ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শিক্ষা

‘শিক্ষা ক্যাডার আমলারা পরিচালনা করায় এ সংকট’

মো. নাহিদ হাসান | প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ১১ অক্টোবর ২০২৩

ক্যাডার বৈষম্যসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ডাকে প্রাথমিকভাবে মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) থেকে দেশের সব সরকারি কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, আলিয়া মাদরাসা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), শিক্ষা বোর্ডসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ কর্মবিরতি পালন করা হচ্ছে৷ কেন শিক্ষকরা এই কর্মবিরতিতে? এর যৌক্তিকতা কতটুকু? এসব নিয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর মো. শাহেদুল খবির চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. নাহিদ হাসান ৷

কথার শুরুতেই প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, অতীতেও আমরা বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েছি। তবে এবারের প্রসঙ্গটি একটু ভিন্ন ৷ আমরা আসলে বাধ্য হয়েছি। প্রথমত আমাদের দেশে সিভিল সার্ভিস রয়েছে এবং সিভিল সার্ভিসে ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে৷ ক্যাডার সার্ভিসের অন্যতম একটি ক্যাডার হলো বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার৷ এটি সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন সময় নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে৷ সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের এ সার্ভিসটি ধাপে ধাপে বিলুপ্ত করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ মনে হয়েছে আমাদের অস্তিত্ব এবার বিপন্ন হচ্ছে৷ কর্মবিরতিতে যাওয়া ছাড়া সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।

আরও পড়ুন: ৩ দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের

তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য আছে। যেগুলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে তার সঙ্গে, এমনকি সংবিধানেরও পরিপন্থি৷ সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তাদের যোগ্যতা এবং দক্ষতা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হবেন এবং ক্যাডার সার্ভিসের প্রত্যেক ক্যাডারের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি আমাদের শিক্ষা ক্যাডারের সঙ্গে অন্য ক্যাডারের দীর্ঘদিনের বৈষম্য বিরাজ করছে৷ এ বৈষম্য দূর করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। অথচ বৈষম্য দূর না হয়ে উল্টো দিন দিন বাড়ছে৷ আমাদের কাছে মনে হয়েছে প্রশাসন যন্ত্রের মধ্যে দেশবিরোধী চক্র রয়ে গেছে৷ পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে পরাজিত পাকিস্তানি প্রশাসনের হাত ছিল৷ আমাদের কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের চলমান অগ্রগতি ব্যাহত করতেই ক্যাডার সার্ভিসে এ বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। পেশাজীবীদের মধ্যে বৈষম্য থাকলে তারা নিজ নিজ পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মেধাবীরা পেশার প্রতি আগ্রহ হারালে সর্বোপরি রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷

তিনি আরও বলেন, আমাদের পেশায় যারা নতুন আসেন তারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই আসেন৷ এসে যখন দেখেন এই সার্ভিসটা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার তখন তারা এখান থেকে চলে যান। এতে আল্টিমেটলি ক্ষতিটা শিক্ষারই হয়৷ আমাদের কাছে মনে হয়েছে আমরা সাংবিধানিক মর্যাদা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি৷ এজন্য পূর্ণশক্তি দিয়ে কাজ করার তাগিদ অনুভব করেছি। এরই অংশ হিসেবে সমিতির পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে।

‘২০১৫ সালে হওয়া পে-স্কেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ক্যাডার৷ প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানোর পরে দুটি কমিটি করেছিলেন। কমিটিগুলোর কাজ ছিল ক্যাডারদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা। তবে কমিটিগুলোর করা সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি৷ ফলে আমাদের শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা চতুর্থ গ্রেডে থেকে যাচ্ছেন৷ যেখানে অন্য ক্যাডারগুলোয় তৃতীয়, দ্বিতীয় এবং প্রথম গ্রেডের পদ সৃজন হচ্ছে৷ এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রে যারা ঘাপটি মেরে বসে আছেন তারাই ক্যাডার সার্ভিসে বৈষম্য জিইয়ে রাখছেন। যে বৈষম্যের শিকার শিক্ষা ক্যাডার।’

আরও পড়ুন: শিক্ষা ক্যাডারে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে কর্মবিরতি

এ শিক্ষক নেতার ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রী বলছেন ক্যাডার সার্ভিসে বৈষম্য দূর করতে অথচ বৈষম্য বাড়ানো হচ্ছে৷ অন্য ক্যাডারের পদোন্নতি নিয়মিত অথচ আমাদের ক্যাডারের অনেকেই সহযোগী অধ্যাপক হয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন৷ অধ্যাপক পর্যন্ত হতে পারছেন না৷ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা চরম প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সবস্তরে শিক্ষক ঘাটতি রয়েছে। সুপরিকল্পিতভাবে এটা করা হচ্ছে৷ শিক্ষক ঘাটতি হলে কী হবে, শিক্ষার মান হ্রাস পাবে। শিক্ষার মান হ্রাস পেলে কী হবে, বাংলাদেশের অগ্রগতি ও লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হবে৷

