মায়ের লেপা ঘরেই ছবি আঁকার হাতেখড়ি
আইয়ুব আল আমিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় পড়াশোনা করলেও খ্যাতি পেয়েছেন প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে। দিন যাচ্ছে আর খ্যাতির সীমানা প্রসারিত হচ্ছে। এবারের বইমেলা উপলক্ষে শত বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদ শিল্পী, শিল্পমান নিয়েই সম্প্রতি কথা হয় এ তরুণ শিল্পীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : শতেক বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকলেন এবারও। কোন বেলায় এঁকেছিলেন প্রথম প্রচ্ছদ?
আইয়ুব আল আমিন : শৈশবের কথা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ওই সময় বই মলাট না করলে স্যাররা বকা দিতেন। আমি ইংরেজি বইটা মলাট করে তার ওপর বই এর কভারের ছবিটাই হুবহু এঁকেছিলাম। স্যার ক্লাসে ঢুকে আমার বইটা হাতে নিয়েই রাগ করে বললেন বই মলাট করিসনি কেন? স্যার বুঝতেই পারেননি যে আমি বইটা মলাট করে তার ওপর আবার ওই ছবিটা এঁকেছিলাম। কপি হলেও ওটাই ছিল আমার প্রথম প্রচ্ছদ।
জাগো নিউজ : ছবি আঁকবেন, এমন ভাবনা ঠিক কখন থেকে?
আইয়ুব আল আমিন : গ্রামের বাড়ি। আমার মা সুন্দর করে ঘর লেপতেন। আর আমি ওই কাঁচা মাটির সুন্দর সারফেস এর ওপর ঝাড়ুর কাঠি দিয়ে নানান কিছু আঁকতাম। মা বকতেন। তবু শুনতাম না। ছবি আঁকার শুরু এবং ভালোবাসা ওখান থেকেই। মায়ের লেপা ঘরেই ছবি আঁকার হাতেখড়ি।
জাগো নিউজ : এখন অনেকেই প্রচ্ছদ আঁকছেন। বৈচিত্রতাও আসছে। কেমন দেখছেন?
আইয়ুব আল আমিন : আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটাই বৈচিত্রপূর্ণ। এখানকার সংগীত শিল্প সাহিত্যে বৈচিত্রতাটাও তাই স্বাভাবিক। প্রচ্ছদ শিল্পের বৈচিত্রতা আরও বেশি লক্ষণীয়। হাজার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে হাজার হাজার প্রচ্ছদে। বৈচিত্রের সমাহার। তবে একঘেয়েমিও যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়।
জাগো নিউজ : বিজ্ঞাপনের ভারে প্রচ্ছদের শিল্পমান বিলীন হচ্ছে কি-না?
আইয়ুব আল আমিন : প্রাচীনকালে যখন গাছের বাকল বা পাতায় লেখা হত তখন সেই লেখাগুলো যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য ওপরে শক্ত কিছু দিয়ে মলাটের মতো করে রাখা হত। তারপর সেটা যেন সুন্দর দেখায় সেজন্য তার ওপর একটু নকশা। প্রচ্ছদ তখন থেকেই। আজ এটি শিল্প। আর শিল্প সব সময় শিল্পই। সেটা যদি কোনোভাবে বিজ্ঞাপন বহন করে তাতে সেই শিল্পের কিছু যায় আসে না।
জাগো নিউজ : অন্য চিত্রশিল্পী থেকে প্রচ্ছদ শিল্পীকে আলাদা করবেন কি করে?
আইয়ুব আল আমিন : চাইলেই যে কেউ পেইন্টার হতে পারে কিন্তু প্রচ্ছদ শিল্পী হতে পারে না। কারণ প্রচ্ছদ করতে গেলে বিষয়বস্তুর সঙ্গে তো সামঞ্জস্য থাকা লাগেই আবার লেখক এবং পাঠকের মনমতোও হতে হয়। আর এ কাজটি অনেক কঠিন। আর একজন সফল প্রচ্ছদ শিল্পীর পূর্ণতা এখানেই।
জাগো নিউজ : এবারে বইমেলা উপলক্ষে কতগুলো প্রচ্ছদ আঁকতে পারলেন?
আইয়ুব আল আমিন : শতেক হবে হয় তো। আর আমার কাছে সবার সব কাজই উল্লেখযোগ্য। কারণ সবগুলো কাজই আমি সমান ভক্তি নিয়ে করি। তারপরও ভালোমন্দ তো থাকেই। সেটা বিবেচনা করবে পাঠক, আমি কেন?
জাগো নিউজ : প্রচ্ছদ আঁকতে নিজেকে না-কি বইয়ের লেখককে বেশি গুরুত্ব দেন?
