ভিডিও EN
  1. Home/
  2. শিক্ষা

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থামছে না বুলিং, ‘শিকেয় তোলা’ নীতিমালা

আল-আমিন হাসান আদিব | প্রকাশিত: ০৮:৩২ এএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

গায়ের রং কালো। বয়সের তুলনায় শরীরের ওজনও কিছুটা কম। পাতলা গড়নের হাস্যোজ্জ্বল কিশোরী ঈষিতা (ছদ্মনাম)। বয়স ১৪ বছরের কাছাকাছি। রাজধানীর সুপরিচিত একটি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সে। বান্ধবীরা কখনো তাকে ডাকে ‘কাল্টু’, কখনো ‘শুঁটকি’, যা নিয়ে দীর্ঘদিন মনোকষ্টে ভুগছিল ঈষিতা। বেশ কিছুদিন ঈষিতা দীর্ঘসময় নিয়ে গোসল করে, যা নজরে আসে তার মায়ের। মেয়ের কাছে খুব কৌশলে কারণ জানতে চান ওই ছাত্রীর স্নাতক পাস মা। কথাবার্তার একপর্যায়ে ঈষিতা বলে- ‘আম্মু, আমি কি এর চেয়ে আর ফর্সা হবো না?’ পরক্ষণে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। স্কুলে ঠাট্টাচ্ছলে বান্ধবী-সহপাঠীদের বুলিংয়ের সব ঘটনা খুলে বলে মাকে।

ঘটনা শুনে ঈষিতার মা সিদ্ধান্ত নেন- ওই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানাবেন। তবে শিক্ষকরা পরামর্শ দেন- মৌখিকভাবে বলার জন্য। অধ্যক্ষ আশ্বাস দেন বুলিং বন্ধের। তাতে অবশ্য কাজও হয়েছে। পাতলা গড়নের ঈষিতাকে কেউ আর উপহাস বা বাজে নামে ডাকে না।

ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা (নাম-পরিচয় অপ্রকাশিত রাখা হলো) গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেয়েটা আমাকে আগে দু-একবার বলেছে যে, ওর বান্ধবীরা বাজে নামে ডাকে। যাদের নাম বলেছিল- ওদের (ঈষিতার বান্ধবী) এবং ওদের আম্মুদের অনুরোধও করেছি, কেউ শোনেননি। মেয়েগুলোর মায়েরা তো হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমিও আর পরে খোঁজ নেইনি। অথচ মেয়েটা আমার বুলিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেদিন ও অনেক কেঁদেছে। আমি, ওর বাবা বুঝিয়েও সেদিন রাতে ঘুম পাড়াতে পারিনি।’

আরও পড়ুন>> সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হবে বুলিং-র‌্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি

ঈষিতার মা শিক্ষিত, সচেতন ও সাহসী হওয়ায় অভিযোগ এবং প্রতিবাদ করলেও অধিকাংশ অভিভাবক তা থেকে দূরে থাকেন। উল্টো এসব বিষয়ে ভুক্তভোগীরা তার মা-বাবাকে জানালে বকাও দেন বলে জানিয়েছে খোদ শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে র‌্যাগিং তেমন না থাকলেও বুলিং যেন নিত্যদিনের ঘটনা। রাজধানীর অন্তত ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে এবং শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বুলিং বিষয়ে ‘ভয়াবহ’ তথ্য জানা গেছে।

অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশে পাঁচমাস আগে ‘বুলিং-র‌্যাগিং প্রতিরোধ নীতিমালা’ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আদালত এ নীতিমালা বাস্তবায়নে সচেতনতা তৈরিসহ সবাইকে তা স্পষ্ট করে জানাতে তিনমাস সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তা বাস্তবায়নে একের পর এক নির্দেশনা দিলেও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এ নিয়ে ‘নড়চড়’ নেই। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নোটিশ বোর্ডে বুলিং-র‌্যাগিং কী, তা জানিয়ে এক পাতার কাগজ সাঁটিয়েই দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। তোড়জোড় করে করা নীতিমালা যেন এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিকেয় তোলা। সচেতনতা ও অবহেলায় তা কোনো কাজেই আসছে না।

শিশুমনে বাড়ছে বুলিংয়ের ক্ষত

অপমান সইতে না পেরে ভিকারুননিসার ছাত্রী অরিত্রীর চলে যাওয়া কিংবা মোটা হওয়ায় সহপাঠী-শিক্ষকদের বিদ্রুপে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া কিশোরের মৃত্যু দাগ কেটেছে মানুষের মনে। তোড়জোড় বেড়েছে বুলিং-র‌্যাগিং ও মানসিক হেনস্তা প্রতিরোধে। শোকের ছায়া কাটতেই ফের অবহেলা ও অচেতনতা। তাতে শিশুমনে বুলিং-র‌্যাগিংয়ের ক্ষত যেন বাড়ছেই। অভিভাবক-শিক্ষক কেউই সচেতন নন।

