ভিকারুননিসা স্কুল
নৈপুণ্য অ্যাপের ‘মারপ্যাঁচে’ আটকা সাড়ে ৫ হাজার ছাত্রীর ফল
নতুন শিক্ষাক্রমে বার্ষিক পরীক্ষা নেই। এবার স্কুলগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সামষ্টিক মূল্যায়ন। সব স্কুলে নভেম্বরে এ মূল্যায়ন শেষ হয়। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে রিপোর্ট কার্ড দেওয়ার নির্দেশনা ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)। রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ স্কুল সময়মতো তা করতে পারলেও ব্যর্থ হয়েছে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। মূল্যায়নের দুই মাসের বেশি সময় পার হলেও এখনো ষষ্ঠ-সপ্তমের রিপোর্ট কার্ড পায়নি শিক্ষার্থীরা। নতুন শিক্ষাবর্ষে পরবর্তী শ্রেণির বই হাতে ক্লাসে বসলেও আগের বছরের ফল জানে না স্কুলটির সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি ছাত্রী।
শিক্ষকরা বলছেন, নৈপুণ্য অ্যাপে তথ্য ইনপুট দিতে অনেক শিক্ষক দেরি করেছেন। অ্যাপ ব্যবহারও বুঝে উঠতেও হিমশিম অনেকে। টেকনিক্যাল সমস্যার মুখেও পড়তে হয়েছে তাদের। সব মিলিয়ে এখনো রিপোর্ট কার্ড শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের হাতে দিতে পারেননি তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতের নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি শাখা রয়েছে। চার শাখায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে পাঁচ হাজারেরও কিছু বেশি। তারা এ বছর নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়েছে। বছরের শেষে নভেম্বরে বার্ষিক সামষ্টিক মূল্যায়নে অংশ নেয় তারা। একই সময়ে অন্য শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা হয়। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রকাশ করা হলেও নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ-সপ্তমের মূল্যায়নের ফল বা রিপোর্ট কার্ড এখনো দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে ১ জানুয়ারি নতুন শ্রেণির বই পেয়েছে তারা। এরপর ক্লাসও করছে ছাত্রীরা। অথচ তাদের আগের ক্লাসের ফলাফল এখানো জানা হয়নি। সন্তানের পড়ালেখার অগ্রগতি কী, তাও জানতে পারেননি অভিভাবকরা।
আরও পড়ুন>> পরীক্ষামূলক বই পড়ছে শিক্ষার্থীরা, উপযোগিতা যাচাই অক্টোবরে
স্কুলের কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। মন খারাপ ছাত্রীদের। ভিকারুননিসার মূল শাখার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সপ্তমে ওঠা এক ছাত্রীর মা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘সব স্কুল করে ফেললো, অথচ ভিকারুননিসার শিক্ষকরা পারেন না। এটা কেমন কথা? অন্যরা রিপোর্ট কার্ড দিয়েছে সেই ডিসেম্বরের ২০-২৫ তারিখে। জানুয়ারির ২৯ তারিখ। এখনো ভিকারুননিসা থেকে আমার মেয়ে মূল্যায়নের ফল কী তা জানাতে পারেনি। এতে বোঝা যাচ্ছে ভিকারুননিসার পড়ালেখা ও শিক্ষকদের কী করুণ দশা। তারা নতুন কারিকুলাম পড়াতে পারবেন কি না, তা নিয়েও তো এখন সন্দেহ হচ্ছে।’
দেরি হওয়াটা দুঃখজনক। আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। শিক্ষার্থী বেশি, নতুন পদ্ধতি- সব মিলিয়ে কিছুটা দেরি হয়েছে। দ্রুত সবাই মূল্যায়নের রিপোর্ট কার্ড পেয়ে যাবে।- কেকা রায় চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ)
মেয়ের মূল্যায়নের ফল না পেয়ে হতাশ ভিকারুননিসার অভিভাবক তাহেরা আক্তার রুপা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও দিয়েছেন তিনি। সেখানে লিখেছেন, ‘ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে মেয়ে। আজও জানতে পারলাম না আমার সন্তানের পড়াশোনার অগ্রগতি কী? ফলাফল ছাড়াই মেয়ে ওপরের ক্লাসে উন্নীত। কোথায় আছি আমরা?’
