আশা-নিরাশার দোলাচলে বইমেলা
অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের উৎসব। ভাষার মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত বইমেলা আমাদের সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করে। পঠন-পাঠনে আগ্রহী করে তোলে। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি এ পর্যন্ত অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা বাড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন আমাদের প্রাণের উৎসবকে নিষ্প্রাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে কি না—এ নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। কিংবা ঝুঁকি নিয়ে বইমেলা করা আদৌ ঠিক হবে কি না? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাহিত্যকর্মীদের মনে।
বইমেলার জন্য আমরা মনে-প্রাণে প্রস্তুত ছিলাম। কেননা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা অমর একুশে বইমেলা। কিন্তু করোনা পরিস্থতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সব আয়োজন। শঙ্কিত আয়োজক, লেখক, প্রকাশ ও পাঠকরা। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যদি ওমিক্রন এভাবে বাড়তে থাকে, তাহলে বইমেলা করা সম্ভব হবে না হয়তো। তবুও আশায় বুক বাঁধেন সাহিত্যকর্মীরা। কেননা বইমেলার কাছে অনেক প্রত্যাশা তাদের।
তবে আমরা দেখেছি, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলা ঘোষিত সময়ের দুদিন আগেই শেষ হয়েছে। একদিকে করোনাভাইরাস অন্যদিকে লকডাউন-শাটডাউনে মানুষ ছিল ঘরবন্দি। যে কারণে বইপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গত বছর বইমেলায় যাননি বলে প্রকাশক বা বিক্রেতারা ছিলেন হতাশ। এমন প্রাণহীন বইমেলা আগে কখনো দেখেননি বলেও মন্তব্য করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা শুরু হলেও গত বছর ১৮ মার্চ শুরু হয়েছিল অমর একুশে বইমেলা। ওইদিন বিকেল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বইমেলা উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার উদ্বোধনের পরপরই মেলা উন্মুক্ত হয় সবার জন্য। সেই মেলা চলার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। কিন্তু করোনার প্রকোপে নির্ধারিত সময়ের দুদিন আগেই শেষ হয় প্রাণের বইমেলা।
তবে এ বছর অক্টোবর-নভেম্বরে করোনা পরিস্থিতি দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলাম আমরা। ফলে এ বছর অমর একুশে বইমেলা যথাসময়ই শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছিল বাংলা একাডেমি। এরই মধ্যে প্রকাশকরা স্টল বরাদ্দের জন্য টাকা জমা দিয়েছেন। জানুয়ারির শুরুর দিকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলার অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তো বইমেলা নিয়ে অনেক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে কবি-লেখকদের অন্তরে।
কিন্তু হঠাৎ সেই আশায় নিরাশার অন্ধকার যেন ঘনিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে কলকাতার বইমেলা স্থগিত করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একদিনে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বাংলাদেশেও দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে; যা প্রায় তিন মাস পর সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১৭ অক্টোবর ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ফলে বাংলা একাডেমির বইমেলাও অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে হাঁটছে।
অথচ এই একটি মাসের জন্য, একটি বইমেলার জন্য কবি, লেখক, প্রকাশক, পাঠকরা মুখিয়ে থাকেন। প্রাণের মেলায় মিলিত হওয়ার উদগ্র বাসনা নিয়ে অপেক্ষা করেন। দূর দেশ থেকে উড়ে আসেন অনেক বাঙালি কবি ও লেখক। তারাও হতাশা প্রকাশ করেছেন। কারণ যে হারে বাড়ছে ওমিক্রন। তাতে শঙ্কিত করে তুলছে সবাইকে। দেশে আসার জন্য টিকিট বুকিং দিয়েও বাতিল করেছেন কেউ কেউ। গত ২ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। কখন কোন পরিস্থিতি হয়, তা বলা কঠিন!
