‘ভিসিরা অন্য কাজে ব্যস্ত, র্যাংকিং নিয়ে ভাবার সময় কই’
বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এবারও উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষার মানদণ্ডে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্রমাবনতি ঘটছে বছরের পর বছর।
অবনতি ঘটলেও র্যাংকিংয়ের বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন না দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য। ঢাবির সঙ্গে তুলনা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও র্যাংকিং সিস্টেমকে গুরুত্বহীন ভাবছেন। সম্প্রতি এই দুই উপাচার্যের এমন মন্তব্যে আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে নানা মহলে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ব র্যাংকিংয়ের গুরুত্ব ও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে মতামত জানতে চাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এবং শিক্ষাবিদ, লেখক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে পৃথিবীজুড়ে প্রতিযোগিতা চলছে। বিশ্বের সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা সূচক থেকে র্যাংকিং করে। প্রতি বছরই এমন মানদণ্ড প্রকাশ করে। সূচকের দিক থেকে যারা পিছিয়ে থাকে, তারা সাধারণত র্যাংকিংয়ে স্থান পায় না।’
‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে থেকে দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা বরাদ্দ দিয়ে আসছে। স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বরাদ্দ শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যয় করে। সিন্ডিকেট সভা, একাডেমিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয় বরাদ্দ-ব্যয়ের বিষয়ে।’
তিনি বলেন, শিক্ষা নিয়ে সরকারের যে সদিচ্ছা তা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করে। এখানে সরকারের সদিচ্ছা বাস্তবায়ন করতে পারলেই র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থান করা সম্ভব।
কেন বিশ্ব র্যাংকিং থেকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? জবাবে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল সমস্যা সততার অভাব। সততা ও সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে দুর্নীতির খতিয়ান তা প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। আবার পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যেভাবে আমরা পার্থক্য করি, উচ্চশিক্ষার জন্য সেটাও এক প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলছে। কে পাবলিক এবং কে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তা বড় কথা নয়। মূল কথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উপলব্ধিটা থাকতে হবে।’
‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যদি তাদের মনিটরিংটা বাড়াতে পারে, তাহলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটবে। মনে রাখতে হবে, সততার কোনো বিকল্প নেই। ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা বড় ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পদে থাকা ব্যক্তিরা সৎভাবে দায়িত্ব পালন করলে শিক্ষার মান বাড়বে। নির্বাহীদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও সরকারের বিশেষ ভাবনা থাকা দরকার, অন্তত সততার প্রশ্নে’ যোগ করেন আরেফিন সিদ্দিক।
বিশ্ব র্যাংকিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আমরা যদি শিক্ষাব্যবস্থায় উৎকর্ষ সাধন করতে চাই, সেক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা সূচকে প্রতি বছর র্যাংকিং করে। সেই সূচকে হয়তো ৫ শতাংশ পাস করে। কিন্তু পৃথিবীর সেরা ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৫টিই হয়তো আমেরিকার।
প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন সূচকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিং করা হয়। আমরা করি না। করার প্রয়োজনও বোধ করি না। আমাদের ভিসিরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। র্যাংকিং নিয়ে ভাবার সময় পান না। ভিসিরা অন্য কাজে ব্যস্ত, র্যাংকিং নিয়ে ভাবার সময় কই?’
‘আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মানজনক র্যাংক নিয়ে ভাবতে পারলেই কেবল এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবো। ঢাবি সম্মানজনক অবস্থানে নেই বলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার অবস্থান দাঁড় করাতে পারবে না, এটি ভাবলে হবে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে ভাবতে পারে।’
‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণা, শিক্ষার মান নিয়ে চিন্তা করার সময় পান না। অথচ এই চিন্তা এবং এর বাস্তবায়নই তাদের মূল কাজ। এই চিন্তার জন্য অবশ্য পরিবেশ তৈরি ও সাহায্য করার বিষয় থাকে। পরিবেশ তৈরি হলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য সহজেই ভাবতে পারবেন যে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়টিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে। এজন্য যা যা করার দরকার তাই করতে থাকবে’ বলেন ড. কায়কোবাদ।
মানবসম্পদের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। মানুষই এদেশের বড় সম্পদ বলে বিশ্বাস করি। আর কোনো বিশেষ সম্পদ নেই, যা দিয়ে আমরা বিশ্বে অবস্থান দাঁড় করাতে পারি। মানুষকে যদি উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে সম্পদে পরিণত করতে না পারি, তাহলে এই মানুষই রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার মধ্যম আয়ের দেশ, উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই বোঝা নিয়ে সে স্বপ্ন তখন পূরণ হবে না। শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং তা বিশ্বমানের করা। আমাদের মানবসম্পদ বিশ্বমানের কি না তা অনেকটাই নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং ব্যবস্থা। কোরিয়ার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের অবস্থানে রয়েছে। কোরিয়া এক সময় আমাদের মতোই অবস্থানে ছিল। শুধু ভালো মানের শিক্ষা তৈরি করে তারা এখন সবদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও এখন মানসম্মত শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের ভূমি বেশি নয়। মানুষকেই মূল সম্পদ বিবেচনা করে শিক্ষা-দীক্ষায় বিনিয়োগ করে রাষ্ট্র, সমাজকে এগিয়ে নিতে হবে।’
এএসএস/এএসএ/এএসএম