ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শিক্ষা

কোটা বণ্টনে সংস্কার জরুরি, সমাধানের সূত্র সরকারের হাতেই

আল-আমিন হাসান আদিব | প্রকাশিত: ০৯:৪৭ পিএম, ০৭ জুলাই ২০২৪

সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা বণ্টন পদ্ধতি নিয়ে ফের অসন্তোষ বেড়েছে। এ পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে সাড়ে পাঁচ বছর পর আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিনই অবস্থান নিয়ে দাবি-দাওয়া জানাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ‘সাড়া’ নেই। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বলে ‘দায় এড়িয়ে’ যাচ্ছেন সরকারের মন্ত্রী-সচিবরা। সবশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের ‘যৌক্তিকতা’ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

তবে শিক্ষাবিদ ও সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা সাবেক আমলারা শিক্ষার্থীদের চলমান এ আন্দোলন ‘যৌক্তিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তারা সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সংকট নিরসনের তাগিদও দিয়েছেন। পাশাপাশি কোটা পুরোপুরি বাতিল না করে ‘যৌক্তিক সংস্কার’ করার পক্ষে মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।

কোটা রাখার যৌক্তিকতা একটা সময় পর্যন্ত ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কেউ কোটার সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো, তারপর তার পরিবার বা গোষ্ঠী থেকে কাউকে আবারও কোটা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অমূলক। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক।- ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আরেফিন সিদ্দিক

এবারের আন্দোলন কতটা যৌক্তিক

২০১৮ সালে কোটা বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন। তারা সেই আন্দোলন যৌক্তিক ছিল বলে অভিমত জানিয়েছিলেন। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে তা স্পষ্ট করে।

দীর্ঘদিন পর উচ্চ আদালত সরকারের সেই প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে কোটা বহালের নির্দেশনা দিয়েছে। বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। এর মধ্যেই আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা। কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা এবারের আন্দোলনও যৌক্তিক বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এমনকি সাবেক আমলারাও কোটা বণ্টনে সংস্কার চেয়েছেন।

আরও পড়ুন

 

দুই মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। শিক্ষার্থীদের এবারের আন্দোলন আরও বেশি যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরির জন্য পড়াশোনা করা যেসব গ্র্যাজুয়েট আজ কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছেন, তাদের এ আন্দোলনের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। তারা তো অতিমাত্রায় কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাদের এ অবস্থান নয় বলে আমি মনে করি।- ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘কোটা রাখার যৌক্তিকতা একটা সময় পর্যন্ত ছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কেউ কোটার সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো, তারপর তার পরিবার বা গোষ্ঠী থেকে কাউকে আবারও কোটা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অমূলক। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক।’

jagonews24

ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এ কে আজাদ চৌধুরীও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ‘অত্যন্ত যৌক্তিক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরির জন্য পড়াশোনা করা যেসব গ্র্যাজুয়েট আজ কোটা সংস্কারের আন্দোলন করছেন, তাদের এ আন্দোলনের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। তারা তো অতিমাত্রায় কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাদের এ অবস্থান নয় বলে আমি মনে করি।’

স্থানীর সরকার বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। তিনি ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলন খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এবারও শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের দাবি এবং আন্দোলনের গতিবিধিতে নজর রাখছেন বলে জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন

আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, ‘সরকার তখন (২০১৮ সালে) টেকসই ব্যবস্থা না নেওয়ায় আবারও একই দাবিতে একই ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এবার আন্দোলনের শেষ পরিণতি কী হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। যতদূর মনে পড়ে—২০১৮ সালে আন্দোলনকারীরা কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিলেন। সরকার হুট করে পুরোটা বাতিল করে দিলো। সেটার রেশ থেকেই এবারের আন্দোলন। গতবরের মতো এবারের আন্দোলন নিয়েও বিভিন্ন পক্ষ শিক্ষার্থীদের দাবি যৌক্তিক বলছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তাদের কিছু দাবিকে যৌক্তিক মনে করি।’