আরও পড়ুন>> নবম শ্রেণিতে নেই বিজ্ঞান-বাণিজ্য-মানবিক, সবাই পড়ছে একই বিষয়
জানতে চাইলে তাহেরা আক্তার রুপা বলেন, ‘রিপোর্ট কার্ড পাইনি। মেয়েকে জিজ্ঞাস করলেও স্যাররা কিছুই জানায়নি বলে। মূল্যায়নের জন্য ফি নেওয়া হয়েছে, রিপোর্ট কার্ড ছাপার ফিও তার মধ্যে রয়েছে। অথচ স্কুল থেকে কিছুই জানাচ্ছে না। ফল ছাড়াই ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে মেয়ে ক্লাস করছে। সব মিলিয়ে আমরা হতাশ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
বেইলি রোডের মূল শাখার দুজন ছাত্রীর অভিভাবক ছাড়াও ভিকারুননিসার বসুন্ধরা, ধানমন্ডি, আজিমপুর শাখার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য জানা যায়। ফল না পাওয়ায় সন্তানদের মন খারাপ বলেও জানান তারা। এ নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। একই সঙ্গে দ্রুত মূল্যায়নের রিপোর্ট কার্ড দেওয়ার দাবি জানান তারা।
স্কুলের মূল শাখা ও বসুন্ধরা শাখার কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে জানান, নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর ভিকারুননিসার শিক্ষকরা চাপে পড়ে গেছেন। সেখানে অধিকাংশই বয়স্ক শিক্ষক। দীর্ঘদিন তারা একই ধাঁচে ক্লাসে পাঠদান করাচ্ছেন। নতুন শিক্ষাক্রমে তাদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। বেশি শিক্ষার্থী, নতুন শিক্ষাক্রম এবং তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান কম থাকায় বয়স্ক শিক্ষকরা ঠিক সময়ে মূল্যায়নের তথ্য ইনপুট করতে পারেননি। তুলনামূলক তরুণ শিক্ষকরা আগেই কাজ শেষ করেছেন। বয়স্ক শিক্ষকরা নৈপুণ্য অ্যাপের মারপ্যাঁচে পড়ায় এতসংখ্যক শিক্ষার্থীদের ফল ঝুলে গেছে।
আরও পড়ুন>> নতুন শিক্ষাক্রমে মাদরাসার বই রূপান্তরে ‘জুজুর ভয়’
জানতে চাইলে ভিকারুননিসা স্কুলের বসুন্ধরা দিবা শাখার ষষ্ঠ শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক বাবুল কুমার কর্মকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন পদ্ধতি বুঝে নিতে আমাদের একটু সময় লেগেছে। নতুন যে অ্যাপটা, নাম নৈপুণ্য ওখানে তথ্য দিতেও দেরি হয়েছে। আমাদের এখানে শিক্ষার্থীও বেশি। সবমিলিয়ে ঝামেলাটা হয়েছে।’
নৈপুণ্য অ্যাপে কিছু ত্রুটি ছিল। সেগুলো দ্রুত সেসময় সমাধান করা হয়েছে। সময়ে সময়ে আপডেট হয়েছে। এতে কারও রিপোর্ট কার্ড তৈরি ও ডাউনলোড আটকে থাকার কথা নয়। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই সব স্কুলকে রিপোর্ট কার্ড শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে ডেকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে সেটা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন
তিনি বলেন, ‘যতদূর জানি, আগামী সপ্তাহে রিপোর্ট কার্ড দেওয়া হতে পারে। সব শিক্ষক তথ্য ইনপুট দিয়েছেন। এখন এটা আইসিটি শাখা থেকে প্রিন্ট করার কথা। সেটা হলেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া যাবে।’
সপ্তম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক বিষ্ণু পদ বাড়ৈ বলেন, ‘এখনো দেওয়া হয়নি এটুকুই বলতে পারবো। এর বেশি আমি কিছু বলবো না। কেন দেওয়া হয়নি, কবে দেওয়া হবে সেটা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন।’
বসুন্ধরা শাখার শাখাপ্রধান জগদীশ চন্দ্র পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘অ্যাপে তথ্য দিতে সমস্যা হয়েছে। নতুন সিস্টেমে সবাই মানিয়ে নিতে সময় লেগেছে। টেকনিক্যাল ত্রুটিও বলতে পারেন। এখন সব কাজ শেষ। রিপোর্ট কার্ডগুলো প্রিন্ট দেওয়ার কাজ চলমান। আগামী সপ্তাহে অথবা স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে রিপোর্ট কার্ড তুলে দেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে ভিকারুননিসা স্কুলের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) কেকা রায় চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেরি হওয়াটা দুঃখজনক। আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। শিক্ষার্থী বেশি, নতুন পদ্ধতি- সবমিলিয়ে কিছুটা দেরি হয়েছে। দ্রুত সবাই মূল্যায়নের রিপোর্ট কার্ড পেয়ে যাবে।’
মাউশির মাধ্যমিক শাখার পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নৈপুণ্য অ্যাপে কিছু ত্রুটি ছিল। সেগুলো দ্রুতই সেসময় সমাধান করা হয়েছে। সময়ে সময়ে আপডেট হয়েছে। এতে কারও রিপোর্ট কার্ড তৈরি ও ডাউনলোড আটকে থাকার কথা নয়। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই সব স্কুলকে রিপোর্ট কার্ড শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে ডেকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে সেটা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এএএইচ/এএসএ/জেআইএম