মতিঝিল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে শামসুন্নাহার শিলার (ছদ্মনাম) একমাত্র মেয়ে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর মেয়েকে স্কুলে দিয়ে বাইরে অপেক্ষায় তিনি। বুলিং-র‌্যাগিং নিয়ে কিছু জানেন কি না, জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্লাসে নাকি এটা নিয়ে শিক্ষকরা কী কী বলেছেন। মেয়ে একদিন বাসায় গিয়ে বলছিল। আমি ওসব (নীতিমালা) পড়ে দেখিনি। স্কুলে বন্ধু-বান্ধবীরা ইয়ার্কি-আড্ডা দিয়ে কিছু বললেই তো আর অভিযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। ওগুলো শিক্ষকরা দেখবেন।’

আরও পড়ুন>> বুলিংও হতে পারে আপনার সন্তানের নীরব ঘাতক

পাশেই সন্তানের অপেক্ষায় থাকা আরেক অভিভাবক বলেন, ‘৮-১০ দিন আগে আমার মেয়ের রং পেন্সিলের বক্স ভেঙে ফেলেছে ওর দুই বান্ধবী। নতুন একটা কিনে দেবো বলেছি। মেয়েটা কান্নাকাটি করছে। ওদের ক্লাস টিচারকে বললাম, বলে- ওই মেয়ের আম্মু নাকি স্কুলেরই শিক্ষক। তিনি এ নিয়ে কিছু বলতে পারবেন না। ভাবলাম- এখন অভিযোগ করলে যদি পরে আমার মেয়েটার ক্ষতি করে। এজন্য কিছু বলিনি। এখানে তো বুলিং করলেও বলা যাচ্ছে না। ভয় তো থাকেই।’

বুলিং-র‌্যাগিং কী, যেভাবে হলো নীতিমালা

২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর ‘আত্মহত্যা’ ও ২০২১ সালের জুলাইয়ে মোটা বলে সহপাঠী ও শিক্ষকের লাঞ্ছনার শিকার কিশোরকে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট করেন একজন আইনজীবী। রিটের ধারাবাহিক শুনানির একপর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট বুলিং-র‌্যাগিং নীতিমালা করার নির্দেশ দেন।

উচ্চ আদালতের নির্দেশে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র‌্যাগিং প্রতিরোধসংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’ প্রস্তুত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের ২৯ জুন নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ২ মে এ নীতিমালার প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়। সুপ্রিম কোর্ট গত ১৪ আগস্ট এ নীতিমালা তিনমাসের মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচার ও সচেতনতামূলক সভা করে জানানোর নির্দেশ দেন।

মৌখিক বুলিং: উপহাস, খারাপ নামে ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার, গালিগালাজ, শিস দেওয়া, হুমকি, শারীরিক সামর্থ্য নিয়ে উপহাস করা।

শারীরিক বুলিং-র‌্যাগিং: আঘাত করা, চড়-থাপ্পড়, শরীরে রং বা পানি ঢেলে দেওয়া, থুথু দেওয়া, লাথি-ধাক্কা মারা, খোঁচা দেওয়া, বেঁধে রাখা, বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়াতে বা বসতে বাধ্য করা, কারও জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা, অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি।

সামাজিক বুলিং: গুজব ছড়ানো, গায়ের রং, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র, পেশা এবং অঞ্চল তুলে গালি দেওয়া।

সাইবার বুলিং: কারও সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে কটু কথা লেখা, ছবি বা অশালীন ব্যঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট করা।

সেক্সুয়াল বুলিং-র‌্যাগিং: শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেওয়া, ইঙ্গিত বহন করে এমন চিহ্ন দেখানো, আঁচড় দেওয়া, জামা-কাপড় খুলতে বাধ্য করা।

বুলিং-র‌্যাগিংয়ের শাস্তি ও নজরদারি
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী- বুলিং-র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ তদন্তে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি থাকতে হবে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা কেউ বুলিংয়ে দায়ী থাকলে তাকে বহিষ্কার, ট্রান্সফার, পরের ক্লাসে প্রমোশন বন্ধ রাখা, সাময়িক ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করতে দেওয়ার মতো শাস্তি হতে পারে।

যদি শিক্ষক বা কর্মচারী বুলিং করেন, তাহলে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বা গভর্নিং বডির কোনো সদস্য বুলিংয়ে জড়িত থাকলে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হবে।

নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা স্থাপন, অভিযোগ বক্স রাখা এবং অ্যান্টি-বুলিং ও অ্যান্টি-র‌্যাগিং দিবস পালনের নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া বুলিংকারী ও ভুক্তভোগী উভয়কেই কাউন্সিলিং করাতে হবে। শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসহ অন্যদের বুলিং প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