এদিকে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার নির্দেশনা জারি করেছে। এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কমিটির এক সভায় বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। দেশেও সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, সংক্রমণ আবার বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—শতভাগ সঠিকভাবে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, হাত পরিষ্কার রাখা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন স্থানে পুনরায় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে সব সামাজিক (বিয়ে, মেলা ইত্যাদি), ধর্মীয় (ওয়াজ-মাহফিল) ও রাজনৈতিক সমাবেশ এ সময় বন্ধ করতে হবে। সভা বা কর্মশালার ব্যবস্থা অনলাইনে করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণ ও নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংক্রমণের বিষয়ে নিয়মিত নজরদারির বিষয়ে পরামর্শক কমিটি গুরুত্বারোপ করেছে।
এ অবস্থায় ১৩ জানুয়ারি থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এদিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশবাসীকে ভয় না পেয়ে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘দেশের মানুষের সুস্থতা এবং একজন মানুষও যেন টিকাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা ধরে নিতে পারি, বাংলা একাডেমির বইমেলাও অনিশ্চিত। এতে মন খারাপ হওয়ারই কথা! কিন্তু কী করার আছে? তবে আমি মনে করি, আগে জীবন, আগে বেঁচে থাকা। তারপর অন্য কাজ। সেজন্য গতবারের মতো এলোমেলো বইমেলা না করে বইমেলা বন্ধ রাখাই ভালো! কারণ ওমিক্রনের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে কি বইমেলা যথাসময়ে শুরু করা যাবে? শুরু করলেও করোনা টিকার সনদ নিয়ে যদি পরিবহনে চড়তে হয়, মেলায় প্রবেশ করতে হয়; তাহলে অনেকেই এমন পরিস্থিতিতে বইমেলায় যাবেন না।
এ ছাড়া একই সঙ্গে প্রকাশক, স্টলের সেলসম্যান, লেখক, নিরাপত্তা কর্মী ও অন্যান্য বাহিনী সবাইকেই টিকার সনদধারী হতে হবে। তা না হলে শুধু পাঠক বা ক্রেতাকে সনদের আওতায় আনা ফলপ্রসু হবে বলে মনে হয় না। এরপরও বইমেলা অনুষ্ঠিত হলে পাঠকশূন্য হয়ে পড়বে। তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আয়োজক এবং প্রকাশকরা। তাই অবস্থা বুঝে মেলা থেকে ফিরে আসাই যুক্তিসঙ্গত হবে বলে মনে করি। কারণ আগে তো মানুষের জীবন। যদিও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে চলছে বাণিজ্যমেলা। তাই জানুয়ারি শেষ সপ্তাহে হয়তো আশার আলো দেখা যেতে পারে।
এদিকে বইমেলার জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত চেয়েছে বাংলা একাডেমি। ১১ জানুয়ারি একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওমিক্রনের সংক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় এককভাবে একাডেমির পক্ষে মেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে মেলা করা যাবে কি না বা করা গেলে কখন, সে বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়েছে।
যদিও বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা, আবেগের মেলা, বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসব। বইমেলাকে কেন্দ্র করে নতুন বই প্রকাশের সুযোগ হয়। নতুন লেখক তার অস্তিত্ব ঘোষণা করেন। নতুন ক্রেতাও তৈরি হয়। তারপরও শঙ্কা জাগছে গত বইমেলার কথা চিন্তা করে। ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কারণেই কবি-লেখকরা বারবার প্রার্থনা করছেন, এবারের বইমেলা যেন স্বাভাবিক হয়। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে আবারো ভীত হওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না। আসলে আমরা উভয় সংকটে আছি।
লেখক-প্রকাশকরা হয়তো তাদের গত বছরের ভয়ানক আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবারের বইমেলা চাইবেন। পাঠকরাও হয়তো প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে একটি প্রাণবন্ত ঝলমলে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ মুহূর্তে বইমেলা হলেও সার্বিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—সেটি ভেবে দেখার সময় এসে গেছে। এ অবস্থায় বেশি কিছু আশা করার সুযোগ নেই। তবে আমরা প্রার্থনা করতে পারি, যদি অলৌকিক কিছু একটা ঘটে। হঠাৎ যদি করোনা সংক্রমণ কমে আসে। পরিস্থিতি যেন হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে যায়। লেখকদের আসলে এ ছাড়া কিছু করারও নেই।
তবে ভাবতে হবে বাংলা একাডেমিকে। ভাবতে হবে সরকারকে। বইমেলায় সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করতে হবে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক নিশ্চিত করতে হবে। অসুস্থতার লক্ষণ দেখলে করোনা পরীক্ষা করা উচিত। এমতাবস্থায় মেলা প্রাঙ্গণে না যাওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। মেলাকে সফল করতে হলে সবাইকেই সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। তা না হলে বইমেলা এবারও ব্যর্থ হবে। আর তাই, একটি ব্যর্থ বইমেলা আয়োজনের চেয়ে পিছু হটাই ভালো। পৃথিবী স্বাভাবিক হলে হাজারো সফল বইমেলা উপহার দেওয়া যাবে। সে অবধি আমাদের ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে। অন্তত গত বছরের বইমেলার অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে।
এসইউ/এএসএম