সমাধান কোন পথে

২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল স্পষ্টত সরকারের কাছে। এবার বিষয়টি ভিন্ন। সরকারের নির্দেশনা উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছেন। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে চলমান এ আইনি লড়াইয়ের মাঝে আন্দোলনে অস্থিতিশীল দেশ। এমন প্রেক্ষাপটে সমাধান কোন পথে হতে পারে, তা নিয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা।

বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা দেওয়ার প্রয়োজন কতটুকু, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন নিয়েও আলোচনা হতে পারে। জাতীয় সংসদেও এটা আলোচনা হতে পারে। সরকার চাইলে সমাধানের অনেক সূত্র আছে।- সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান

অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘গতবারের চেয়ে এবারের বিষয়টি ভিন্ন। সরকার তো কোটা বাতিল করেছিল। এখন আদালত সেটা অবৈধ বলছেন। স্বাভাবিকভাবে সরকার এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলবে না। আমার ধারণা—সরকার এটা (কোটা সংস্কার) নিয়ে হয়তো জোর পায়ে এগোবেও না। সেক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমেই সমাধানে আসতে হবে।’

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক অবশ্য ভিন্নমত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একটি রাষ্ট্রে নানান ধরনের সমস্যা, সংকট আসবেই। আদালতে বিষয়টি বিচারাধীন ঠিক আছে। তবুও সরকারের এখানে কিছু করার আছে। আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যারই সমাধান করা যায়। প্রয়োজন সদিচ্ছার। আমি মনে করি—সংকট নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসলে একটা সমাধান আসবেই।’

jagonews24

আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান বলেন, ‘বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা দেওয়ার প্রয়োজন কতটুকু, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সমস্যা সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সেখানে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন নিয়েও আলোচনা হতে পারে। জাতীয় সংসদেও এটা আলোচনা হতে পারে। সরকার চাইলে সমাধানের অনেক সূত্র আছে।’

কত শতাংশ কোটা থাকা উচিত

২০১৮ সালে যখন কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়, তখন দেখা যায় বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২৫৮ ধরনের কোটা রয়েছে। তবে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি কোটা’, ‘পোষ্য কোটা’, ‘নারী কোটা’, ‘জেলাভিত্তিক কোটা’ নিয়ে বেশি আপত্তি। সবমিলিয়ে সরকারি চাকরির ৫৬ শতাংশ কোটার দখলে। বাকি ৪৪ শতাংশেও বিভিন্ন সময়ে ‘তদবির বাণিজ্যে’ মেধাবীরা সুযোগ পান না। সেক্ষেত্রে কত শতাংশ কোটা রাখা সহনীয়, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে। এমনকি এ নিয়ে নীতিমালা করাটাও জরুরি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ ও সাবেক আমলারা।

আরও পড়ুন

ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর মতে, ‘সবমিলিয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে।’ এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীরা এখন অনেক এগিয়েছেন। তাদের জন্য ব্যাপক হারে কোটা রাখার প্রয়োজন নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিরা অনেক বছর চাকরিতে কোটা সুবিধা পেয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রেও যৌক্তিক সংস্কার প্রয়োজন। অনগ্রসর জাতি বা গোষ্ঠীকে সমতায় আনাটা যেহেতু রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব, সেক্ষেত্রে কোটার কিছুটা প্রয়োজন আছে। সেজন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারী এবং শ্রদ্ধাবোধ রেখে কয়েক শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা যায়। তবে সেটি কোনোভাবেই ৫৬ শতাংশ নয়। সবমিলিয়ে ৫-১০ শতাংশ কোটা থাকতে পারে।’

সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বণ্টনে স্বতন্ত্র নীতিমালা করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে কোটা পদ্ধতি চালু আছে। সেটি ১০ শতাংশের বেশি নয়। বাংলাদেশেও আদিবাসী ও নারী কোটা রাখা যেতে পারে। আলাপ-আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করা দরকার। নীতিমালায় কতবার কোটা সুবিধা পাওয়া যাবে, সেই বিষয়ও রাখা উচিত। কেউ একবার কোটা সুবিধা পেলে, তিনি আর পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠী নন। এছাড়া এ পর্যন্ত কতজন কোটা সুবিধার আওতায় এসেছেন, সে বিষয়েও গবেষণা দরকার।’

এএএইচ/ইএ/জিকেএস