শিশুকে ‘শাস্তি’ দেওয়াও আরেক ‘বিপত্তি’

নীতিমালার বর্ণনা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী- এটি সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষার্থী বুলিং-র‌্যাগিংয়ে জড়ালে তার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধের জন্য তাকে যদি স্কুল থেকে বহিষ্কার, প্রমোশন আটকে দেওয়া বা ক্লাসে সাময়িক বিরতির শাস্তি দেওয়া হয়, সেটা ওই শিশুকে মানসিকভাবে চরম চাপে ফেলবে বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন>> সচেতনতা ও প্রতিরোধই পারে সাইবার বুলিং রুখতে : টিক্যাব

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডলসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন স্কুল-কলেজ পর্যায়ের বুলিং-র‌্যাগিংয়ের দায়ে শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়াটা স্পর্শকাতর। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এটা করতে না পারলে বিপত্তি আরও বাড়বে।

ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ধরুন- সপ্তম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী তার সহপাঠী বা নিচের শ্রেণির কাউকে বুলিং করলো। তার বিরুদ্ধে অভিযোগটি প্রমাণিতও হলো। এবার তাকে যদি স্কুল থেকে বহিষ্কার বা টিসি (ট্রান্সফার) দেওয়া হয়, তার মনেও প্রচণ্ড আঘাত আসবে। অথবা তাকে ক্লাসে আসতে কিছুদিন নিষেধ করা হয়েছে। এটা কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, একবার ভাবুন! হয়তো সে এটা না বুঝে আড্ডাচ্ছলে করে ফেলেছে। এজন্য স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের বুলিংয়ের শাস্তি নির্ধারণে সতর্ক থাকা জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিটিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তীসময়ে নজরদারির চেষ্টা উত্তম পন্থা হতে পারে।’

বুলিংয়ের ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী, হারিয়ে ফেলে উচ্ছ্বলতা

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রাফসানি (ছদ্মনাম)। বিরতির সময় বন্ধুদের সঙ্গে টয়লেটে যায় সেও। এক বন্ধু দুষ্টামি করে তার শরীরে প্রস্রাব করে দেয়। রাফসানির প্যান্টে লাগে সেই প্রস্রাব। ৯ বছরের শিশুটিকে তার বন্ধুরা নোংরা বলতে থাকে। বেঞ্চে তার পাশ থেকে উঠে যায় খুব কাছের বন্ধুরাও। স্কুল ছুটির পর তার মাকে বিষয়টি জানায়। মা বিষয়টি এড়িয়ে সান্ত্বনা দিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে যান।

এরপর রাফসানি আর স্কুলে আসতে চায় না। প্রস্রাবের চাপ দিলেও তা ধরে রাখে। খুব গোপনে টয়লেটে যায় সে। টয়লেটে কাউকে আশপাশে দেখলেও ভয়ে কেঁপে ওঠে। সন্তানের এমন বিষয় একপর্যায়ে জানতে পারেন তার মা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও নিয়ে যান ছেলেকে। ততক্ষণে রাফসানির মনে দীর্ঘ ক্ষত জমেছে।

রাফসানির মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভুলটা আমার। ওইদিন যদি শিক্ষকদের বলে অন্য বাচ্চাদের নিয়ে ওদের মিলিয়ে দিতাম, তাহলে এমনটা হতো না। ছেলেটা আমার ঘুমের মধ্যেও ভয়ে কেঁদে ওঠে রাতে। ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছি। উনি বলছেন- আপনাদের অবহেলায় ওর মনে ভয়ভীতি ও ক্ষতের জন্ম হয়েছে।’

ঘটনা প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যে কোনো ধরনের বুলিং শিশুর মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি করতে পারে, যা ভবিষ্যতে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইন্টারনেট এখন শিশুদের কাছে সহজলভ্য। সেখানে কিছু ভায়োলেন্ট কনটেন্ট বাচ্চারা দেখে ও শেখে, যা তারা সমবয়সী অন্যদের ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। এতে তারা সাময়িক আনন্দ পায়। এখানে তেমনটি ঘটেছে।’

তিনি বলেন, ‘শিশু প্রতিনিয়ত বুলিংয়ের শিকার হলে তার আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারাতে পারে, অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারে। স্বাভাবিক উচ্ছ্বলতাও হারিয়ে যেতে পারে।’

তৎপর নন স্কুল-কলেজ, শিক্ষকরাও ‘অসচেতন’

