গল্প পরিচিতি
জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’: ইতিহাসের অংশ

‘তপুকে আবার ফিরে পাবো, একথা ভুলেও ভাবিনি কোনদিন। তবু সে আবার ফিরে এসেছে আমাদের মাঝে। ভাবতে অবাক লাগে চার বছর আগে যাকে হাইকোর্টের মোড়ে শেষবারের মতো দেখেছিলাম, যাকে জীবনে আর দেখবো বলে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি—সেই তপু ফিরে এসেছে। ও ফিরে আসার পর থেকে আমরা সবাই যেন কেমন একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। রাতে ভালো ঘুম হয় না। যদিও একটু আধটু তন্দ্রা আসে, তবু অন্ধকারে হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়লে গা হাত পা শিউরে ওঠে। ভয়ে জড়সড় হয়ে যাই, লেপের নিচে দেহটা ঠক্ঠক্ করে কাঁপে।’ অংশটুকু বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’ থেকে নেওয়া। গল্পের নায়ক তপুকে ঘিরেই কথাগুলো বলেছেন গল্পকার জহির রায়হান।
বাংলাদেশে জহির রায়হান এক বহুমুখী বিরলতম প্রতিভা। তিনি বাংলাদেশের এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব; যিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে সংগ্রামের চেতনতর সত্তা হিসেবে ছোটগল্প, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রে সদর্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। ভাষা আন্দোলনকে তিনি মনে করতেন সাংস্কৃতিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসনের উৎসার, যার ওপর দাঁড়িয়েই পরবর্তীকালে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলন এবং ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের যাবতীয় সংগ্রামী-ঐতিহ্য, প্রতিবাদী চেতনা এবং মানবিক শর্তহীন মূল্যবোধের জন্ম হয়েছে ভাষার খুন থেকে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে বেশকিছু গল্প রচনা করেছেন। এসব গল্পে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের তথ্যকে যেমন তুলে ধরেছেন; তেমনই ফুটিয়ে তুলেছেন একুশের সম্ভাবনা এবং আবেগকে। পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে একুশের আলোতে ব্যবচ্ছেদ ব্যক্তি বিশ্লেষণ। তবে গল্পের প্যাটার্নে, মিথে, স্বরূপে, বিষয় ভাবনায় রোমান্টিকতা এবং কল্পনার আশ্রয় রয়েছে। কিন্তু তাই বলে কল্পনা সেই শরীর উদ্ভটত্ব বা রুগ্ন রোমান্টিকতায় গড়ে ওঠেনি। এখানেই তাঁর ব্যতিক্রমী অন্বেষা।
জহির রায়হানের বিখ্যাত একটি গল্পের নাম ‘একুশের গল্প’। একটি প্রতীকাশ্রিত গল্প। তীব্র আবেগ গল্পের গতিকে দ্রুত লয়ের দিকে নিয়ে গেলেও সংহত বক্তব্য একে স্পষ্ট পরিণতির দিকে পৌঁছে দেয়। গল্পের বিন্যাসে পরিলক্ষিত হয়: চার বছর আগে হাইকোর্টের মোড়ে মাথায় গুলি অবস্থায় পুলিশ যে তপুকে নিয়ে গিয়েছিল চার বছর পরে একটি মাথার কঙ্কালের খুলিতে ছিদ্র দেখে তপুর বন্ধু রাহাত চিনতে পারে তপুকে। কঙ্কালের মধ্যে তপুকে নতুন করে পাওয়ার কামনা, অনুভব করার আনন্দবোধ এবং তারই পাশাপাশি হৃদয়ের যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ অনন্যতা পেয়েছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
গল্পে তপুকে আবিষ্কারের বর্ণনা ব্যঞ্জনাধর্মী: ‘সেদিন সকালে বিছানায় বসে এনাটমীর পাতা উল্টাছিল সে। তার চৌকির নিচে একটা ঝুড়িতে রাখা ‘স্কেলিটনের স্কালটা’ বের করে দেখছিল আর বইয়ের সাথে মিলিয়ে পড়ছিল সে। তারপর এক সময় রাহাতের হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, রাহাত সাহেব, একটু দেখুন তো ‘স্কালের’ কপালের মাঝখানটায় এতোটা গর্ত কেন?’
