রাঙা বই হাতে স্বপ্ন ফিরবে বাড়ি
‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটব, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশ জুড়ে উঠব।’ এই স্লোগানের মতোই সোমবার দেশের সব স্কুল প্রাঙ্গণ নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রাপ্তির উৎসবে মুখরিত হবে। শীতের পরশমাখা নতুন দিনের স্নিগ্ধ সকালে চার কোটি ৪২ লাখ চার হাজার ১৯৭ জন শিক্ষার্থী নতুন বই পেয়ে মেতে উঠবে আনন্দে। রাঙা বই ক্ষুদে হাতে করে বাড়ি ফিরবে মা-বাবার স্বপ্ন।
সোমবার সকাল ১০টায় রাজধানীতে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদা পাঠ্যপুস্তক উৎসব করবে। সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও উৎসবের মধ্য দিয়ে বই বিতরণ করা হবে। এসব উৎসবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক উৎসবের উদ্বোধন করবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। বিশেষ অতিথি থাকবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. মোতাহার হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আসিফ-উজ-জামান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
অপরদিকে রাজধানীর আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক উৎসবের উদ্বোধন করবেন। এই উৎসবে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেবে। এনসিটিবির আয়োজনে এই উৎসবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তুক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহাসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
এই উৎসব পালন করতে মন্ত্রণালয় ২৮ লাখ টাকার বাজেট করেছে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইনটিয়াটিভস নামের একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে অনুষ্ঠানে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অপরদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উৎসবের জন্য মাত্র সাড়ে সাত লাখ টাকা ব্যয় ধরেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ‘বিলাসি বাজেট’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের দুই কোটি ৪৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯৯৩ শিক্ষার্থীকে চার রঙের ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৮০টি নতুন বই বিতরণ করা হবে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩৪ লাখ ১১ হাজার ৮২৪টি ‘আমার বই’ ও অনুশীলন খাতা বিতরণ করা হবে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরী এই পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির ৩৪ হাজার ৬৪২টি ‘আমার বই’ ও অনুশীলন খাতা দেয়া হবে। এছাড়া উল্লিখিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রথম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের মোট ৭৯ হাজার ৯৯২টি বই বিতরণ করা হবে।
সূত্র আরও জানান, বিগত বছরের মতোই বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের আওতাধীন স্কুলগুলোতে বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়েছে। কূটনৈতিক ব্যাগের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন, সৌদিআরব, কুয়েক, স্পেনসহ মিশুনগুলোতে এরই মধ্যে বই পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এবছর প্রাথমিক স্তুরের বই ৯৮টি লটে ৩২টি দেশীয় প্রতিষ্ঠান ছাপিয়ে সরবরাহ করেছে। বই ছাপায় ৪০৫ কোটি ৮৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫০টাকা খরচ হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের এক কোটি ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩ জন শিক্ষার্থীকে এবার বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়া হবে। ১১৪টি বিষয়ের ১৭ কোটি ৮৯ লাখ ২৩ হাজার ৭৩৩টি বই ছাপানো হয়েছে। এছাড়া ইবতেদায়ি ও দাখিলের ৫৪ লাখ ৩ হাজার ৪৬৯ শিক্ষার্থীকে ১২৪টি বিষয়ের পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮২৯টি বই দেয়া হবে। অন্ধদের জন্য এবারও ব্রেইল পদ্ধতির আট হাজার ৪০৫টি বই ছাপানো হয়েছে।
এনসিটিবিরি কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ভুলে ভরা বই সংশোধন, ১২টি পাঠ্যবই পরিমার্জন, বিলম্বে টেন্ডার আহ্বান, ঠিকাদারদের ধর্মঘটসহ আগামী শিক্ষাবর্ষের নতুন বই ছাপায় বেশকিছু শঙ্কট ছিল। তবে কঠোর মনিটরিং ও পরিশ্রম করে নির্ধারিত সময়ের আগেই টেকসই ও মানমম্মত বই ছাপার কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, শিক্ষাবিদদের পরামর্শে মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির (স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি) সাধারণ বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ণ ও জীব বিজ্ঞান এই চারটি বিষয়ের ১২টি বই সহজবোধ্য ও ভিতরে সব পাতা রঙিন করে চাপানো হয়েছে। পরিমার্জিত ১২টি (সুখ পাঠ্য) বই সহজপাঠ্য করা হয়েছে। এবার শতভাগ বই ব্লু বাইন্ডিং (মেশিনে সেলাই) করা হয়েছে। সহজেই বই ছিড়ে যাবে না। পানিতে ভিজলেও নষ্ট হবে না।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র সাহা বলেন, বিপুল সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক সঠিক সময়ে ছাপা শেষে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অগণিত শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে দেয়া ছিল রীতিমত একটি দুরূহ কাজ। এই কঠিক চ্যালেঞ্জ সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে বছরের প্রথম দিন উৎসবমুখর পরিবেশে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে যে রীতি এ সরকারের আমলে সূচি হয়েছে-তা ইতোমধ্যে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এক অভাবিত উদ্দীপন ও স্বতঃস্ফূর্ততা সৃষ্টি করেছে।
তিনি আরও বলেন, আগে এপ্রিল-মে মাসেও শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের জন্য অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দিতে পারার অভূতপূর্ব এ অগ্রগতি নিঃসন্দেহে সরকারের ‘দিন বদলের প্রতিশ্রুতিরই সফল বাস্তবায়ন।’
প্রসঙ্গত, চলতি শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে বেশ কিছু ভুল ও বিকৃতি করে ছাপা হয়। ভুলে ভরা বই নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। এক পর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এছাড়া বিভিন্ন দাবিতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বই ছাপার কাজ বন্ধ করে ধর্মঘট করে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা।
এমএইচএম/জেডএ