বুলিং-র‌্যাগিং নীতিমালা বাস্তবায়নে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৎপরতা নেই। রাজধানীর হাতেগোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান বাদে কোনো প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে সচেতনতামূলক সভা হয়নি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বুলিং-র‌্যাগিং নিয়ে কিছুটা তৎপরতা দেখা গেছে। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, তেঁজগাও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সবুজবাগ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, আজিমপুরের অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো নামি প্রতিষ্ঠানে বুলিং-র‌্যাগিং নিয়ে তৎপরতার খবর মেলেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী-অভিভাবক নীতিমালা বিষয়ে জানেন না। কেউ কেউ আধো আধো জানলেও ভয়বহতা ও শাস্তির মুখে পড়ার বিষয়টি শুনে ‘আঁতকে’ ওঠেন।

বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মায়ের কাছে নীতিমালা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘কবে হয়েছে নীতিমালা? আমাদের তো জানানো হয়নি।’ নীতিমালাটি তাকে দেখানো হলে তা পড়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তার সন্তান এমন সমস্যায় প্রায়ই পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাচ্চাটাকে যেভাবে কয়েকটা বাচ্চা উত্ত্যক্ত করে, অভিযোগ দিলে তো ওরা এখানে পড়তে পারবে না।’

বলেন, ‘শিক্ষকরাও তো মনে হয় এটা জানেন না। তাদেরই উচিত এগুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বিরত রাখা।’

মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘নীতিমালা দেখেছি, তাতে যা আছে এগুলো তো হররোজ প্রতিষ্ঠানে ঘটছে। আমাদের এখানে একটা অভিযোগ বক্স রাখা হয়েছে। কেউ অভিযোগ তো দেয় না। মিটিং-সিটিং করবে শুনেছিলাম, হয়েছে বলে তো দেখিনি।’

বনানী বিদ্যানিকেতন ও মতিঝিল বালিকা বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের মতো আরও অন্তত পাঁচজন শিক্ষক নীতিমালা ও তা বাস্তবায়ন বিষয়ে কাছাকাছি মন্তব্য করেন। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে বেশ সচেতন। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার (ইংরেজি মাধ্যম) সহকারী প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বিষয়টি অত্যন্ত সচেতন এবং তৎপরতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি তার অধীন শিক্ষকদের এটা নিয়ে নিয়মিত নির্দেশনা দেন বলেও জানান।

অথচ মনোরোগবিদরা বলছেন- বুলিং প্রতিরোধে বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকদের তৎপর হতে হবে। ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বুলিং প্রতিরোধে প্রথম দায়িত্ব বাবা-মায়ের। তবে বুলিংটা যেহেতু স্কুলের ভেতরে, ক্লাসে, খেলার মাঠে বেশি ঘটে, সেজন্য শিক্ষকদেরও ব্যাপক ভূমিকা রাখতে হবে।

‘স্বচ্ছতার’ সঙ্গে নীতিমালা বাস্তবায়ন জরুরি

বুলিংটা বেশি ঘটে মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে। র‌্যাগিং বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে। র‌্যাগিং বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত ও শাস্তির ব্যবস্থা করে। মূলত স্কুল-কলেজ পর্যায়কে লক্ষ্য করে এ নীতিমালা।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যেহেতু অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাই অপরাধ করলে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটা ‘স্বচ্ছ’ থাকা জরুরি। পাশাপাশি এটা স্পর্শকাতরও। একটা অপরাধের শাস্তি দিতে গিয়ে যেন আরেক শিক্ষার্থীকে চরম মানসিক সংকটে ঠেলে দেওয়া না হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘নীতিমালাটা আমি ভালোভাবে পড়েছি। এটা শিশুদের সুরক্ষায় খুবই কার্যকরী হবে। স্কুলে-কলেজে যেহেতু বুলিংকারী ও ভুক্তভোগী উভয়েই শিশু, তাই শাস্তি নির্ধারণে সতর্ক থাকতে হবে। আবার এড়িয়েও যাওয়া যাবে না। শিক্ষকদের খুব দক্ষতার সঙ্গে এটা মোকাবিলা করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘শাস্তির পর্যায়ে যেতে দেওয়ার আগে সচেতনতায় ব্যাপক জোর দিতে হবে। ১৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। আমি জানি না- গত একমাসে কতগুলো প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে কার্যকরভাবে কাজ করেছে। এটার আপডেট শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি কিংবা অন্যদের; যারা এগুলো নজরদারিতে যুক্ত, তাদের নিতে হবে। শক্ত কিছু পদক্ষেপই এটা স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়নের পথে এগোতে সহায়তা করবে।’

নীতিমালা বাস্তবায়নে গাফিলতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনার দাবি জানিয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই। এটা আমাদের দেশে রীতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ নীতিমালাটা শিশুদের সুরক্ষায় খুবই কার্যকর। এটা বাস্তবায়নে যারা কাজ করছেন, তাদের তৎপর হওয়া, নিরপেক্ষ হওয়াটা জরুরি। যদি কেউ গাফিলতি করে, সেটা শিক্ষক হোক, প্রতিষ্ঠানপ্রধান হোক, তাকে শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

এএএইচ/এএসএ/এএসএম