প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে সমাপনী পরীক্ষায় চার পরিবর্তন
প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও ইবতেদায়ী পরীক্ষায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এর মধ্যে শতভাগ কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিতে (সৃজনশীল) প্রশ্ন প্রণয়ন, নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা বাতিল, নতুন সফটওয়ারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে প্রশ্ন বিতরণ, আগের চেয়ে প্রশ্নসেট বেশি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার প্রায় প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে বির্তক। এ কারণে সমাপনী-ইবতেদায়ি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে আরও সর্তকতা অবলম্বন করছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাসিক সমন্বয় সভায় পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক) বাদ দিয়ে রচনামূলক কী কী প্রশ্ন যুক্ত করা যায় সে বিষয়েও কাজ শুরু হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী শতভাগ সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা আয়োজন, প্রশ্ন বিতরণের সময় প্রশ্নপত্র যেন ফাঁস না হয় সে কারণে সফটওয়ারের মাধ্যমে ৮ দিনের মধ্যে প্রশ্ন বিতরণ (আগে ২৫ দিন সময় প্রয়োজন ছিল) করা হবে, ৬ সেট প্রশ্নপত্রের বদলে ৮ সেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সভাপতিত্বে আয়োজিত ওই সভায় মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরসহ প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ ফেব্রুয়ারি সভায় মন্ত্রী মোস্তফিজুর রহমান ফিজার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় নৈর্ব্যত্তিক বা বহু নির্বাচনী প্রশ্ন তুলে দেওয়া সমীচীন হবে উল্লেখ করে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। এছাড়া প্রশ্নপত্র ছাপানোর ক্ষেত্রে বিজি প্রেসের বিকল্প আরেকটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের বিষয়েও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চলতি বছরের জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) থেকে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার এমসিকিউসহ (নৈর্ব্যতিক) প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর বিভাজের রূপরেখা সারাদেশের স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এই আদেশ জারির মাত্র ৮ দিন পর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ (নৈর্ব্যতিক) পদ্ধতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, নানা পর্যবেক্ষণে নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নফাঁস হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। এ কারণে আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আয়োজিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এমসিকিউ (নৈর্ব্যত্তিক) অংশ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নৈর্ব্যত্তিক বাদ দিয়ে কোন ধরনের রচনামূলক প্রশ্ন যুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুয়ায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর নেপকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ বাদ দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ অংশ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে এমসিকিউ অংশ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে না পেরে এমসিকিউ পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হয়নি। সারা পৃথিবী যেখানে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয় সেখানে আমরা এটা পারছি না। কেন পারছি না?
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর বহু দেশে পরীক্ষায় এমসিকিউ অংশ রয়েছে এবং ভালো ফলাফলও দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি ভালো নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি এ পদ্ধতি মুখস্থবিদ্যাকেও বাড়িয়ে তুলছে। এখন এ পদ্ধতি (নৈর্ব্যত্তিক) তুলে দেওয়ায় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে।
তথ্যমতে, প্রাথমিকের ৬টি বিষয়ের পরীক্ষার মধ্যে বাংলায় ১০, ইংরেজিতে ২০, গণিতে ২৪, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়ে ৫০, প্রাথমিক বিজ্ঞানে ৫০ এবং ধর্ম বিষয়ে ৫০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্নপত্র রয়েছে। কিন্তু নতুন নির্দেশনার আলোকে এমসিকিউ বাদ দিয়ে এসব জায়গায় রচনামূলক প্রশ্ন যুক্ত করা হবে।
এদিকে অন্যান্য সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও সমাপনী পরীক্ষায় নৈব্যত্তিক বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা পড়ছেন বিপাকে। তারা বলছেন, বুঝে ওঠতে পারছি না, ৯ মাস পরে ঠিক কোন পদ্ধতিতে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
একাধিক শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেবেচিন্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। আর ভুলের খেসারত দিতে হয় আমাদের মতো শিক্ষকদের। ৯ মাস আগে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার হলে আমরা এই সময়ের মধ্যে বাচ্চাদের কিভাবে গড়ে তুলব?
রাজধানী মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা অভিভাবক জহিরুল ইসলাম বলেন, গত বছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা হবে না। এই সিদ্ধান্ত জানানোর তিনদিন পরে মন্ত্রণালয় থেকে আবারও ঘোষণা দেয়া হয়, সমাপনী পরীক্ষা হবে। এবার বলছে এমসিকিউ থাকবে না। এমসিকিউ পরীক্ষা হবে না ভালো কথা, কিন্তু এটি ৯ মাস আগে কেন বলবে? ভেবেচিন্তে আরও আগে বলা উচিত ছিল। এমসিকিউ বাদ দিলেই কি প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে না?
এমএইচএম/আরএস/আরআইপি