আইয়ুব আল আমিন : প্রথমে কন্টেন্ট পড়ে নিয়ে আমার মতো করেই করি। তারপর সেটা লেখককে দেখাই। তার পছন্দ হলে তো হয়েই গেল, না হলে তিনি পরামর্শ দেন এবং সেটা আমি অবশ্যই গ্রহণ করি। কারণ একজন লেখকের কাছে তার বইটা অনেক সাধনার। তিনি যদি তার এত ভালোবাসার বইটার কভারটাতে তৃপ্ত না হন সেটা তো আমারও খারাপ লাগা তাই না?
জাগো নিউজ : প্রতিটি কাজই আলাদা। কিভাবে সম্ভব?
আইয়ুব আল আমিন : পৃথিবীতে কয়েক শত কোটি মানুষ। সবারই একই হাত পা নাক চোখ মুখ তবু কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। কেন? এটিই সৃজনশীলতা।
জাগো নিউজ : প্রচ্ছদ আঁকতে বিশেষত কোনদিক গুরুত্ব পায়?
আইয়ুব আল আমিন : প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে অনেকেই শিরোনামটারই বিভিন্ন আদলে নকশা করে প্রচ্ছদ করেন। এটি আমারও ভালো লাগে কিন্তু আমি এটি করি না। ছবিটার ওপরই আমি শতভাগ গুরুত্ব দেই। আমি এভাবেই কাজ করি। সেক্ষেত্রে যে কোনো বিষয়ই আসতে পারে কন্টেন্ট এর সঙ্গে মিল রেখে।
জাগো নিউজ : কাজে তৃপ্ত কতটুকু?
আইয়ুব আল আমিন : আমি আমার কোন কাজেই সন্তুষ্ট না। সেজন্যই আমার কোনো কাজে নাম সই করি না। আমার কাছে মনে হয় কিছুই হচ্ছে না এগুলো। আরও শেখার অনেক বাকি।
জাগো নিউজ : শিল্পমান নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বেলায় অবক্ষয়ও সৃষ্টি হলো। এ নিয়ে ভাবায়?
আইয়ুব আল আমিন : এটি শুধুমাত্র প্রচ্ছদ শিল্পে নয়, সিনেমা, সংগীত, সাহিত্য, নাটক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও একই অবস্থা। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট। এর জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ধর্মীয়সহ নানা কারণই দায়ী। আমার মনে হয় এ সঙ্কট আরও প্রকট হবে সামনে।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্প কি পার্থক্য আছে?
আইয়ুব আল আমিন : আধুনিক শিল্পের সারকথা হলো সারল্য। উন্নত বিশ্বে বই এর কভারগুলো দেখেন, একেবারে সিম্পল। কোনো হিজিবিজি নেই। আমাদের এখানে এ হিজিবিজিটা হওয়ার পেছনে নানা কারণই আছে। আমার মনে হয় লেখক এবং প্রকাশক শিল্পীকে চাপ দিয়ে এ হিজিবিজিটা করায়। তারা ভাবেন কলেবর বৃদ্ধি করলেই বোধ হয় কাজটা ভালো হবে। কিন্তু আসলে তো তা নয়।
জাগো নিউজ : বইয়ের প্রচ্ছদ কাটতি বাড়ায়, আপনি বিশ্বাস করেন?
আইয়ুব আল আমিন : শিশুদের বই ব্যতীত আমার কাছে মনে হয় প্রচ্ছদের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ লেখার মান ভালো হলে মানুষ সেটা ফটোকপি করেও পড়ে। আর প্রচ্ছদ দেখেই পাঠক বইটা কিনবে এটি চিন্তা করাটাও বোকামি। তবে সুন্দর একটা প্রচ্ছদ হলে তো বইটা সুন্দর লাগেই।
জাগো নিউজ : প্রচ্ছদ আঁকার ঠিক টান কোথায়?
আইয়ুব আল আমিন : কেউ একজন একটা মানুষের বর্ণনা দিচ্ছে আর আমি সেই বর্ণনা শুনেই ছবি আঁকলাম হুবহু সেই মানুষটার মতই। এটি অনেক রোমাঞ্চকর। আমার কাছে প্রচ্ছদ করাও ঠিক একই রকম মনে হয়। একটা গল্প পড়েই আমি হুবহু সেটির ছবি আঁকব এটি আমার কাছে স্বপ্নের মতো, মধুর স্বপ্ন।
জাগো নিউজ : ভালো লাগে কার প্রচ্ছদ?
আইয়ুব আল আমিন : সবার আঁকা প্রচ্ছদই শিল্প। শিল্প মানেই সৃষ্টি। সবই ভালো লাগে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা মনে ধরত। আর প্রচ্ছদশিল্পী সব্যসাচী হাজরার আঁকা তো অসাধারণ।
এএসএস/এমআরএম/এমএস