স্কুলে ভর্তি
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চান্স পেয়েও কপাল পুড়ছে হাজারও ‘নাতি-নাতনির’
সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তিতে এবার বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা বাদ দিয়েছে সরকার। শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এ কোটায় ভর্তির সুযোগ পাবেন। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর এসে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্কুলপড়ুয়া সন্তান থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। সেজন্য এ কোটায় ভর্তির জন্য প্রার্থী পাওয়া যাবে না বলে ধারণা ছিল শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের।
তবে লটারির পর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সারাদেশের সব স্কুলে চান্স পাওয়া (মেধাতালিকা) শিক্ষার্থীদের ছড়াছড়ি দেখা গেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একাধিক শিক্ষার্থী নির্বাচিত হয়েছে। এমনকি প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণিতে এ সংখ্যা আরও বেশি। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, কয়েক হাজার শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চান্স পেয়েছে। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সাধারণ কোটায় আবেদন করা অভিভাবকরা।
ভর্তির দায়িত্বে থাকা শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকে ভুল করে বা না জেনে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের এ কোটায় (সন্তান) আবেদন করেছেন। ফলে সফটওয়্যারের মাধ্যমে লটারিতে তাদের নাম চলে এসেছে। কাগজপত্র যাচাইয়ে তারা বাদ পড়বে।
জানা যায়, গত ১২-৩০ নভেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তিতে অনলাইন আবেদন নেওয়া হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর ডিজিটাল লটারি অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিতদের তালিকা পাঠিয়ে দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।
অনেকে ভুল করে বা না জেনে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের এ কোটায় (সন্তান) আবেদন করেছেন। ফলে সফটওয়্যারের মাধ্যমে লটারিতে তাদের নাম চলে এসেছে। কাগজপত্র যাচাইয়ে তারা বাদ পড়বে।
লটারির মেধাতালিকা, প্রথম অপেক্ষমাণ এবং দ্বিতীয় অপেক্ষমাণ তালিকা প্রকাশের পর তাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় এত সংখ্যক শিক্ষার্থীর চান্স পাওয়া নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে অনেকে পোস্ট দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। আবেদন করেও আসন শূন্য না থাকায় চান্স না পাওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা এ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চান্স পাওয়াদের নিয়ে যা জানা গেলো
মুক্তিযোদ্ধা কোটা চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও যেসব স্কুলে চান্স পেয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাগো নিউজ। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অন্তত ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৫ জন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে একজনও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পাওয়া যায়নি। তারা সবাই নিজের সন্তানকে নাতি-নাতনি কোটায় আবেদন করিয়েছেন। অনেকে কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে বিষয়টি জেনেছেন। অনেকে আবার কাগজপত্র জমা দিয়েও এসেছেন।
আরও পড়ুন
- লটারির ফলাফলে এক স্কুলের মেধাতালিকায় তিনবার এক ছাত্রীর নাম!
- স্কুলে ভর্তি চলবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত, সর্বোচ্চ ফি ৮ হাজার টাকা
- পাঠ্যবই পেতেই মার্চ-এপ্রিল, কেমন হবে শিক্ষাপঞ্জি
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী ব্র্যাঞ্চে প্রথম শ্রেণিতে ইংলিশ ভার্সনে সাতজন শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় চান্স পেয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৬ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৯ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ৮ জন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে চারজন, সপ্তম শ্রেণিতে তিনজন, অষ্টম শ্রেণিতে পাঁচজন, নবম শ্রেণিতে একজন মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন ভার্সন ও শাখা মিলিয়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চান্স পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে মোছা. আলিনা তোরাইফা। আলিনার বাবা মো. তৌফিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। গত বছর আমি আমার আরেক সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটায় ভর্তি করেছিলাম। এবারও আবেদনের সময় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় টিক চিহ্ন দিয়েছি। মেয়ে চান্স পেয়েছে। কিন্তু প্রিন্সিপালকে ফোন দিলাম, তিনি বলছেন ভর্তি নেওয়া যাবে না।’
একই স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় নির্বাচিত হয়েছে নাহিয়ান বিন জামান। তার দাদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ সন্তান কোটায় ছেলেকে আবেদন করিয়েছেন নাহিয়ানের বাবা মো. হাদিউজ্জামান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার যে নাতি-নাতনি কোটা বাতিল করেছে, তা তো আমরা জানি না। তারা কোথায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে? যদি আমরা নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে এটা জানতে পারতাম, তাহলে আবেদনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সিলেক্ট করতাম না। এখন যদি ভর্তি না নেওয়া হয়, সেটা উচিত হবে না।’
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুটি ব্র্যাঞ্চের তথ্য অনুযায়ী—সেখানে প্রথম শ্রেণিতে ১২৩ জন এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৪২ জন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় চান্স পেয়েছে। অন্য শ্রেণিতে আরও প্রায় আড়াইশ শিক্ষার্থী চান্স পেয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ে তারা বাদ পড়বে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম।
ভুল করে কেউ নাতি-নাতনি হয়েও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটা আবেদন করে চান্স পেলেও ভর্তির সুযোগ নেই। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ বিধি না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা ব্র্যাঞ্চের প্রভাতী শাখায় প্রথম শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চান্স পাওয়াদের তালিকায় রয়েছে আনজুমান আরা সিথির নাম। তার নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিথির রেজাল্টের পাশে থাকা মোবাইল নম্বরে কল করা হলে রিসিভ করেন তার মা রাহেলা বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা যে বাতিল করা হয়েছে, তা আমরা জানতাম না। চান্স পাওয়ার পর স্কুলে গিয়ে শুনেছি। ভর্তি নেবে না। এখন কিছুই করার নেই।’
শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি স্কুলেও একইভাবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চান্স পাওয়াদের দীর্ঘতালিকা দেখা গেছে। রাজধানীর গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে মোট ৮৭ জন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় ভর্তির জন্য আবেদন করে চান্স পেয়েছে। তাদের প্রত্যেকে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি। ফলে তাদের ভর্তি নেওয়া হবে না। আসন শূন্য থাকলে সেখানে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি করা হবে।
গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আহসান উল্যাহ বলেন, ‘ভুল করে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আবেদন করেছেন। এবার তো ভর্তি নীতিমালায় নাতি-নাতনি কোটার কথা উল্লেখ নেই। ফলে যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান প্রমাণে যথাযথ কাগজপত্র দেখাতে পারবে না, তাদের লটারির নির্বাচন বাতিল করা হবে।’
ঢাকার বাইরের নামি স্কুলগুলোতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীর গভ. ল্যাবরেটরী হাই স্কুলে ৬৩ জন শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় চান্স পেয়েছে। তাদের কেউই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নয়। তারা নাতি-নাতনি। ফলে তাদের ভর্তির সুযোগ নেই বলে জানান স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ড. শাহনাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘আমরা যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেউ হলে তাকে নেবো। তেমন তো কাউকে পাচ্ছি না।’
আরও পড়ুন
- সরকারি স্কুলে মেধাতালিকায় ৯৮২০৫ জন, বেসরকারিতে ২ লাখ ৭ হাজার
- স্কুল থেকে ছাত্ররা কওমি মাদরাসায় চলে যাচ্ছে, এটা ঠেকাতে হবে
- বইয়ের শেষ পাতায় জাতীয় সংগীত-পতাকা, কারণ জানেন না কেউ!
ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। জেলা শহরের এ বিদ্যালয়েও ৯ জন শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চান্স পেয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির দুই শাখায় ৩ জন এবং তৃতীয় শ্রেণির দুই শাখায় ৬ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়েছে। তবে যাচাই শেষে তারা বাদ পড়েছে।
কাগজপত্র যাচাইয়ে যেসব শিক্ষক থাকেন, তারাও অনেক সময় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। ভিকারুননিসা, আইডিয়ালে অনেক সময় একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য ৫-৭ লাখ টাকার কারবারও আমরা দেখেছি। সেজন্য কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘তারা ভুল করে আবেদন করেছে। আমরা যাচাইয়ে তাদের বাদ দিয়েছি।’
বাবা-মা মুক্তিযোদ্ধা ‘প্রমাণপত্র’ না দেখালে ভর্তি নয়
শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ভুল করে কেউ নাতি-নাতনি হয়েও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটা আবেদন করে চান্স পেয়ে গেলেও ভর্তির সুযোগ নেই। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ বিধি না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমিক বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভর্তি নীতিমালায়ও এটা স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ভর্তি কোটা সংরক্ষিত থাকবে। এ নিয়ে দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে সংবাদও প্রচার হয়েছে। তারপরও এতসংখ্যক অভিভাবক না জেনে ভুল করেছে বলে আমি মনে করি না। অনেকে হয়তো ভেবেছে, এটা দিয়ে রাখি, চান্স হয়ে গেলে হয়তো সুযোগ পেয়ে যাবো। কিন্তু আমরা স্পষ্ট করে বলছি, কোনোভাবেই নাতি-নাতনি কোটায় ভর্তির সুযোগ নেই।’
একই কথা বলেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে যা আছে, সেটাই অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
তবে অভিভাবক-শিক্ষক ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রতারকচক্র কৌশলে অনিয়ম করে বিধিবর্হিভূত শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়ে নিতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু। তিনি এ বিষয়ে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কঠোর অবস্থান ও মনিটরিংয়ের আহ্বান জানান।
জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘কাগজপত্র যাচাইয়ে যেসব শিক্ষক থাকেন, তারাও অনেক সময় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। ভিকারুননিসা, আইডিয়ালে অনেক সময় একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য ৫-৭ লাখ টাকার কারবারও আমরা দেখেছি। সেজন্য কঠোর হওয়া প্রয়োজন।’
এএএইচ/কেএসআর/এমএস