ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শিক্ষা

আদালতকে উপেক্ষা করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নেন নওফেল

আবু আজাদ | চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ০৫:০১ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছিল। পদাধিকার বলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। তবে ২০১৯ সালে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আদালতের রায়ের তোয়াক্কা না করে নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নেন।

শুধু তাই নয়, দখল স্থায়ী করতে ট্রাস্টি বোর্ডে যুক্ত করা হয়েছিল শত শত কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদসহ তার পরিবারের তিন সদস্যকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পলাতক আছেন মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ট্রাস্টি বোর্ডের প্রায় সবাই। এ অবস্থায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ফিরে পেতে চায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এর অংশ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে সংস্থাটি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সিটি করপোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় বেদখল হয়ে গেছে, তা আমরা আবার ফেরত চাই। বেআইনি ও অবৈধভাবে জোরপূর্বক দখলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং করপোরেশনের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার অনুমতি চেয়েছি। আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখেছি। মন্ত্রণালয় যেভাবে নির্দেশনা দেবে আমরা সেভাবে কাজ করবো।’

চসিকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়মতান্ত্রিক ও আইনগতভাবে নিজেদের কর্তৃত্বে নেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নেন।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে চসিক দাবি করে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ইস্যুকৃত পত্রটি চ্যালেঞ্জ করে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী হাইকোর্ট বিভাগে রিট (১২৮৯২/২০১৫) করেন। ২০১৬ সালের ১২ জুন রিটটিও খারিজ হয়ে যায়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন চৌধুরী মহামান্য আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন (৩১৪৩/২০১৭) দায়ের করলে আপিল বিভাগ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি সিভিল পিটিশনটিও খারিজ করেন। এভাবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমেও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের হাতেই ন্যস্ত আছে।

প্রিমিয়ার যেভাবে চসিকের হাতছাড়া হয়

২০০০ সালে তৎকালীন চসিক মেয়রের উদ্যোগে নগরের প্রবর্তক মোড়ের হিজড়া খালের নালায় ভবনটি নির্মিত হয়। শুরুতে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ইনস্টিটিউট অব বিজনেস টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০২ সালে এটি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টি করার প্রস্তাব এসেছিল এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ ও জমি দিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। চসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর তিনি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকার বলে। ২০১০ সালের মেয়র নির্বাচনে এম মনজুর আলমের কাছে পরাজয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদও হারান মহিউদ্দিন চৌধুরী। তবে মেয়র মনজুর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় মহিউদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন।

আদালতকে উপেক্ষা করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নেন নওফেলওয়েবসাইটে পাওয়া প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড

২০১৫ সালে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব গড়ায় আদালতেও।

২০১৫ সালের ১৪ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক চিঠি দিয়ে নতুন মেয়র নাছির উদ্দীনকে ট্রাস্টির চেয়ারম্যান হিসেবে সম্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্যানেলসহ ঘাটতি পদগুলো পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে। পাশাপাশি সর্বশেষ ট্রাস্টি বোর্ড নিবন্ধন করা হয়নি জানিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে বলা হয়। এছাড়া একটি চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট (সিএ) প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের হিসাব নিরীক্ষা করতে বলা হয় ওই চিঠিতে।

তবে ইউজিসির চিঠিটি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা রেজিস্ট্রার বরাবর দেওয়া হলো না, এই যুক্তি তুলে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতের রিট পিটিশন দায়ের করেন মহিউদ্দিন।

বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চসিকের সম্পৃক্ততা ও হস্তক্ষেপ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই প্রশ্ন তুলে তিনি হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন।

আদালত রুলের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে মহিউদ্দিনের অংশগ্রহণে কোনো ধরনের বাধা না দেওয়ার নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা হিসেবে মহিউদ্দিন কেন ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করতে পারবেন না, তা জানতে চেয়েও রুল জারি করেছিলেন উচ্চ আদালত।

সিটি করপোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় বেদখল হয়ে গেছে, তা আমরা আবার ফেরত চাই। বেআইনি ও অবৈধভাবে জোরপূর্বক দখলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং করপোরেশনের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার অনুমতি চেয়েছি আমরা। আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখেছি। মন্ত্রণালয় যেভাবে নির্দেশনা দেবে আমরা সেভাবে কাজ করবো।

২০১৬ সালের ১২ জুন দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার চাওয়ার নির্দেশনা দিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পিটিশনটি খারিজ করে দেন উচ্চ আদালত। এ রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ-১৯৮২ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯২-এর কোনোটিতেই সিটি করপোরেশনকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন রিভিউ পিটিশন করেছিল। ২০১৭ সালের মে মাসে রিভিউ পিটিশনের রায়ে উচ্চ আদালত উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ কোনো পক্ষের ওপর প্রযোজ্য হবে না।

এই রুলের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবার লিভ টু আপিল পিটিশন করেন মহিউদ্দিন। কিন্ত শুনানিতে তিনি হাজির না হওয়ায় ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি লিভ টু আপিলটি খারিজ করে দেন আদালত। এরপরও তৎকালীন মেয়র নাছির উদ্দীনকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মহিউদ্দিন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি যেভাবে দখলে নেন নওফেল

২০১৯ সালের নতুন সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহিউদ্দিনের ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। পরে শিক্ষামন্ত্রী হন। এরপর নিজের প্রভাব খাটিয়ে পছন্দমতো ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন। অপরদিকে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব ছাড়তে বাধ্য হন নাছির। একইসঙ্গে চসিক হারায় নিজ অর্থে ও জমিতে প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন নওফেল। এভাবেই বাবার মৃত্যুর পর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নিয়ে নেন নওফেল।

বিশ্ববিদ্যালয়টি পারিবারিক ও রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার প্রভাবের কারণে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ ও পদায়নের ক্ষেত্রে ইউজিসি মতামত নেওয়া হতো না। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এককভাবে নওফেলের সিদ্ধান্তেই চলত বিশ্ববিদ্যালয়টি।

আদালতকে উপেক্ষা করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নেন নওফেলবিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

এ বিষয়ে চসিকের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চসিকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়মতান্ত্রিক ও আইনগতভাবে নিজেদের কর্তৃত্বে নেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নিজেই ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নেন।’

প্রায় ১৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য পদে আছেন অধ্যাপক অনুপম সেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ৭৫ বছর বয়সের পর উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের সুযোগ না থাকলেও ৮৪ বছর বয়সেও উপাচার্য পদে আছেন তিনি।

ইউজিসির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পরও নওফেল ট্রাস্টি চেয়ারম্যানের পদ না ছাড়ায় স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছিল। একইসঙ্গে তিনি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছিলেন। এ কারণে জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদপ্রাপ্তির জন্য নিষ্কণ্টক, দায়মুক্ত ও অখণ্ড জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা চসিকের জমি নিষ্কণ্টক ও দায়মুক্ত ছিল না। খণ্ড খণ্ড ক্যাম্পাস ছিল। এরপরও ২০২১ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে স্থায়ী সনদ দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।

এ বিষয়ে জানার জন্য প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং উপাচার্য অধ্যাপক অনুপম সেনের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

এএজেড/এসএইচএস/এএসএম