গল্পটিতে লেখকের মানসিকতার দ্রুতচারিতা এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনুভব করা গেলেও এই গল্প জহির রায়হানের বহুল প্রচারিত গদ্যকর্মের একটি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যুদ্ধের পর কলকাতার এক সভায় তপুকে আবিষ্কারে প্রভাবিত হয়ে কবিতা পর্যন্ত লিখে ফেলেছিলেন। এ গল্প মর্মস্পর্শী এবং চেতনাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। এখানেই জহির রায়হানের কৃতিত্ব। ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, “বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের কারণেই জহির রায়হানের কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।’
বিজ্ঞাপন
অতি হাস্যোজ্জ্বল একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী তপু। সব সময় আমোদ-ফূর্তিতে থাকতে পছন্দ করতো সে। একবার যদি গল্পের ঝুড়িটা খুলে বসতো, তবে আর কারো রক্ষা নেই; ‘ঠাকুমার ঝুলি’র গল্পও ফুরোয়, কিন্তু তপুর গল্পের কোনো শেষ নেই। তপু বয়সে তার তিন রুমমেটের চেয়ে ছোট হলেও তাদের মধ্যে সে-ই ছিল একমাত্র বিবাহিত। বিধবা মা ও স্ত্রী রেণুকে নিয়ে ছিল তপুর সংসার। খুবই নিয়মানুবর্তী, বিবেকবান ও দুঃসাহসী এই ছেলেটি হলো গল্পের মূল চরিত্র।
তপুর দূরসম্পর্কের আত্মীয়া রেণু, যার সাথে তপু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। দোহারা গড়ন, ছিপছিপে কটি, আপেল রঙের এই মেয়েটির সাথে কলেজে ওঠার কয়েক বছর পরে বিয়ে হয় তপুর। রেণু কখনোই চাইতো না, তপু মিছিলে যাক কিন্তু তপু তার দায়িত্ববোধ ও বিবেকের তাড়নায় স্ত্রীর মন রাখতে পারেনি। সে বিবেচনায় রেণুকে কিছুটা স্বার্থপর ও আবেগী চরিত্র বলা যায়।
তপুর রুমমেট রাহাত একটি প্রতিবাদী চরিত্র। তপুর হারিয়ে যাওয়ার পেছনে রাহাতকে আংশিক দায়ী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তপুকে তার স্ত্রী মিছিলে যেতে বাধা দিলে তপুর সাথে রাহাতও রেণুর আচরণের প্রতিবাদ করে। রাহাত একজন সৎ ও সাদা মনের মানুষ। যে কি না সারাদিন ধরে ঘোরে, তপুর পরিবারকে তার ফিরে আসার খবরটা জানানোর জন্য।
বিজ্ঞাপন
তপুর আরেক রুমমেট সানু। সানু অত্যন্ত বাস্তববাদী একটি চরিত্র। গল্পকার হচ্ছে তপুর তৃতীয় রুমমেট। আর সবার মতো সেও তপুকে খুব মনে করে। তার ফিরে আসায় বেশ বিস্মিত হয়। গল্পের শেষটা অনেক মর্মস্পর্শী। তাই তো দেখা যায়, ‘কথাটা শেষ না হতেই ঝুড়ি থেকে হাড়গুলো তুলে নিলো রাহাত। হাতজোড়া ঠক্ঠক্ করে কাঁপছিলো ওর। একটু পরে উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে বললো, বাঁ পায়ের টিবিয়া ফেবুলাটা দু’ইঞ্চি ছোট। দেখো, দেখো। উত্তেজনায় আমিও কাঁপছিলাম। ক্ষণকাল পরে ‘স্কাল’টা দু’হাতে তুলে ধরে রাহাত বললো, ‘তপু’। বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো ওর।’
এভাবেই একটি সার্থক গল্প আমাদের উপহার দিয়েছেন জহির রায়হান। যা পাঠকের অন্তরে দাগ কেটে যায়। ভাষা আন্দোলনে প্রাণ হারানো তপু আমাদের মাঝে বেঁচে রইলেন গল্পের চরিত্র হয়ে। হয়ে গেলেন ভাষা আন্দোলেনের ইতিহাসের অংশ।
এসইউ/এএসএম
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন