করে পাঠক ভিন্ন সাধ পাবেন। লেখককে নতুন করে জানতে পারবেন। সবশেষে ‘অপেক্ষা’ ও ‘প্রণয়’ গল্প পাঠকের মন ষোলোআনা জয় করতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস। তবে কিছু তত্ত্বগত ত্রুটি চোখে পড়ে। সেসব বিষয়ে লেখককে একটু সচেতন হতে হবে। ‘নিয়ন’ আলোর উৎপত্তি ও ব্যবহার সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা জরুরি।
মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দারের ‘প্রেয়সী’ গল্পগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলায়। তখনই বইটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। আশা করি, ভবিষ্যতে তিনি ছোটগল্পের জগতে স্বমহিমায় নিজের নামটি দুর্দান্ত লেখনীর মাধ্যমে ঠাঁই করে নিতে সক্ষম হবেন। বইটির বহুল প্রচার ও পাঠ কামনা করছি।
বইয়ের নাম: প্রেয়সী
লেখক: মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার
প্রকাশনী: বাবুই
প্রচ্ছদ: প্রিতম পিতু
মূল্য: ১৮০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম