বিতর্কিত এলজিইডিই পাচ্ছে ৩৪২ প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার কাজ
সম্প্রতি বরগুনায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের গ্রেড বিম ভেঙে পড়ে এক ছাত্রী নিহতের ঘটনায় তোপের মুখে পড়েছে নির্মাণকারী সংস্থা স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি)। ইতোমধ্যে ঘটনা তদন্তে কমিটিও গঠন করেছে সরকার।
স্থানীয়দের দাবি, নিম্নমানের কাজের কারণেই স্কুলটির বিম ভেঙে পড়েছে। এ কারণে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনগুলো চিহ্নিত করে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়কে জানাতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
আরও পড়ুন : শ্রেণিকক্ষের পলেস্তারা ধসে স্কুলছাত্রী নিহত
জানা গেছে, এমন অবস্থায় নতুন করে রাজধানীর পূর্বাচল ও উত্তরার ১৪টি নতুন স্কুল নির্মাণ, ১৭৭টি স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়ন ও দৃষ্টিনন্দন এবং ১৫৪টি স্কুলের ২ হাজার ৯৭৫টি কক্ষ নতুনভাবে নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্ব পাচ্ছে সেই এলজিইডি। এজন্য আগামী সপ্তাহেই ১ লাখ ১৫ হাজার ৯২০ কোটি ৫৩ লাখ টাকার প্রকল্প একনেকে পাস হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয় এলজিইডির নির্মাণ কাজে সন্তুষ্ট নয় বলে জানিয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদ্যালয়গুলোর ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) আদলে তারা আলাদা অধিদফতর চাইলেও তা আটকে আছে দীর্ঘদিন। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে জারজীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। রাজধানীতেও এর সংখ্যা কম নয়। জাতীয়করণ হলে প্রতি অর্থবছরে ৫ থেকে ৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ, একই পরিমাণ স্কুলে বড় ধরনের সংস্কারের পরও অধিকাংশ বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ থেকে যাচ্ছে।
বরগুনায় একটি সরঃপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাদের ভিম ধসে পড়ায় মারা গেছে এক ছাত্রী
মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নির্মাণ ত্রুটির কারণেই ভবন দ্রুত জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে। নির্মাণের খুব অল্প সময় পরেই ভবন জরাজীর্ণ হয়ে পড়লেও এলজিইডি যেভাবেই ভবন নির্মাণ করে সেভাবেই মেনে নিতে হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। তবে একাধিক সময় এলজিইডির নির্মাণকাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে নিজ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই নির্মাণ প্রকৌশল সংস্থা স্থাপন করার প্রস্তাব করলেও তা আলোর মুখ দেখছে না দীর্ঘদিন ধরেই।
গত শনিবার বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের গ্রেড বিম ভেঙে মানসুরা (৮) নামে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় একই শ্রেণির আরও পাঁচজন আহত হয়। ওই স্কুল ভবনটি ২০০২ সালে নির্মাণ করে এলজিইডি। নির্মাণের মাত্র ১৬ বছরের মাথায় ছাদ ভেঙে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল।
ভবন নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ছোটবগী ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ তৌফিকুজ্জামান তনু। একাধিক স্কুলের স্থায়ী জনপ্রতিনিধি অভিযোগ করেছেন এলজিইডির নির্মাণকাজে ঠিকারদাররা কমিশন ছাড়া কাজ করেন না।
এ অবস্থায় আগামী জুলাই থেকে সেই এলজিইডির অধীনেই ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা) এনামুল কাদের খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিডিইপি-৪ এর অধীনে রাজধানীর ৩৪২টির মধ্যে বেশ কিছু স্কুলে নতুন ভবন নির্মাণ, কিছু স্কুলে নতুন কক্ষ নির্মাণ এবং বাকিগুলোর কক্ষের অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনের একটি প্রকল্প শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। বরাবরেই মতই এই কাজটিও করবে এলজিইডি। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ‘এই প্রকল্পের জন্য এলজিইডি অর্থ প্রস্তাব করেছে ১১৫,৯২০.৫৩ লাখ টাকা। এর পুরোটাই সরকারি কোষাগার থেকে জোগান দেয়া হবে।
প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা, শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটানো, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার, উচ্চ শিক্ষা এবং পরিপূর্ণ উন্নতির ধারাবাহিকতার মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য হ্রাসকরণ, প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীর জন্য শিশুবান্ধব শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিতসহ শিক্ষার মান বৃদ্ধিকরণ।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার সংশ্লিষ্টরা জানান, গত তিন বছর ধরে এলজিইডি রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করে কোন স্কুলে কেমন সংস্কার বা কতটি নতুন কক্ষ প্রয়োজন তা নির্ধারণ করেছে। তাদের হিসাবমতোই এই প্রকল্পটির সকল পরিকল্পনা প্রস্তাব আকারে প্রস্তুত করা হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি অর্থবছরে স্কুল ভবন নির্মাণে দুটি প্রকল্পের অধীনে কাজ চলছে। ‘চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্প’-এর অধীনে নির্মিত হচ্ছে ৮১৫০টি স্কুল। আর ‘চাহিদাভিত্তিক নব্য জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্প’র অধীনে নির্মিত হচ্ছে আরও ছয় হাজার ৭১৭টি স্কুল।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘বরগুনার ঘটনায় আমরা একটি এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি, যদি কোনো জরাজীর্ণ ভবন থাকে তাহলে যেন জানানো হয়। আমরা দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।’
এলজিইডির নিম্নমানের ভবন নির্মাণ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা (এলজিইডি) আমাদের ভবন নির্মাণ কাজ করে। তবে প্রাথমিকের জন্য নিজেদের আলাদা প্রকৌশল অধিদফতর করার প্রস্তাবও রয়েছে। সেটা যত দিন না হবে সে পর্যন্ত এলজিইডির সঙ্গেই কাজ করতে হবে। তবে ভবনের মান নিশ্চিত করতে এলজিইডির সঙ্গে আমরা নতুন করে সমঝোতা স্বাক্ষর করব।’
অন্যদিকে গত সোমবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে বরগুনার ছাত্রী নিহতের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত নতুন ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও নির্দেশ দিয়েছেন মন্ত্রী।
অতিঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবন চিহ্নিতের নির্দেশ
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনগুলো চিহ্নিত করে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়কে জানাতে সব জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনে তারা উপজেলা প্রকৌশলী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সহযোগিতা নিতে পারবেন বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়।
এমএইচএম/এমএমজেড/পিআর
আরও পড়ুন
সর্বশেষ - শিক্ষা
- ১ ইউজিসি ঘেরাও করে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
- ২ গুচ্ছ ভর্তি বহাল রাখতে ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে জরুরি নির্দেশনা
- ৩ শনিবারও বন্ধ থাকবে স্কুল, সাপ্তাহিক ছুটি দুদিনই বহাল
- ৪ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২৫ সালে ছুটি ৭৬ দিন, তালিকা প্রকাশ
- ৫ সরকারি-বেসরকারি স্কুলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা জুনে, বার্ষিক নভেম্বরে