প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান দৈন্যতার কারণ ‘ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি অস্বাভাবিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এটা আমলারা পরিচালনা করায় এ অবস্থা হচ্ছে৷ প্রাথমিকের সঙ্গে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকে খণ্ড-বিখণ্ড করায় বিচ্ছিন্নভাবে সিদ্ধান্ত আসছে৷ এতে সংকট তৈরি হচ্ছে। এ জায়গাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা ক্যাডারকে নেতৃত্ব দিতে হবে ৷ এ বিষয়গুলো শিক্ষা ক্যাডারই পরিচালনা করবে৷ আর সেজন্যই আমাদের অবস্থান।

প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর যে দেশই শিক্ষায় অগ্রসর হয়েছে সে দেশেই দেখা যাবে শিক্ষাবিদরা শিক্ষা প্রশাসন চালিয়েছেন৷ একমাত্র বাংলাদেশেই মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ও পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রে ঘাপটি মেরে থেকে ক্যাডার সার্ভিস তথা গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করছে। সেই প্রশাসন যন্ত্রই একসময় সামরিক শাসকদের সঙ্গে মিলেছে, কখনোবা ডেমোক্রেটিক প্রসেসে থেকে তারা ভেতরে ভেতরে নানা কাজ করছে৷ তাদের এসব ভূমিকা আসলে রাষ্ট্র তথা স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকেই বাধাগ্রস্ত করছে৷

আরও পড়ুন: সারাদেশে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি শুরু

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্মবিরতির কর্মসূচি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এখন এটি আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন, আমাদের মর্যাদার প্রশ্ন৷ রাষ্ট্রে শিক্ষার মানোন্নয়নের যে অন্তরায় আমরা দেখছি, তাতে এ সার্ভিসে নবীন সহকর্মীরা হতাশ। তারা এ সার্ভিস ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন৷ শিক্ষা ক্যাডারে অনেকের ৮-১০ বছর, এমনকি ১২ বছরেও কোনো পদোন্নতি হচ্ছে না ৷ ১৫, ১৮ বা ২০ বছরেও তারা দ্বিতীয় পদোন্নতি পাচ্ছেন না ৷ পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত হয়ে তারা এ ক্যাডার ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

শিক্ষা ক্যাডারে পদসৃজন না করা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা প্রশাসনের ব্যর্থতা উল্লেখ করে এর দায় শিক্ষা ক্যাডার নেবে না বলেও জানান প্রফেসর শাহেদুল খবির চৌধুরী৷

তিনি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে আমাদের মনে হয়েছে পুরো শিক্ষাকেই বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে৷ এজন্য আমরা এর আগে একদিনের কর্মবিরতি করেছি৷ যেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছে৷ মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) থেকে তিনদিনের কর্মবিরতি রয়েছে। কেউ কোথাও কাজ করবেন না৷ যে যেখানে থাকেন না কেন, কলেজ, অফিস বা বোর্ড- তারা কোন কাজ করবেন না৷ আমরা একটু দেখাতে চাই এবং আমাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চাই৷ আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো শিক্ষার মানোন্নয়নের স্বার্থে। এখানে কোনো বাড়াবাড়ি নেই।

সবশেষ এ শিক্ষক নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যদি শিক্ষা ক্যাডারের মাধ্যমে শিক্ষা প্রশাসন পরিচালিত না হয় তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে। আমরা আমাদের দাবিতে অটল৷

আরও পড়ুন: পদোন্নতি দাবিতে শিক্ষা ভবনে অবস্থানের ঘোষণা শিক্ষা ক্যাডারদের

এদিকে পদোন্নতি, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনসহ বিভিন্ন দাবিতে আবারও তিনদিনের সর্বাত্মক কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) থেকে এ কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা, যা চলবে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত।

গত সোমবার (৯ অক্টোবর) বিসিএস সাধারণ শিক্ষ সমিতির সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী ও মহাসচিব শওকত হোসেন মোল্যার সই করা বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কর্মবিরতি চলাকালে দেশের সব সরকারি কলেজ, সরকারি আলিয়া মাদরাসা, সরকারি টিটি কলেজ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, সব শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), নায়েম, ব্যানবেইসসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর ও অধিদপ্তরে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা ক্লাস-পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের কাজ বন্ধ রাখবেন।

আরও পড়ুন: সরকারি কলেজ-মাদরাসায় ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ, অচল অধিদপ্তর-সংস্থাও

এমএনএইচ/এমকেআর/এএসএম