ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শিক্ষা

শিক্ষায় বাজেট

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা

আল-আমিন হাসান আদিব | প্রকাশিত: ০৮:১১ পিএম, ১০ জুন ২০২৪

প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ নিয়ে ঘুরেফিরে এবারও সেই পুরোনো হতাশা। টাকার অংকে এ খাতে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে আরও কমেছে। অথচ শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চ্যালেঞ্জিং এ রূপান্তরের পথ সাবলীলভাবে পাড়ি দিতে প্রয়োজন শিক্ষাখাতে পরিকল্পিত বরাদ্দ, যার ছিঁটে-ফোঁটাও দেখা যায়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা আছে।

গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। এতে শিক্ষাখাতে ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে শিক্ষাখাতে যে বাজেট ছিল, তার চেয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এবার। টাকার অংকে শিক্ষায় এবার প্রস্তাবিত বাজেট বেড়েছে ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে শিক্ষার বাজেট উল্টোমুখী। অথচ যে বছর থেকে জিডিপি অনুপাতে বাজেট কমানো শুরু করেছে সরকার, সেই বছরই নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষায় বাজেট বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। বাস্তবে ঘটছে তার উল্টো। আমরা যেতে চাইছি উন্নত বিশ্বের দিকে, অথচ শিক্ষায় বাজেটের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশের কাতারেও দাঁড়াতে পারছি না। এটা কাঙ্ক্ষিত নয়।

শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে বাজেটে ‘কিছুই নেই’
বর্তমানে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ বাস্তবায়ন করছে সরকার। এতে শিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি (২০২৪) শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত ক্লাসরুম, অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপকরণ নিশ্চিতে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো নির্দেশনা নেই বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাসরুমে নতুন শিক্ষাক্রমের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এখন ক্লাসরুমের ডিজাইনের পরিবর্তনের সময় এসেছে।- অধ্যাপক ড. তারিক আহসান

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের যত ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার, তার প্রতিফলন বাজেটে দেখিনি। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়ে তারা নতুন কারিকুলামে সেটা লেখাপড়ায় ব্যবহার করছেন কি না, এগুলো মনিটরিংয়ে আমাদের পুরোপুরি দুর্বলতা আছে। সে দুর্বলতা দূর করতেও কোনো দিকনির্দেশনা দেখছি না। ইতিবাচক একটা রূপান্তরের দিকে আমরা যাচ্ছি, অথচ শিক্ষা গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর কোনো নমুনাও বাজেটে নেই।’

নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তারিক আহসান। তিনিও একই অভিমত জানান। অধ্যাপক তারিক বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাসরুমে নতুন শিক্ষাক্রমের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এখন ক্লাসরুমের ডিজাইনের পরিবর্তনের সময় এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যাপকভাবে শিক্ষার্থীদের দলীয় কাজ করার ব্যাপার রয়েছে। সেটা নিশ্চিত করতে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিটি নিশ্চিত করতে হবে। পুরো সিস্টেমটাই ডিজিটাল হওয়া প্রয়োজন। আমরা মনে করি, শিক্ষার বাজেট নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে আশানুরূপ নয়। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এটি মেগা প্রকল্পের দিকে নিতে হবে। অথচ তার উল্টোচিত্র বাজেটে ফুটে উঠেছে।’

শিক্ষার বাজেট নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ। প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাখাতে যে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গতানুগতিক। নতুন শিক্ষাক্রম যে বাস্তবায়নের পথে, তা সরকার যেন বেমালুম ভুলে গেছে। ফলে শিক্ষার বাজেট একই বৃত্তে ঘুরছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা-৪ পূরণ অর্থাৎ গুণগত শিক্ষার দক্ষতা উন্নয়নের জন্য এ বাজেট যথেষ্ট নয়।’

খরচের চাপ বাড়বে অভিভাবকের
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বলপয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপ করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে তা প্রত্যাহারের দাবি ছিল শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাখাত সংশ্লিষ্টদের। তাতে কর্ণপাত করেনি সরকার। এতে এবার শিক্ষার অতি প্রয়োজনীয় এ উপকরণের দামও বাড়বে। ফলে বাড়তি খরচের বোঝা কাঁধে চাপবে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের। পাশাপাশি কাগজ ও সাপ্লিমেন্টারি বইয়ের ওপরও করারোপ থাকায় খরচ বাড়বে।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের যত ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার, তার প্রতিফলন বাজেটে দেখিনি। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেয়ে নতুন কারিকুলামে সেটা লেখাপড়ায় ব্যবহার করছেন কি না- এগুলো মনিটরিংয়ে আমাদের পুরোপুরি দুর্বলতা আছে।-রাশেদা কে চৌধুরী

সিপিডি বলছে, বিভিন্ন জরিপের তথ্যানুযায়ী—বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াতে চায়। অথচ সেখানে টিউশন ফির ওপর ৫ শতাংশ কর দিতে হবে। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফির ওপরও করারোপ বহাল রয়েছে। ফলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের খরচের বোঝা বাড়বে।

শিক্ষা উপকরণের দাম আরও বাড়বে—এ নিয়ে একমত গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘খাতা-কলমের দাম তো বাড়ছেই। এটা আরও বাড়বে—তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ দিকটায় সরকার বাজেটে তেমন নজরই দেয়নি।’

তবে বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিড ডে মিলের পরিধি বাড়ানো হয়েছে, প্রতিবন্ধীদের জন্য ভাতা বাড়বে, উপবৃত্তির পরিধিও বাড়ানোর মতো ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে শিক্ষা উপকরণের দাম যেভাবে বেড়েছে, তা বিবেচনায় নিয়ে আমরা বৃত্তিতে টাকার পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছিলাম। কিন্তু বাজেটে সেই নমুনা দেখছি না।’

এএএইচ/এএসএ/জেআইএম